somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শব্দের পোস্টমর্টেম - ২০৭ (লাট )

১৫ ই এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সংস্কৃত লট্ট থেকেও বাংলায় লাট শব্দটি এসেছে। মূলে সংস্কৃত লট্ট অর্থ নষ্ট স্বভাব, দুর্জন। এ কারণে নষ্ট, দুষ্ট, গর্বিত, অহংকৃত, দাম্ভিক অর্থেও লাট শব্দটি প্রচলিত।

আবার বাংলায় লাট শব্দটি রঙ্গ তামাশা বা ব্যঙ্গচ্ছলে ইয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয় ( কি লাট! খবর কি?)। প্রভু বা সর্বময় কর্তা অর্থেও লাট শব্দের প্রয়োগ রয়েছে (ভারি আমার লাট এসেছেন)।

সংস্কৃতেও লাট শব্দটি রয়েছে। আর সংস্কৃ ত 'লাট' অর্থ দক্ষিণ গুজরাটের প্রাচীন নাম, পণ্ডিত, রসজ্ঞ, জীর্ণ বস্ত্রাদি।

ইংরেজি lot শব্দ থেকেও বাংলায় লাট শব্দটি এসেছে। এ লাট মানে নিলামে একসঙ্গে বিক্রেয় দ্রব্য সমষ্টি, জমিদারির অংশ, নির্দিষ্ট দিনে দেয় খাজনা।

আবার ইংরেজি lord থেকেও বাংলায় লাট শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। এই লাট মানে গভর্নর রাজ্যপাল বা তার সমমানের পদস্থ কোনো কর্মকর্তা।

সংস্কৃত 'যষ্টি' থেকেও লাঠি অর্থে বাংলায় 'লাট' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস শব্দটির বিবর্তন দেখিয়েছেন এভাবে ষষ্টি> ষাট > লাট।

ব্রিটিশ শাসনামলে লাট বলতে জমিদারির এমন অংশ বিশেষ বুঝাতো যা বকেয়া খাজানার দায়ে কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্য নিলামে বেচে দিতেন। সহজে নিলামযোগ্য হবার কারণে অধিক লাভের আশায় ইংরেজ সরকার নতুন অধিকৃত বা আবাদকৃত বিস্তৃত ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগ বা লাট তৈরি করতো। এ লাটের নিলাম ক্রেতাকে লাটদার বা লাট খরিদ্দার বলা হতো। বাংলাদেশের খুলনা ও যশোর অঞ্চলে লাটদারের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা ছিলেন মূলত নিম্ন শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী।

আবার দেশি শব্দ লাট মানে পাট ভাঙা বা এলোমেলো (জামাটি একেবারে লাট হয়ে গেছে), ধরাশায়ী (চোরটিকে মেরে লাট বানানো হয়েছে)। ক্রিয়াপদেও লাট শব্দের ব্যবহার আছে। লাট খাওয়া মানে উড্ডীয়মান বস্তুর উল্টোমুখো হয়ে নিচে পড়া বা পতনোল্ন্মুখ হওয়া (ঘুড়িটি দর্শনীয়ভাবে লাট খাচ্ছে)।

অন্যদিকে হিন্দি লাঠ্ থেকে বাংলায় আগত লাট শব্দের ব্যবহার এখন বিরল। এ লাটের অর্থ স্তম্ভ (ভারতের নানা প্রান্তে অশোক লাটের অস্তিত্ব রয়েছে)। সংস্কৃতে গুজরাটের প্রাচীন নাম হচ্ছে লাট।

তবে ইংলিশ ভাষাভাষীরা লাট শব্দটির অধঃপতন দেখে কেঁদেও দিতে পারেন। সোসিও-সাইকোলজিকাল কারণে লাট শব্দটি শেষ পর্যন্ত অবজ্ঞা আর গালির পর্যায়ে চলে গেছে। ‘হুকুম দেখ না, যেন লাট সাহেব’, ‘কোথাকার লাটবাহাদুর’, ‘ভারি আমার লাট সাহেব’, ‘আর লাটগিরি দেখাতে হবে না’, ‘কত্তো লাটবেলাট দেখলাম’, ‘তুমি আমার লাটের বাঁট’ - ইত্যাকার শ্লেষগুলো কিন্তু ঔপনিবেশিক ইংরেজদের প্রতি আমাদের ঘৃণা থেকেই তৈরি হয়েছে। সেই থেকে বাংলায় লাটকে আর জাতে তোলা সম্ভব হয়নি (পোড়ো জমি চষে শেষে স্বত্ব জমে লাট কি বেলাট/সে সন্ন্যাস তবে ছদ্মবেশ - জীবননান্দ দাশ)। কারণ বাংলায় প্রচলিত এই 'লাট' শব্দটি এসেছে ইংরেজি lord শব্দ থেকে।

বাংলায় এখন ব্যগ্ঙ্গার্থে মষ্ট বড় লোক আর অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি বোঝাতে আমরা লাটের ঘাড়ে চাপি।

ইংরেজি লর্ড শব্দটি বাংলায় প্রথম 'লার্ড' হিসেবে ঢোকে আর নেটিভদের কল্যাণে তা শেষ পর্যন্ত লার্ডের আরেক দফা অধপতনের পর তা লাট হয়ে যায়।

বৃটিশ শাসনামলে ভারতের সব গভর্নর জেলারেলই লর্ড ছিলেন। লেফটেনেন্ট গভর্নর আর জেনারেলদের অনেকেও লর্ড ছিলেন। এ গর্ভনর জেনারেলই পরে হয়ে যান বড়লাট, লেফটেনেন্ট গভর্নর হন ছোটলাট আর জেনারেল হয়ে যান জঙ্গিলাট। এরা ছাড়া আর কারো পক্ষে লাট হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ লাট হতে হলে কমপক্ষে জাতে ইংরেজ হবার শর্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের শাসনামলেই বাঙালি সমাজে কত্তো তালবেতালের লাট জন্ম নেয় এবং তারা সবাই ব্যগ্ঙ্গার্থে লাট হয়েছেন। ইংরেজদের দুঃখতো এখানেই। কারণ তাদের শাসনামলেই তাদেরকে লর্ড শব্দের অধঃপতন দেখে ও শুনে যেতে হয়েছে।

তবে লাট আর লাটে ওঠা কিন্তু এক জিনিস নয়। কারণ লাটে ওঠা মানে নিলামে একসঙ্গে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া বা লটারির মাধ্যমে নিলামে ওঠা। লাটগিরি দেখাতে গিয়ে ইংরেজ আমলে অনেক জমিদারের জমিদারি লাটে উঠেছিল। এই লাট শব্দটি কিন্তু ইংরেজি লর্ড থেকে আসেনি। এসেছে ইংরেজি লট (lot) থেকে। লট মানে সব, গুচ্ছ, স্তূপ ইত্যাদি। এই অর্থে খাজনার দায়ে লাটবন্দি করে জমিদারি বিক্রির জন্য লাটে তোলা হতো।

এখন জমিদারি আর নেই। কিন্তু লাটে ওঠা বন্ধ হয়নি। কারণ জমিদারির পরিবর্তে এখন ব্যবসা বাণিজ্য লাটে ওঠে। আর বর্তমানে লাটে ওঠার অর্থ হচ্ছে বারোটা বাজা বা বাজানো।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×