অনেক আগের লেখা একটা গল্প সবার সাথে শেয়ার করলাম। আশাকরি সবার ভালো লাগবে-
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় সজলের বয়স তখন দশ কি এগারো বছর । গ্রামের মাষ্টার সাহেবের হাত ধরেই সেও চলে যায় যুদ্ধে । মাষ্টার সাহেব তাকে কোথায় রেখে যাবে ? এই যুদ্ধ সজলের বাবা, মা,ভাইবোন সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। এমন কি ভিটাটুকু থাকলেও বাস যোগ্য ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজাকার মুত্তালিব । বাধ্য হয়ে সজল গ্রাম ছেড়ে সামিল হয় মুক্তি সেনাদের তাবুতে। সবার ফাইফরমাশ খাটে আর মাঝে মাঝে বন্দুকের নল পরিস্কার করে । বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও সে সাহসিকতার পরিচয় দেয় । আবার কখনো কখনো সে রান্নায় হাত বাটায় কুসুম খালার সাথে । বেশ আনন্দ সহকারে সে সব কাজ করে । যেদিন পাক সেনাদের ক্যাম্প দখল করে মুক্তিসেনার দল , সেদিন যেন ঈদের আনন্দ উৎসব বয়ে যায় তাবুতে । মাঝে মাঝে অবশ্য এই আনন্দ ফিকেও হয়ে যায় । যখন প্রিয় শহীদ বন্ধুকে সোনার মাটিতে ঢেকে দেয়া হয় । কখনো কখনো আবার আগ্নেয়গিরির লাভা , পাকস্থলীর অলিগলিতে যন্ত্রণার তাণ্ডবলীলা শুরু করে । যখন দিনের পরে দিন একফোঁটা দানা পড়ে না পেটে । তবুও সবার মাঝে প্রতিদিন নতুন সূর্যের আলো নতুনভাবে উদ্যমতা এনে দেয় আগামীর বিজয় প্রতীক্ষায়- কুয়াশা ভেদ করে সবুজ প্রান্তরে অগ্নিতপ্ত সূর্যোদয় হবেই হবে ।
মুক্তিসেনার দল প্রতিটা মুহূর্ত জয়ী হবার বাসনায়,চোখের পাতায় প্রিয়জনের উজ্জ্বল হাসিমুখ স্মরণ করেই; এক এক করে ছিড়ে ফেলে পৈশাচিক পাণ্ডুলিপির পাতা !
কনকনে শীতের রাত । না আছে গায়ে শীতের কাপড়, না পারছে আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে । নিশুতি রাতে জঙ্গলের মাঝে কুসুম খালার সাথে মশার কাপড়ে যন্ত্রণায় কাতর সজল । কুসুম খালা বুকের মাঝে জাপটে ধরেছে তাকে । একটা শব্দও যেন তার কানে না যায় । গুলির আর বোমার শব্দ , সেই সাথে মানুষের চিৎকার ! কুসুম খালা এত জোরে চেপে ধরেছে যে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে সজলের । খুব জোরে জোরে দোয়া পড়ছে কুসুমখালা , হঠ্যাৎ অনেক আলো জ্বলে উঠে। গরম বাতাস জানান দেয় পাশেই কোথাও ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে । একসময় থেমে গেল সব কিছু , এমন কি কুসুম খালার দোয়া পড়া কন্ঠও । আশার প্রত্যূষে সত্যিই কুহেলিকা ভেদ করে সূর্য উঠেছে , সাথে নিয়ে প্রশান্তির জয়গান ! শুধু চিরতরে ঘুমিয়ে গেল কুসুম খালা আর মাষ্টার সাহেব ।
এবার ঘরে ফেরার পালা ---
নদী শুকিয়ে গেছে । শীতের এই দিনে ওপারে যেতে এখন আর নৌকা লাগে না । গ্রামের ছোট্ট সুন্দর নদীটায় ভেসে আছে নারী,পুরুষ , পশুপাখি আর জীবজন্তুর লাশ । ক্লান্ত পায়ে সজল হাঁটু পানিতে সাতার কাটে । মাঝামাঝি আসতেই কেউ বুঝি তাকে জড়িয়ে ধরে । আঁতকে উঠে সে , দেখে আট দশ মাসের একটা শিশু মায়ের বুকে জাপটে আছে লাশ হয়ে ।ঐ মায়ের চুল বেধেছে সজলের পায়ে । পচা দুর্গন্ধ পানি ঢকঢক করে গিলে খায় সে । চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে তারপর বহু কষ্টে ফিরে আসে জন্মতরী ভিটায় । কিন্তু একি ! সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সদ্য তোলা টিনের ঘর ! নাকে লাগে রান্নার ঘ্রাণ , পেটের মাঝে মোচড় দিয়ে বমি আসে । পায়ে একটুও জোর পায়না সজল । গোয়াল ঘরেই গরুর পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ে ।
পরবর্তীতে এই গোয়াল ঘরই হয় সজলের পরম শান্তির জায়গা । রাজাকার মুত্তালিব বুড়ী মায়ের অনুরোধে তাকে বাড়ীর কাজে রেখে দেয় । গোয়াল ঘরের লাল গরুটার সাথেই সজলের যেন নাড়ীর টান । রাতের অন্ধকারে ছেড়া মশারির মাঝে একটা চটের চাদর জড়িয়ে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সজল । শীতের তিব্রতা ছুতে পারে না সজলের রক্তকণিকা । এভাবেই দিন যায় ,মাস যায়, যায় বছরের পর বছর ---
সজল এখন বাইশ বছরের টগবগে যুবক । সারা বছর যত না আনন্দিত হয় গ্রামের মানুষ , তার চেয়ে শীত মৌসুমের এই লগ্ন বেলায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায় শতগুন । নাড়া , শন দিয়ে ঘর ছাউনি , নতুন ধানের পিঠা , খেজুরের রস, বরই , আর নতুন নতুন টাটকা সব শাকসবজি । সাথে থাকে বাড়তি পৌষমেলায় নাগর দোলা চড়া আর বাইস্কোপে সাহেব বিবির কিসসা দেখার মজা । গ্রামের মানুষের গায়ে তেমন কোন শীতের কাপড় নেই । নেই বাড়তি বিলাসিতা । তবুও কিছু ধান বিক্রি করে বা ধানের বিনিময়ে বউ ঝিয়েরা কেনে কাচের চুড়ী ফিতা , দেখে যাত্রাপালা ।
প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে খুশি আর আনন্দের উচ্ছলতায় ভাসে গ্রাম । এমনই একদিনে সজল খালে নেমে গোসল দেয় গরুকে । রাস্তা দিয়ে হেটে যায় এক পথিক । সজল জানে না কেন এই পথিককে তার অনেক চেনা মনে হয় ।গরুর শরীর মাজন দিতে দিতে হাঁক দেয় -
-" ও---কাকা কেমন আছেন ?" ঘুরে দাঁড়ায় আগন্তক । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সজলের দিকে । তারপর বলে -
-"মারা যাবে , সব মারা যাবে ! শেষ হয়ে যাবে সব ! তুই পালা , তুই পা---লা ! বুম বুম "
সজল এবার উঠে আসে উপরে । সে যা ভেবেছিল তাই , রফিজ কাকা । তাহলে কাকা বেচে আছে ! একটা অপারেশনে বোমা নিক্ষেপ করেছিল এই রফিজ কাকা । সজলের মনে আছে ব্রিজের নিচে রফিজ কাকা ঠান্ডা পানির মধ্যে কচুরিপানার আড়ালে সজলের জন্য অপেক্ষা করেছিল দশটা ঘন্টা ধরে। সজল টিফিন কেরিয়ারে করে বোমা নিয়ে ব্রিজ পার হয়েছিল । বাচ্চা ছেলে দেখে মিলিটারিরা তাকে কিছুই বলেনি এমন কি কোন কিছু চেকও করেনি । রফিজ কাকা আর ফেরেনি তবে ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে গ্রামের সাথে শহরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল এবং বেশকিছু টহলরত মিলিটারি সেদিন মারা গিয়েছিল ।
-"রফিজ কাকা তুমি বাইচা আছো !" জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সজল । তা দেখে রফিজ বিরক্ত হয় । ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে । বিরক্ত ভরা কন্ঠে বলে -
-"দূর দূর হ ! ছিঃ ছিঃ গায়ে হাত দিস কেন ! সব রাজাকার সব ! তুই রাজাকার , তুই রাজাকার ! "
হনহন করে হেটে যায় সে সামনের দিকে । সজলের মন খারাপ হয়ে যায় ।এই রফিজ কাকা সারাটা দিন দেশের গান গাইতো । সজলকে বলত -
-"হুনো কাকা, দেশের গান গাইলে অন্য রহম একটা শক্তি আহে গাঁয়ে ।তহন মনে লয় যা মনে চাইব তাই করতে পারুম ! ধর আমার লগে গান ধর -কারার ঐ লৌহ কপাট............!" কথাগুলো মনে করে আজ এতোটা বছর পরেও,সজলের বুকের ঢল বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রু প্লাবন ! রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় বাঁশের খুঁটিতে হেলেন দিয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে । এই জীবন তার ভাল লাগে না । এই জীবন থেকে সে মুক্তি চায় । মুত্তালিব এখন এই গ্রামের মাতবর । সজলের সামনেই, এমনকি কখনও কখনও ওকে দিয়েও কিছু অসৎ কাজ করিয়ে নেয়।কিছুদিন আগে রিলিফের টিন এসেছিল । যা মাতবর নিজের ঘরে লাগিয়েছে । কিছু দিয়েছে নিকট আত্মীয়স্বজনকে আর বন্ধুদেরকে । বাকী টিন পুকুরের পানিতে লুকায়ে রেখেছে । এসব কিছুই সজলের মনের বিরুদ্ধে করতে হয় । মাঝে মাঝে ভাবে- যে রাজাকার তার জীবন অতিষ্ট করে দিয়েছে সেই রাজাকারেরই কাজের ছেলে হয়ে সে জীবিত ,আশ্রিত থাকবে ! না এ হতে পারে না ! তাকে তার পরিবারের করুণ পরিণতির প্রতিশোধ নিতেই হবে , যেভাবেই হোক । কিন্তু কিভাবে ! অনেক চিন্তা করে সে সিদ্ধান্তে পৌছে । কড়া একশিশি বিষ সে সংগ্রহ করে রাখে কিন্তু বুড়ী দাদীর কথা মনে করে সুযোগ পেয়েও মুত্তালিবকে খাওয়াতে পারে না ।ভাবে বুড়ীর একমাত্র সন্তান মুত্তালিব , মরে গেলে বুড়ী যে অনেক কষ্ট পাবে । ঈশ্বর মুত্তালিবের বিচার করবেন ,শাস্তি দিবেন । কিন্তু সজল মুক্তি চায় এই জীবন থেকে । একদিন সে হারিয়ে যাবে , তা যেভাবেই হোক ।
-"কিরে মুখপুড়া কারে নিয়া স্বপন দেখোস ! "
-"দাদী তুমি এই রাইতের বেলা ! ঠান্ডা লাগব তো !"
-"হ বুড়ী হইয়া গেছিতো তাই না !" মিটমিট করে হাসে বুড়ী । "এই নে তর মশারিতে পট্টি লাগাই দিসি , এহন আর মশাই তরে আদর করতে পারব না ।" সজল লজ্জা পায় । এই বুড়ী সজলকে অনেক বেশি ভালবাসে ।
- "আইজগো ঠান্ডা মনে লয় একটু কম কি কস মুখপুড়া!"
-"হ দাদী ।" আনমনা হয়ে জিজ্ঞাসা করে সজল "আচ্ছা দাদী তুমি আমার মাইয়ের গপ্প কউনা ,আইজগো মাইরে খুব মনে পরতাছে ।"
হুস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বুড়ী ।
-"তর মা'ই দেখতে ছিল পরির নাহান ।মনডা ছিল আকাশের নাহান বড়। কি শীত কি ঝড় তর মায়ে আমারে না দেখলে যেন্ তার ঘুম আইত না । ঘরে যাই রান্না হইতো আমারে আর আমার মুত্তালিবরে না দিয়া খাইত না ।তর মা'য়ে আমার মুত্তালিবরে ছোড ভাইয়ের নাহান খুব আ-------- ।" বুড়ী চুপ হয়ে যায় । তার মুখে আর কোন কথা আসে না । ধরিত্রীর সব কথা যেন হঠ্যাৎ দূর আকাশের তাঁরা হয়ে গেছে । আনমনে সেই তাঁরার দিকে তাকিয়ে থাকে । ঝড়বেগে হৃদয় গহীন থেকে আবারো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ।অন্য খেয়ালে নিজের পেটে কয়েকটা চড় , ঘুষি মারে । সজল চাঁদের আলোতে দেখতে পায় দাদীর চোখে মুক্ত চিকচিক করছে । বুড়ীকে এমন করে পেটে মারতে অনেকবার দেখেছে সে ! কেন এমন করে ? জানে না সজল । বুড়ীর হাত ধরে এগিয়ে দেয় ঘরের দাওয়া পর্যন্ত ।
আজ বেশ খুশীর জোয়ার সবার মনেই। কারন জানতে সজল যায় মাতবরের খাস বন্ধু জমিলের কাছে । সেখানে সে হয় ব্যর্থ । কিন্তু তাকে যে জানতেই হবে কি এমন কথা ! যার জন্য চামচাদের নিয়ে মাতবর বৈঠক খানায় হাসাহাসি , গলাগলি করছে ! কিছুক্ষন পরিশ্রম করতেই রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হল সজল । এই গ্রামেরই মেয়ে শিউলি । সে এখন সিনেমার নায়িকা । বেশ টাকার মালিক সে । শিউলি দুইমাস আগে এসেছিল গ্রামে বাবা মায়ের কবর দেখতে আর গরীবদের খিচুড়ি খাওয়াতে । অবশ্য সজলের ছোটবেলার খেলার সাথিও ছিল এই শিউলি । কিন্তু তাতে কি ! এখন সে সজলকে চিনেনা । শিউলি গ্রামের গরীব নারী ও শিশুদের জন্য কিছু কাপড় পাঠিয়েছে মাতব্বরের কাছে । যা শুধুমাত্র গরীব নারী , শিশুদেরই প্রাপ্য । এই নিয়েই সবার আনন্দ । সজলও অনেক খুশি হয় । এটাতো সত্যিই অনেক আনন্দের । এই ঠান্ডায় মানুষগুলোর গায়ে গরম কোন কাপড় নেই ।গ্রামের শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের ঠাণ্ডায় সর্দি কাশী , শ্বাসকষ্ট , লেগেই আছে । যাক ঈশ্বর মুখ তুলে তাকিয়েছে ! সজল শিউলিকে অনেক দোয়া দেয় ।
ঐদিন রাতের বেলা মাতবর সজলকে ডাকলেন ।আসতে আসতে বললেন-
-"শুন , কাল ভোরে গ্রাম জাগনের আগেই ভ্যানে কইরা কাপর গুলা গঞ্জে আমার যে দোকান আছে, ঐখানে পৌচাইয়া দিবি । ঠিক আছে ?"
-"কিন্তু কাকা এই কাপুরতো---!" বেশ ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেও শেষ করতে পারেনা সজল । মাতবরের হাতের লাঠি এসে পড়ে পিছনে । মাতবর অগ্নিমূর্তি ধারন করেন ।
-"চুপ থাক হারামি ! আমার নুন খাস আর আমার মুখের উপ্রে কথা কস ! যা কইছি তাই হরবি ! যা কাপর গুলান ভ্যানে উডা ।"গজগজ করতে করতে অন্ধকারে মিলায় মাতবর মুত্তালিব ।
সজল বিড়বিড় করতেই থাকে । নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকে, ধিক্কার দিতে থাকে । সে এখন বুঝতে পারছে কেন রফিজ কাকা তাকে রাজাকার বলেছে । ভ্যানে সব কাপড় তুলে , সারা রাত লাল গরুটার মাথায় আদর করে আর কথা বলে । ছোট্র বেলার লাল গরুটা মারা গেলেও সজলকে নিঃসঙ্গ করে যায়নি , রেখে গেছে ছোট্ট বাছুরটিকে । সেই এখন ঠিক মায়ের মত হয়েছে । কিন্তু একি ! সজল নিজেও জানে না কেন তার অনেক কান্না পাচ্ছে ! সেতো সহজে ভেঙ্গে পড়ার মত ছেলে না । গরুটা জিভ দিয়ে আদর করে দেয় সজলের কপোলে , তাকে কিছু বলল সান্ত্বনার সুরে ! সজলের মনে হল তার হৃদয়ের কোণে কিছুটা আলোর ঝিলিক ধীরে ধীরে অমানিশার অন্ধকার সরিয়ে দিচ্ছে । মাতবরের লাঠির বাড়ীগুলো বেশ জোরে ছিল , শুতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে ।সজল একটু কাঁত হয়ে শোয় - দেখে মা তুলসী পুজা দিচ্ছে । দাওয়ায় বসে বাবা হুক্কাতে গড়গড় আওয়াজ তুলে বেশ আয়েস করে টান দেয় ।সজল লাল নীল কাগজে ঘুড়ি বানায় উঠানে বসে । প্রজাপতির মত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে চার বছরের ছোট্ট শিখারানি । আধো আধো সুরে বলে "দাদ্দা , শীত লাগে কোলে নেউ -চল রোদ পোহাই , পাটকাঠি দিয়ে কাঁচা রস খাই !" নাটাই ঘুড়ি রেখে পরম স্নেহভরে শিখারানিকে কোলে তুলে নেয় সজল । রোদ পোহাতে থাকে সে স্বর্গীয় আনন্দে । কিন্তু আজকে রোদটা এত কড়া কেন ! চোখে লাগে , ভীষণ চোখে লাগে ! চোখের উপরে হাত দেয় সজল । পিছনে বেশ জোরে কেউ লাথি মারে ।
-"ঐ হারামি এহনো ঘুমাইতেছোস নাক ডাইকা ! উঠ হালার পুত !" খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকায় সজল । দেখে মাতবর টর্চের আলো ফেলেছে চোখে ।
- "কাকা অহন তরিতো সকাল হয় নাই ..." ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে সে । রেগে যায় মাতবর -
-"উঠ পান্তা খাইয়া বাইর হ ।হালার পুত একটা কাম যদি ঠিকমত করে , খালি খাওন আর ঘুম" গজগজ করতে করতে চেয়ার নিয়ে বসে উঠানে ।
-"হ সব কাজ আপনে করেন ! আপনের ঘুমও নাই খাওনও নাই । খালি আছে পেডের বিতরে শয়তানি বুদ্ধি !" সজল আপন মনে কথাগুলো বলে আর হাতমুখ ধোয় চাপকলের ধারে । তারপর চটের চাদরটা জড়িয়ে নেয় গায়ে ।
মুত্তালিবের প্রতিদিন সকালে একগ্লাস ইসুবগুলের সরবত খাবার অভ্যাস । আজ সরবতের স্বাদ হয় অন্যরকম , যা খেতে খারাপ লাগেনা রাজাকার মাতবর মুত্তালিবের । সজল তার নির্ধারিত এক সানকী পান্তা , দুইটা কাঁচা মরিচ আর লবন প্রতিদিনের মত খেতে শুরু করে । পান্তায় হাত দিতেই মনে হল আঙ্গুল গুলি অবশ হয়ে গেছে। কোন দিকে না তাকিয়ে ,অন্যরকম এক তৃপ্তিতে গপগপ করে খাওয়া শেষ করে । তারপর দাদীকে সালাম করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ।
-"দাদী আমারে মাফ কইরা দিও " বুড়ী হাসে । বলে-
-" ক্যা রে মুখপুরা ? শশুর বারি যাইতে আসোস আর আইবি না !? " কিছুই বলে না সজল ।
সজল বহুদিন পর মায়ের গায়ের গন্ধটা পায় দাদীর গা থেকেই । চোখ মুছে নেয় বাম হাতের চেটো দিয়ে তারপর রওনা দেয় গঞ্জের দিকে । তাল গাছের পাতার ফাঁকে কুয়াশা ভেদ করে উকি দেয় সূর্য । টপটপ করে ঝরে পড়ে গাছের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির । সজল কিছু শিশির হাতে নিয়ে মেখে নেয় ফাঁটা ঠোঁটে-মুখে । তারপর তাকায় আকাশের দিকে । খুব বড় করে একটা নিশ্বাস নেয় । গায়ের জোর দিয়ে ভ্যান চালায় । রাস্তার মাঝখানে কিছু শিশু শুঁকনো পাতা জ্বেলে আগুন পোহায় । সজল বেশ ধীরে ধীরে ভ্যান থামায় । প্রতিটা শিশুর হাতে তুলে দেয় কিছু কাপড় । আবার সামনে এগিয়ে যায় গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে -"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি ........." আজ নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে । যেতে যেতে আনন্দ সুখানুভূতিতে এভাবেই সব কাপড় বিলায় গ্রামের মানুষের মাঝে । তারপর উঠে পড়ে চলন্ত মালবাহী ট্রেনে । মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ একযুগ পরে কিছুটা মুক্তির স্বাদ নিয়ে অন্যকোন মুত্তালিবের সন্ধানে এক অজানার পথে...! এবার আর গুন গুন করে নয় । কন্ঠটাকে রুদ্ধশ্বাসে আকাশের বুকে ভাসিয়ে দিয়ে গলা ছেড়ে গায়- "পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল , রক্ত লাল , রক্ত লাল........." ট্রেন ছুটে চলে দুর্বার গতিতে , গানেরই ছন্দে--- ঝিকঝিক---ঝিকঝিক---ঝিকঝিক---।
ছবি গুগুল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৯