একটা সাপ জড়াজড়ি করে দলা পাকিয়ে বসে আছে গোল গর্তের মাঝে। একটু নাড়া পেলেই ছোট্ট ফনা তুলে দেখে নিচ্ছে চারদিক। কষ্টে নীল হয়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠছে মাঝে মাঝেই। নারিকেল পাতার ফাঁক গলে ঝিকমিক করে আলো এসে পড়ছে মুখে। বহুদিন পর সূর্যটাকে দেখার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে বাতাসের কারণে! দু একটা পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে! মাথাটা এতই ভারী যে উঁচু করতে পারছি না,সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। আর সেই ব্যথাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে কারো হাতের শক্ত ছোয়া। প্রচন্ড রাগে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে "একটু শান্তিতে ঘুমাইতেও দিবি না শকুনের দল! একটু পরেই তো আবার ঢালতে শুরু করবি তোদের হেরে যাওয়ার বিষাক্ত উন্মাদনা।এখন তো একটু ঘুমাতে দে!"
খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকাতেই ধড়ফড় করে উঠে বসার বৃথা চেষ্টা করি। পেটের ভিতর কক করে ব্যথা করে ওঠে "গর্তে না কালসাপ পেটের মধ্যে দলা পাকাচ্ছে!" যেমন ছিলাম ঠিক তেমনভাবেই শুয়ে থাকি..। আধো আলো অন্ধকারে দেখতে পাই দশ এগারো বছরের একটা মেয়ে পাশেই পড়ে থাকা রডটা দিয়ে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছে! যে রডটাতে এখনো শুষ্ক রক্ত লেগে আছে। কাল মুক্তিসেনারা মনে হয় কোন এলাকা জয় করেছে। আর সেই জয়ের বদলে হাত পা মুখ বেঁধে তিনজনে ধরে এই রডটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছিল এক মুক্তিযোদ্ধা নারীকে! তারপর...লবন দিয়ে লেপন করেছিল ক্ষত জায়গাটা! ঐ যে একটু দুরেই অসাড় দেহটা পড়ে আছে! তাঁর পায়ের কাছেই অপরিপূর্ণ কালসাপটা নাড়ি ভুড়িসহ লেপ্টে আছে স্থীর হয়ে। অত্যাচার সহ্য করে দেখে যাই এ ভয়াল,বীভৎস দৃশ্য!
"কিন্তু এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এখানে কেন?" উলঙ্গ শরীরে শীতের কাঁপন লাগে। লজ্জায় হাঁটু দিয়ে বুক ঢেকে নেই! এই টুকুন ছোট্ট শিশুটিরও পাষণ্ডের ভোগের লালশা থেকে মুক্তি নেই? আহা রে কোন মায়ের বুক খালি করে ছিনিয়ে এনেছে কে জানে? এবার কোথা থেকে যে শক্তি এসে বাঁকা শরীরে ভর করেছে নিজেও জানিনা। উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ছোট্ট মেয়েটাকে হাত ধরে কাছে টানলাম। ভয় আর আতঙ্কে মেয়েটা চিকন পাতার মত থিরথির করে কাঁপছে! হু হু করে মনের ঘরে জল মাখা অশান্ত বাতাস বয়ে যায়। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এদিক ওদিক তাকিয়ে পথ খোঁজে পাথর দুটি চোখ। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমি জানি,একটা শব্দও বের হবেনা মুখ থেকে। কী ভয়াবহ পৈশাচিক খেলায় দানবের দল এই কচি শিশুটাকে গিলে খেতে যাচ্ছে, তা ভেবে শিউরে উঠি। আজ চার মাস ধরে কী অসহনীয় অত্যাচার সয়ে যাচ্ছি তা কেবল আমিই জানি।
মনে পড়ে,এইতো সেদিনের কথা। শহর থেকে ফিরে গ্রামে এসেই বাবাকে যখন বলি মুক্তিসেনাদের সাথে যুদ্ধে যাব। তখনই বাবা সরাসরি কিছু না বলে সেই রাতেই বিয়ে ঠিক করে বন্ধুর ছেলের সাথে। ভাবখানা বিয়ে দিলেই আমাকে বেঁধে রাখা যাবে! ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাই মুক্তিসেনাদের ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে হলের দু একজনের সাথে দেখা হয়। একটা আপন পরিবেশ আরো সাহস বাড়িয়ে দেয় শকুনের জান পায়ের তলায় পিষ্ট করার বাসনা। প্রথম অপারেশনটা আমি আর রানী মিলে করি। আমরা দুজনে নাট্যদলের অভিনেত্রী সেজে ভ্যানে করে ব্রিজের ওপারে যাই। সেখানে অপেক্ষা করে ছিল দু’জন মুক্তিসেনা। আমরা দু’জন নিজেদের বুকের মাঝে,কোমরে এবং উরুতে বেঁধে টাইম বোমা ও গ্রেনেড নিয়ে যাই। পথিমধ্যে অসুরের দল আমাদেরকে চেকিং এর জন্য থামায়। শত্রুরা আমাদের সাজসজ্জা দেখে বেশ মজা পায়। ভ্যান আটকিয়ে কোন চেকিং না করেই আমাদের সাথে কথা বলতে থাকে তারা। ধরা পড়লে কী হতে পারে তা ভেবে দুরু দুরু বুক কাঁপে। কিন্তু এই যুদ্ধ সরঞ্জাম যেভাবেই হোক পৌঁছে দেবার দায়িত্বটা যে পালন করতেই হবে। এই ভাবনায় আমরাও আধো উর্দুতে কথা বলি ওদের সাথে। মনে মনে বলি "এইটা আমাদের ভাষা না,তোদের ভাষায় তোদেরকেই বোকা বানাই! স্বাধীনতার জন্য আমাদেরকে বাঁচতেই হবে বেঁচে থাকাটাই এখন জরুরী। মোক্ষম উত্তরটা তো দেব বিজয় এনে! " কথাটা ভেবে অন্যরকম এক অনুভুতি খেলে যায় মনে। সাহস বেড়ে যায় শতগুণ-
-কিধার যা রাহে হো জানেমান ?
-সাব জি হামলোগ যাত্রা কারতা হে, মে রুপবান অর ও পারুল হে, হাম লোগোকো ছোড় দো না সাব
-ঠিক হ্যায়, ছোড়ুঙ্গী। পহলে বলো রাত মে এধার আয়ো গে? হামলোগো কো রুপবান দেখনা হে
কথাটা বলে চোখ টিপি দিয়ে গোঁফে হাত বুলিয়ে বিজ্ঞের মত ভাব করে। আর তা দেখে হো হো করে সবাই হেসে দেয়। যা দেখে মনে হয় এখানেই গ্রেনেড মেরে সব কটাকে উড়িয়ে দেই। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখে হেসে হেসে বলি
-ঠিক হে সাবজি আয়ুঙ্গি ওর রূপবান ভি দেখাউঙ্গি
চুরুটের গন্ধ মাখা হাতে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় শকুনটা। ভয়ে শিউরে উঠি যদি হাতটা নীচে নামায় এই ভেবে। খপ করে হাতটা ধরে সরিয়ে দিয়ে ভেংচি কাঁটি -
- ইতনা ভি ক্যা জলদি হে সাব? ধিরেজ রাক্ষ মজা লুটো...! মনে হল কথায় বেশ কাজ হয়েছে। তর সয়ছে না যেন
- জলদি আও গে ঠিক হে
-ঠিক হে সাব আয়ুঙ্গি ওর সাথ মে রোষ্ট করনে কে লিয়ে মোরগা ভী লে আয়ুঙ্গি
- ক্যা মোরগা? ক্যা বাত হে...? ঠিক হে নিকলো নিকলো,বহুত ফাস্ট নিকলো
লোভে চকচক করে অসুরের দু’চোখ! জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে যেন মাংসের স্বাদ নেয়...! এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ভ্যানে টান দেয় চালক মুক্তিসেনা। একটু দূরে গিয়েই খিস্তি দেয় মনের ঝাল মিটিয়ে। তারপর সরঞ্জাম পৌছে দিয়ে এবার আমরা কৃষক বঁধু সেজে নদী থেকে শাপলা নিয়ে অন্যপথে ফিরে যাই ক্যাম্পে। ঐ রাত্রেই টাইম বোম পুতে রাখা হয় নির্দিষ্ট জায়গায়। তারপর অপেক্ষায় থাকে মুক্তিসেনারা...।
পরেরদিন যখন পাকসেনাদের অস্ত্র সম্ভার নিয়ে সারি সারি গাড়ি ও সেনাদল বড় ব্রিজটা পার হতে থাকে; আচমকা বিকট শব্দে উড়ে যায় ব্রিজ ও সেনা বহরসহ সব অস্ত্র! "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি...!" সুরে সুরে কাঁধে কাঁধ রেখে সবাই মিলে আনন্দের বন্যা বইয়ে ছিলাম সেদিন মুক্তিসেনা ক্যাম্পে। চারিদিকে মুক্তিসেনাদের সাথে সাথে যোগ হয় রানী আর নন্দিনীর কৃতিত্বের কলরব! সাহস বেড়ে যায় আরো একধাপ। ছেলেবেলায় চৌধুরীদের বাড়ির জংলি হিংস্র কুকুরের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শিউলী কুঁড়িয়ে মালা গেঁথে প্রিয়জনকে দেবার সুখ কেমন তা আমি জানি। ঠিক তেমনই শত্রুকে পরাজিত করে বিজয়ের আনন্দের স্বাদ কী যে মধুর,তা অনুভূত হয় সেদিনই প্রথম। কিন্তু সে আনন্দ ঝরে পড়ে শুকনো পাতার মত। পরের অপারেশনে এভাবেই দানবের চক্ষু ফাঁকি দিয়ে যাবার কালে ধরা পড়ি দু’জনেই। সাথে আরো দু’জন মুক্তিসেনা। তাঁদেরকে ওখানেই গুলি করে মেরে ফেলে আর আমাদের দু’জনকে তুলে নিয়ে আদিম উন্মাদনায় প্রতিদিন পালাক্রমে চলে অত্যাচার। ক্যাম্পের ঠিকানা ও মুক্তিসেনাদের নাম জানতে প্রতিনিয়ত চলে বেদনার সমুদ্র মন্থন!
মুক্তিসেনাদের কাছে পরাজিত হবার দিন যত ঘনিয়ে আসে,ততই বাড়ে নিত্যনতুন পন্থায় পশুদের খাবলে খাবার প্রবল উত্তেজনা। এক একজন করে বেশ কয়েকজন মিলে বিষের ছোবলে রক্তাক্ত করে পুর্ণিমার আলো... ! যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে স্বর্ণ ভ্রমর। বিকৃত অট্টহাসি আর বোতলের ঠুনঠান শব্দ...তারপর চরম তৃপ্তি নিয়ে স্বর্ণ ভ্রমরা ভিজিয়ে দিয়ে খালি করে বোতল। " আহ.... সে কী অসহনীয় যন্ত্রণার বিভীষিকাময় মুহুর্ত!"ঘৃণিত অঙ্গীকারে দাঁতে দাঁত পিষে মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত....! আগ্নেয়গিরির লাভা ধীর গতিতে চলে- জ্বালিয়ে,পুড়িয়ে বেয়ে নামে ঢালু সে পথ। কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে অবশ করে দেয় নিজেদের সব অনুভুতি! পশুদের শক্তি যখন ঝিমিয়ে পড়ে তখনও মরা টিকটিকির লেজুরের মত থিরথির কাপুনীতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বেয়নেটের আঘাতে নিংড়ে নেয় দানবীয় তৃপ্তি ! বুকের কুন্দ জুড়ে জ্বলন্ত সিগারের ছোয়ায় আদিম খেলার সুখটুকু নেয় অলিগলি চিনে...। সীমাহীন বেদনায় নিঝুম দুপুরে,জ্বলন্ত আগুনের ফুল্কি ঝরে শিরা উপশিরায়। ধীরে ধীরে ধৈর্যের বাঁধন ভেঙ্গে অচেতন হয় শ্বেত ময়ূরী।
প্রতিদিন নতুন সূর্যকে দেখার অদম্য ইচ্ছা বাঁচার শেষ নিঃশ্বাসটুকু,ফুসফুসের মাঝে বন্দী করে রাখে! বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত নতুন আশার সঞ্চার করে ঝলমলে রোদ। কচি পাখিটা কী সইতে পারবে এ যন্ত্রণা...? রাতের গভীরে যখন অন্ধকার ভেদ করে ভয়ার্ত আলো জ্বালে কামান! যখন নিরস্ত্র নিরহ মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে সেই আগুনে ঝলসে নেয় ছোট্ট শিশুটাকে! যখন মায়ের বুকে মাথা রেখে নিরাপত্তা খোঁজে শিশু পরম মমতায়! ঠিক তখন পাখিটাকে বধে শিকারীর দল! ছোট্ট পাখিটা বিবস্ত্র নিথর দেহে পড়ে থাকে মেঝেতে ! তবুও থামেনা উল্লাস পিশাচের। নিরুপায় হয়ে ঝুলন্ত বাদুড়েরা ডানা ঝাপটায় আঁধারে ঢাকা ছোট্ট কামরায়! জ্বলন্ত শিখায় জ্বলে পুড়ে করুণাময়ের কাছে মরণ ভিক্ষা চায় দুহাত তুলে...।
ভোরের আলোর ঝিকিমিকি দ্যুতি চেনা সুর এনে দেয়। খুব কষ্টে জানালায় চোখ রাখি...। দুলে উঠে মন আলোয় আলোয়। পাল তুলে যায় নৌকা গলা ছেড়ে মাঝি গায় গান। "ও মাঝি..! আমারে নিয়ে যাও গো মাঝি, বাঁচাও এ প্রাণ" গান থেমে যায় এক মুহুর্ত! মাঝি ফিরে তাকায় নেটে ঘেরা জানালায়। মনে মনে বলা কথাগুলো কেমন করে এই এতদূর থেকেও পৌছে দিল বাতাস? পাখিটা তখনো প্রাণহীন পড়ে আছে রক্তভেজা মেঝেতে! মাছি বসে আদর করে দেয় ক্ষত-বিক্ষত দু’ঠোঁটে...।
দিনশেষে নামে ঘোর অন্ধকার। মধ্যরাতে চারিদিকে দামামা বাজে নামে বৈশাখী ঝড়। আজ ঝড়ের আঘাতে ধ্বংস হবে সব। থেমে যাবে আজ পিশাচের কলরব! মুক্তিসেনা ছাড়ে হুঙ্কার গর্জে উঠে চেনা সবুজ গ্রাম। শেষ জয়টাও ছিনিয়ে নেয় বীরসেনানী দল! আজ প্রত্যাশিত বিজয়ের দিন...! আকাশের বুক চিরে সূর্য উঠে আনে আলোকিত ভোর। দেয়ালে পিঠ রেখে অপেক্ষায় থাকি একমুঠো আলো এসে আমায় আলোকিত করবে ভেবে...। লাল সবুজের পতাকা উড়ার শব্দ আমার মন ভরিয়ে দেয়। "জয় বাংলা" ধ্বনিতে মুখোরিত হয় চারিদিক...। ধীরে ধীরে আমি বের হয়ে আসি গহীন বনের পথ বেয়ে..। "যুদ্ধ শেষ আমরা স্বাধীন" সবার মুখে মুখে জয়ধ্বনি! কেউ ফিরেও দেখেনা আমাকে ! আমি নির্বাক,স্রোতহীন নিশ্চল...। যে আমি নতুন সুর্যকে দু'হাতের মুঠোয় নিয়ে মুক্তির স্বাদ পেতে চেয়েছি! সেই আমি কী এক অজানা আশঙ্কায় নিজেকে গুটিঁয়ে ছুটে যাই উল্টো পথে..। যখন সবাই জানতে চায়বে কীভাবে আমি বলব যন্ত্রণার মলাটে রক্তাক্ত বীর নারীর সহন গাঁথা! কীভাবে বুঝাব কেমন করে ছোট্ট পাখিটাকে বধেছিল শিকারির দল? যদি মুক্তির আনন্দে কোন কালে নীভে যায় জ্বলন্ত আগুন শত্রুর ছলনায়! যদি সবাই ধিক্কার করে আমায়,আমার এই সোনার বাংলায়! তা আমি সইতে পারবনা....। এই ভাল,সে সব কিছুই থেকে যাক আড়ালে...ডুকরে কাঁদুক প্রতিনিয়ত বন্দী চার দেয়ালে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:০২