নিঝুম রাতের বেলা
সেলিনা ইসলাম
আজ কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে ক্রিং ক্রিং বেল দিয়ে যাচ্ছি। পথের দুই ধারে বড় বড় গাছ। কেমন যেন গা ছমছম করছে। সাইকেলের সামনে টর্চটা বেঁধে দিয়ে আলো জ্বেলে দিয়েছি। সেই আলো পড়ছে পথের উপর। কোন লোকজন নেই পথে! বেল বাজিয়ে আসলে নিজের মনের ভয়টাকে দূর করছি। চারদিকে ঝিঁঝিঁরা বেশ প্রতিযোগিতা করে চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একটা কুকুর ঘেউউউউ করে ডেকে থেমে যাচ্ছে। আশেপাশে কোন বাড়ি থেকে হাসি আনন্দের সূর ভেসে আসছে। বাতাসে কেমন একটা তেলে ভাঁজা তেলে ভাঁজা ঘ্রাণ! নাকে লাগতেই পেটের মধ্যে কুউউ করে মোচড় দিয়ে ডেকে উঠলো। "নাহ খুব ক্ষুধা লেগেছে! আরে আরেরেএএ..."
আর একটু হলেই সাইকেল থেকে পড়ে যেতাম। দেখি আঁট দশ বছরের একটা মেয়ে,সারা গায়ে কাঁদা মেখে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে কী যেন ব্যাগে ভরছে! আমি সাইকেল থেকে নেমে মেয়েটাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করালাম। এই এতো রাতে অন্ধকারে একটা শিশু মেয়ে কী করছে? যে দিনকাল পড়ছে তাতে যে কোন মুহূর্তেই একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। টর্চের আলোটা মাটিতে ফেলেই আমি চমকে উঠলাম! "এতো পিঠা!" মনে পড়ল কাল পৌষ সংক্রান্তি উৎসব। রাত জেগে সবাই পিঠা বানাচ্ছে! "আচ্ছা এইজন্য বাতাসে এত পিঠা ভাঁজার ঘ্রাণ আসছে!" এবার আমি বেশ গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তাকালাম মেয়েটার দিকে। "আরে মেয়েটা গেলো কৈ!?" এদিক ওদিক ঘুরে তাকাতেই দেখি মাটিতে বসে দুইহাতে মুঠো ভরে পিঠা খাচ্ছে। মেয়েটা এত পিঠা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?
-এই মেয়ে তুমি একা একা এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ?
প্রথমে কিছুই বলে না দেখে আমি একটা ধমক দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম। এবার রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে-
-আমি পিঠা খাইতেছি দেখেন না! মৃদ্যু রাগ ঝাড়ল।
-আচ্ছা তা খাও। কিন্তু এতো রাতে একা একা এই নির্জন রাস্তায় কেন? চল বাড়িতে চল। সেখানে গিয়ে খাবে।
এই বলে আমি মেয়েটাকে হাত ধরে টেনে উঠালাম। দেখি শান্ত চোখে সে আমার সাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে। বললাম-
- কী সাইকেলে উঠবি?
মাথা উপর নীচে নাড়িয়ে একটা দুষ্টু হাসি দেয়। আমি ওকে সাইকেলের সামনে বসালাম। পিঠার ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিলো মেয়েটা। নেমে পিছনে গিয়ে দুই পা দুদিকে ঝুলিয়ে দিয়ে বসল! ভীষণ পচা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল। মনে হল আশেপাশে কোন মানুষ বা জন্তু মরে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সাইকেলের প্যাডেলে গায়ের জোরে চাপ দিলাম। কিন্তু একচুলও সামনে এগুলো না। "আরে এইটা মানুষ না হাতী? এতো ভার!" আরেকবার জোরে ট্রাই করার আগে জিজ্ঞাসা করলাম-"তোর নাম কী?" কোন কথা নেই। আবার জিজ্ঞাসা করলাম
-"তোর বাবার নাম কী?"
-"রইস উদ্দিন মোল্লা,মায়ের নাম জমিলা খাতুন"
ততক্ষণে আমি বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছি। কেন জানিনা মনের মাঝে নাম দুটো খচখচ করছে। কিছুদূর আসার পরে পিছন থেকে মেয়েটা বলে উঠে "ব্যাস ব্যাস আইসা গেছি থামেন।" আমি থেমে গেলাম। মেয়েটা নেমে সোজা সামনের দিকে হেঁটে গেলো। পিঠার ব্যাগটা পিছনে ঝুলে আছে। পাশেই ছিল আমার বাড়ি। আমি বাড়িতে গেলে মা প্লেটে পিঠা সাজিয়ে সামনে রেখে বলল "বাজান শুনছো কিছু?" একটা পিঠায় কামড় দিতে দিতে বললাম-
-কিছু কইলে না কিছু হুনুম
-পাশের বাড়ীর রইস উদ্দিন মোল্লা আর তার বউ জমিলা খাতুনের লাশ নদীতে ভাইসা উঠছে।
- "কও কী মা!" আমি এত জোরে চমকে উঠি যে পুরো চৌকিটাই নড়ে উঠলো। পিঠা হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- -আর উনাগোর মাইয়াডা!?
আমার গলা শুকিয়ে আসে। আজ তিনদিন ধরে সারা গ্রামের মানুষ আলোচনা করছে যে, রইস উদ্দিন মোল্লা,তার স্ত্রী এবং একমাত্র সন্তানকে মোড়ল বাহার খান গুম করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য রইস উদ্দিনের জমি ভিটা দখল করে নেয়া। আমার মা কাঁদো কাঁদো সূরে বললেন-"মাইয়াডার লাশও পাওয়া গেছে নদীর কিনারে। মাতবর কইতাছে যে লঞ্চ ডুইবা গেছিল,সেই লঞ্চে নাকি ওরা আছিল।" বাচ্চা মেয়েটার দুষ্টু হাসিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হঠাৎ বারান্দায় রাখা সাইকেলের রিং বেজে উঠল-"ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং"। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দেখি সাইকেলটায় কেউ বসা নেই! তবুও সাইকেলটা উঠানে চক্কর দিচ্ছে।
ছবি-গুগুল থেকে নেয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৫:০৯