ভাল মুসলিম বা সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম বলে যাদেরকে অভিহিত করা হয়, তাদের সকলেরই হয়ত জানা আছে যে, নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিজের আশেপাশে অবস্থানরত অন্যান্য মানুষদের মধ্যে আল্লাহর দীনকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। এ জন্য মুমিনের জীবনের একটি বড় দায়িত্ব হলো -আল আমরু বিল মারুফ অয়ান নাহ্ইউ আনিল মুনকার- অর্থাৎ ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা।
প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন:
“তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত”। (সূরা আলে ইমরান: ১১৪, অর্থানুবাদ)
সহীহ মুসলিমে এসেছে: “তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে তা, সে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, তাও যদি না করতে পারে, তাহলে অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করবে। আর এ হচ্ছে (অন্তর দিয়ে ঘৃনা করা) দুর্বলতম ঈমান”।
উপরোক্ত হাদীস অনুসারে বিচার করলে দেখা যায়, আমাদের সমাজে এখন সুন্নাহ পালনকারী বিরল মুসলিমদের গতানুগতিক অবস্হানও যেন ঈমানের সর্বনিম্ন স্তরে। যেমন -
সমাজে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য অনাচারগুলো (আল্লাহর দেয়া বিধানের সীমালঙ্ঘন) দেখে কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঈমানের প্রথম দুই স্তর পরিত্যাগ করে, ৩য় বা দুর্বলতম স্তরে অবস্হান করাটাকেই নিজেদের জন্য পছন্দ করি অর্থাৎ অনাচারগুলোকে শুধুমাত্র ঘৃনা করাকেই নিজেদের যথপযুক্ত বা সর্বোচ্চ দ্বায়িত্ব বলে মনে করি। এ ব্যাপারে সহায়তা পাওয়ার জন্য যে শব্দটির যথেচ্ছা অপব্যবহার হয়, তা হলো “হিকমাহ”। আর তাইতো বাংলাভাষী মুসলিমদের অনেকেই হিকমাহ বলতে বোঝে “গোপন করা”। মুস্তাহাব সুন্নাহর ইখতিলাফি মাসআলাগুলোর গবেষনায় বা পারিবারিক কমফোর্টের endless মিশনে অথবা প্রচুর্যতা অর্জনের মুষিক দৌড়ে বেশ ব্যাস্ত থাকার কারনে, সমাজের এ অনাচারগুলো (আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন) নিয়ে ভাববার খুব একটা সময় পান না, সুন্নাহর অনুসারী ভাল মুসলিমদের অধিকাংশই। কিন্তু তাই বলে তাদের সবাইকে দ্বীনের ব্যাপারে inactive বললেও ভুল হবে, কারন অসৎ কাজে নিষধ করতে যাওয়া মুসলিম ভাইদের বিনয়ের বিচ্যুতি কতখানি ঘটল তা নিয়ে তারা যথেষ্ঠ active। আর এরই সুযোগে অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেয় ‘থাবা বাবা’রা।
কিন্তু এ পরের অধ্যায়টা আরও বেশি মর্মান্তিক। কারন উপরোক্ত সহীহ হাদীসটি বলে দিচ্ছে ঈমানের সর্বনিন্ম (দুর্বলতম) স্তরে থাকতে গেলে মুসলিমদের যে কাজটি করার কথা ছিল তা হলো অন্তত পক্ষ এসব অনাচারগুলিকে ঘৃনা করা। স্বভাবতই যার প্রকাশ হওয়ার কথা এ অনাচার কেন্দ্রিক যাবতীয় কর্মকান্ডকে প্রত্যাখ্যান করা এবং যেকোন ধরনের সহযোগিতা করা থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু এই অনাচার গুলির প্রসাদ ভক্ষণ/টিভিতে দর্শন/এগুলির আলোচানা উপভোগ করা/সামঞ্জস্যপুর্ণ কর্মকান্ড পালন অথবা কেনাকাটা করে এগুলির পালে হাওয়া লাগানো- কোনটিই কি এসব অনাচারগুলিকে ঘৃনা করার পর্যায়ে পড়ে? এখন বলুন তো এই যে নববর্ষ, valentines day, বিশ্বকাপ, অমুক প্রিমিয়ার লিগ, birthday পালন সহ যাবতীয় অনাচার (সীমালঙ্ঘন) কেন্দ্রিক গড্ডালিক প্রবাহে গা ভাসানো আমাদের সমাজের আপাত ভাল মুসলিমদের ঈমানের স্তর কোনটি?
সবার উপর আল্লাহর গজব ও শাস্তি
পবিত্র কুরআনে সূরা আ'রাফের ১৬৩-১৬৫ নম্বর আয়াতে - বনি ইসরাইলের লোকজনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১- যারা প্রকাশ্যে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছিল। ২- যারা এ অনাচার দেখে মানুষকে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছিল। ৩- যারা নিজেরা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করতো না, কিন্তু এসব অনাচার দেখেও নীরব থাকতো। পরে যখন আল্লাহর গজব আসল তখন ওই তিন শ্রেণীর মধ্যে কেবল এক শ্রেণীই আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিল। আর তারা হলো ওই শ্রেণীর লোক, যারা অসৎ কাজের নিষেধ করেছিল।* [আয়াতগুলি পড়ৃন এখানেঃ http://quran.com/7/163-165]
সূরা মায়িদার ৭৮-৭৯ আয়াতে ও সূরা হূদ-এর ১১৬ আয়াতেও অনুরূপ কথা বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
“যখন মানুষেরা অন্যায় দেখেও তা পরিবর্তন বা সংশোধন করবে না তখন যে কোন মুহূর্তে আল্লাহর শাস্তি তাদের সবাইকে গ্রাস করবে”। (তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ। সনদ সহিহ)*
“কোনো সমাজের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি অবস্থান করে সেখানে অন্যায় পাপে লিপ্ত থাকে এবং সে সমাজের মানুষেরা তার সংশোধন-পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা না করে, তবে তাদের মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহর আজাব তাদেরকে গ্রাস করবে”। (আবু দাউদ, হাদিসটি হাসান)।*
“যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! তোমরা অবশ্যই কল্যাণের আদেশ করবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে, তা না হলে আল্লাহ অচিরেই তোমাদের সবার উপর তাঁর গজব ও শাস্তি পাঠাবেন, তারপর তোমরা আল্লাহকে ডাকবে, কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেওয়া হবে না বা তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে না[/si]”। (তিরমিজি, হাসান সূত্রে)*
এখন বলুন আল্লাহর গজব থেকে নিজেদের এবং পরিবারকে রহ্মার জন্য যথেষ্ঠ প্রস্তুতি কি আমাদের আছে?
কর্মের হ্মেত্রে কুশলী-ততপর কিন্তু দ্বীনের জন্য নিষ্ক্রিয়ঃ
ব্যাবসা বা অফিসের টার্গেট বা KPI অর্জনের জন্য আমরা “negotiation skill”, “stakeholder management skill”, “communication skill”, “time management skill”, “IT skills”, “creativity/innovation skills” সহ আরও কত skill এর সাথে সময়-সম্পদ-শ্রম-মেধার কি অপুর্ব সন্নিবেশই না ঘটিয়ে থাকি। কিন্তু দ্বীনের কোন ব্যাপার আসলেই কেন যেন আমরা নিস্ক্রিয় হয়ে যাই অথবা ব্যাস্ততার/ঝামেলার অযুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। আমাদের জীবনের সময়ের খাতগুলো ms-excel এ প্লট করলে খুব সহজেই প্রতিয়মান হবে – আমাদের উপার্জনটা ঠিক জীবনের জন্য নয়, বরং উপার্জনের জন্যই বোধহয় আমাদের জীবন। যদিও পবিত্র কুরআনে(৫১:৫৬) বর্ণিত মানুষকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যের আয়াতটি আমাদের সকলেরই মুখস্থ।
অথচ হাশরে হতে চলা আমাদের পরীহ্মার যে প্রশ্নগুলি ফাঁস করে দেয়া হয়েছে, তাতে প্রকৃতঅর্থে যে আমাদের সময়-সম্পদ-শ্রম-মেধারই হিসাব দিতে হবে তা বুঝতেও হয়ত ভাল মুসলিমদের একটুও কষ্ট হয়না। কিন্তু শুধুমাত্র ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হওয়া এই আমরা যখন আমাদের সময়-সম্পদ-শ্রম-মেধার উচ্ছিষ্টাংশকেই কেবল দ্বীনের জন্য বরাদ্দ করি তখন পরীহ্মার ভয়াবহ ফলাফলের জন্য অপেহ্মা ছাড়া আমাদের আর কি করার থাকতে পারে? [৫টি প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত শুনুন শায়খ সাইফুদ্দিন বেলাল মাদানির লেকচারে -https://youtu.be/Cx2QTUM_nQo]
এই যুগে আমাদের পহ্মে কি কিছু করা সম্ভবঃ
সব কিছুই আমাদের জন্য অসম্ভব এ কথাটি একদম ঠিক নয়, আবার চরমপন্থা বা চরম উদাসিনতা কোনটিই ভাল মুসলিমদের কাছে কাম্য নয়। একটি বাস্তব ঘটানার উদাহরন দেখা যাক-
“একদিন আছরের সলাত শেষে মাসজিদ থেকে বের হয়ে দেখলাম কোন এক বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে কিছু স্কুলে পড়ৃয়া ছেলে রাস্তার পাশে, একটি টেবিলের উপর লটারী জাতীয় একটি জুয়ার পশরা সাজিয়ে ব্যাবসা করছে। আর অসংখ্য কচি কচি মস্তিস্ক, সমাজের সাথে মানানসই এ জুয়ার সাথে অভ্যস্ত হচ্ছে। মসজিদ থেকে বের হওয়া শতশত মুসলিমদের অধিকাংশই পাশ দিয়ে গেলেন, কিন্তু কেউই কিছুই বললেন না। তাই নবীনদের জুয়াও চলছে বেশ খুশির আমেজে। ঐ এলাকায় একদম নতুন হওয়ায়, আমার জন্য ফলপ্রসু কিছু একটা করা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু বিনা চেষ্টায় ছেড়ে দিতেও বিবেক বাধা দিল। কাজ হবে না জেনেও, বেশ উগ্র পোশাকের ঐ আসরের প্রধান ছেলেটিকে একটু সাহস করেই ডেকে নিলাম। এরপর জুয়া সম্পর্কীত ইসলামের বিধান এবং তার ভবিষ্যত জীবনে এর প্রভাব, সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে দুরে চলে আসলাম। কিন্তু বাসায় প্রবেশের পুর্বে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ছেলেগুলি একটু পরেই জুয়ার পশরা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। এরপর যতবার ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হত, সে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে আমাকে সালাম দিত এবং আমিও হাসিমুখে তার জবাব দিতাম। যতদিন ঐ এলাকায় ছিলাম আর কোনদিন ওদেরকে জুয়ার পশরা নিয়ে বসতে দেখিনি”।
শেষ কথা
সমাজের এই যে এত দুর্ভোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, জfলিমের আধিক্য- এসব কি আমাদের হাতের কামাই নয়? এগুলি যদি আল্লাহর পহ্ম থেকে এসে থাকা গজব হয়ে থাকে, অথবা আরও বড় কোন গজব যদি আসার উপক্রম হয়ে থাকে, তাহলে comfort zone এ থাকা আমাদের সমাজের ভাল মুসলিমদেরও কি এর দায়ভার বহন করতে হবে না? অথবা দ্বায়িত্বে অবহেলা করে মুসলিমরাও কি এই গজব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?
চাকুরী বা ব্যাবসার হ্মেত্রে আমরা শ্লোগাত তুলি, “Never give up” তাহলে দ্বীনের হ্মেত্রে ছেড়ে দিব কেন? উপার্জনের জন্য অর্জন করা আমাদের skill গুলো কেন শুধুমাত্র ভোগাবাদীদের tool হিসাবেই ব্যবহৃত হবে?
আসুন দুনিয়ার comfort zone থেকে বের হয়ে আখিরাতের comfort টাকে নিশ্চিত করি। এবং আল্লাহর গজব থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে রহ্মার জন্য চেষ্টা করি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের ব্যাপারে সত্যিকার অর্থে সচেষ্ট হওয়ার তাওফীক দান করুন।
পাদটিকাঃ
**********************************.
*হাদীস গুলির অনুবাদ এবং তাহক্কীকের জন্য ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’ বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
(পোষ্টটি শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নাহ তে বিশ্বাসী মুসলিমদের জন্য)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৫৩