সর্ষে অতি ক্ষুদ্র আকটি শস্য। এ শস্যটিকে আমরা সরিষা নামেও চিনি। আমাদের দেশে ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের অনেক কদর রয়েছে। আগে গ্রাম এলাকায় ঘানি দেখা যেতো। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে প্রায় জাদুঘরে স্থান পাওয়ার মতো অবস্থা ঘানি নামক যন্ত্রটির। খাঁটি সরিষার তেল বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো যতোই বলুক- আমাদের পণ্যটি ঘানি থেকে আসা। আমার মনে হয় তারা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। বাজারে সয়াবিন এবং পামঅয়েলের দৌরাত্ম্যের কারণেই আজ বাংলার ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল বিলুপ্ত প্রায়। গ্রামবাংলায় যেমন নেই গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ। তেমনি খাঁটি সরিষার তেলও হারিয়ে ফেলেছে তার অতীত ঐতিহ্য। অতিরিক্ত ঝাঁঝালো হবার কারণে রসনাবিলাসে সরিষা বাটা, সরিষার তেল ব্যবহার হতো। আজকের বিপনণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারজাত করা সরিষার তেলে সেই ঝাঁঝ নেই।
এবার মূল কথায় আসা যাক। বাংলাদেশের রাজনীতীজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংবাদজীবী সম্প্রদায় কথায় কথায় বলেন- সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে। এ প্রবাদ বাক্যটি ছাড়া তাদের মিডিয়াবাজী বলে মনে হয় কিছুই থাকতো না। নতুন কোনো বিতর্কের সূচনা না করে আমার প্রশ্ন- সর্ষের ভেতর ভূত থাকে ক্যামনে?
মানুষ যে স্বার্থান্বেষী তা অনেক আগেই পরীক্ষিত। স্বার্থ শব্দটির নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দুই দিকই বিদ্যমান। যদিও নেতিবাচক দিকটিই বহুল ব্যবহৃত। আমরা বারবার গুলিয়ে ফেলি এই বলে যে, অমুকের সাথে অমুকের সম্পর্ক অমুক স্বার্থে। যদি সেটা খারাপ কিছুর জন্য হয় তাহলে বলাটা ঠিক আছে। কিন্তু যদি সেটা ভালোর জন্য হয় সেটাও নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত করা হয়। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে সামাজিকভাবে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য। সমাজের নিয়ম নীতি মেনে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার অসাধারণ ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। ইতিবাচক স্বার্থের বিষয়ে বলা যায়- আমরা পাড়া প্রতিবেশির সাথে মিলেমিশে থাকি কেন? এটার ভেতর নিশ্চয় কোনো স্বার্থ বিদ্যমান। স্বার্থটা কি? সমাজে শান্তি বজায় রাখা। সামাজিকভাবে ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তাই নয় কি? তবে, নেতিবাচক স্বার্থ হাসিল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার খুব প্রয়োজন ইতিবাচক স্বার্থের প্রয়োজনে।
কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে বেশ জোরে শোরে। এটি একটি সরিষার তেল বিপনণ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের সারমর্ম দাঁড়িয়েছে- একজন ওঝা ভূতে ধরা মহিলার নাকে সাধারণ সরিষার তেল ছড়িয়ে দেয় এই আশা নিয়ে যেন সরিষার তেলের ঝাঁঝে ভূত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু সরিষার তেলে ঝাঁঝ না থাকায় ভূত ওঝার গালে বসিয়ে দেয় থাপ্পড়। এরপর কথিত ঝাঁঝযুক্ত সরিষার তেল ছড়িয়ে দিলে পালিয়ে যায় ভূত। এখানে ভূত তাড়াতে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়েছে। ঝাঁঝের জন্য পালিয়ে যায় ভূত। বিজ্ঞাপনের পন্যটিতে যতোই ছল-চাতুরি থাকুক না কেনো। বিজ্ঞাপন নির্মাতা সরিষার অতীত ঐতিহ্যই তুলে ধরেছেন বিজ্ঞাপনটিতে।
বর্তমানে প্রবাদ বাক্যের বুলিতে যাঁরা সরিষার ভেতরে ভূত খোঁজেন তারা অহেতুক বিদ্যার অহেতুক প্রকাশ ঘটান। ভূত সরিষার ভেতরে নয় বরঞ্চ ভূত তাঁড়াতে সরিষার ঝাঁঝের প্রয়োজন।
ইদানিং ভূত আর অদৃশ্য নয়। সব ভূত দৃশ্যমান। ভূত আইন-আদালতকে তোয়াক্কা করে না। ভূত ত্রাস হয়ে সমাজে বিচরণ করছে। ভূত মানুষকে পিটিয়ে মারে। ভূত গাড়ি পোড়ায়, গাড়ি ভাংচুর করে। ভূত মানুষের গলা কেটে হত্যা করে। ভূত মানুষকে গুম করে। ভূত এখন অসীম ক্ষমতাধর। ভূত অফিসপাড়ায়। ভূত এখন দেশ শাসন করছে। ভূত এখন দেশ শাসনের বিরোধীতা করছে। অলিতে ভূত। গলিতে ভূত। রাজপথে হেঁটে যায় ভূত। এ ভূতের জন্যই বলা হয় তদন্ত চলছে। ভূত সরিষার ভেতরে নয়। ভূত বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। দাপট নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
এ জার্নি বাই অটোরিক্সা : মিরপুর টু পল্টন