ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠে দাঁতগুলোকে পিরস্কার করলাম। গোসলও সেরে নিলাম ঝটপট। অফিসের উদ্দেশে জামা-কাপড় পরিধান করে বের হলাম। মোড়ের দোকানে গরম গরম চা খেয়ে মিরপুর ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম।
পরিবেশটা কেনো যেনো আমার স্বপক্ষের মনে হলো না। বারবার মনে হচ্ছিল অন্যদিনের হরতালের মতো দু'একটি গাড়ি/বাস পাব, যাতে করে খুব সহজেই অফিসে পৌছে যাব।
হাজার হাজার অফিসগামী মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তাদের অফিস যেতে হবে ঠিক আমার মতোই। রিক্সা চলছে। চলছে কিছু অটোরিক্সাও। মনে মনে প্রমোদ গুনলাম। একটু গালাগালিও দিলাম হরতাল সমর্থকদের। কারণ, আমারতো অফিস যেতে হবে।
তবে একটা বৈশাদৃশ্য দেখে মেজাজটা আরো উচ্চে উঠলো, সরকারী অফিসের স্টাফ গাড়িগুলো ঠিকই চলছে। সেগুলো স্টাফ যাত্রী তুলছে। আমরা অন্যরা হাঁ করে দেখছি।
যদি এমনই হবে, তাহলে তো সেই গাড়িগুলোও চলতে দেয়া উচিত না।
আমি বিকল্প চিন্তা করছি। ভাবছি আজ রিক্সা করেই অফিসে যাব। পকেটে সম্বল দুইশো টাকা। কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিক্সাচালকের সাথে কথা বললাম, তারা জানালো ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে পারবে। আর ভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। আবারো মেজাজটা খারাপ হলো।
সকাল ৯ টা থেকে রাস্তার এপাশ-ওপাশ শুধু ঘুরছি। দামে-দরে না মেলায় রিক্সাও নিচ্ছি না।
অবশেষে ৯ টা ৪৫ মিনিটে একটি সিএনজি অটোরিক্সা পেলাম। যাবে পল্টন পর্যন্ত। চালক দর হাঁকালো ২৫০ টাকা। অবশ্য একজন সংগীও জুটিয়ে নিলাম। আমরা দামাদামি করলাম ২০০ টাকা দেবো বলে। চালক অবশ্য বাড়তি চা সিগারেট খাওয়ার টাকা দাবী করলেন।
বিসমিল্লাহ বলে চলতে শুরু করলো অটোরিক্সা। মিরপুর-১০ নম্বরে এসে প্রথম বাঁধা পেলাম হরতাল সমর্থনকারীদের। প্রথম জন এসে অটোরিক্সা ঘুরিয়ে দিলো। কিছুদূর এসে মনে হলো, আরে! আমার কাছে তো সাংবাদিকতার কার্ড রয়েছে। চলাককে বললাম আবার ঘুরিয়ে নেন গাড়ি। চালক ঘুরিয়ে নিলেন। চলতে থাকলাম। আবার বাঁধা এলো। আমি বললাম -প্রেস, গাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো। এরপর কাজীপাড়া এসে একজন ভদ্রলোক লিফট চাইলেন- তিনি প্রেসক্লাব পর্যন্ত যাবেন। চালক তাকে সামনে তুলে নিলেন। এরপর চলতে থাকলো তিন চাকার গাড়ি।
মিরপুর থেকে জিয়া উদ্যান পর্যন্ত শুধু রিক্সা আর রিক্সা।এরপর বিপত্তি বাঁধলো ফার্মগেটে এসে। এখানেও প্রেসের কার্ড দেখিয়ে ছাড়া পেলাম। কারওয়ান বাজার মোড় পার হতেই প্রচন্ড জ্যামের মধ্যে পড়লাম। চালককে বললাম উল্টোপাশের রাস্তা দিয়ে চলেন। উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে বাংলামটর মোড়ে এসে দেখি পুলিশ বাঁশ দিয়ে শাহবাগের দিকে যাওয়ার রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে ফলে জ্যাম লেগে গেছে। আমরা উল্টো রাস্তা দিয়ে চলতে থাকলাম। এবার বাঁধা পেলাম রূপসী বাংলার সামনে। প্রেস বলাতে একজন কার্ড দেখতে চাইলেন। কার্ড দেখালাম। ছেড় দিলো। আবার আটকিয়ে দিলো। আবার ছাড়লো। শাহবাগের দিকে যাবার আর সাহস হলোনা। চালককে ভিআইপি রোড দিয়ে যেতে বললাম। ফোয়ারার কাছে এসে এবার আটকালো পুলিশ। আবার কার্ড বের করাতে ছেড়ে দিলো। এখানেও পুলিশ বাঁশ দিয়ে রাস্তা ঘিরে রেখেছে। এরপর শিল্পকলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে প্রেসক্লাব পৌঁছলাম।
হিংসাত্মক কোনো মনোভাব দেখলাম না পিকেটারদের। কিন্তু এই যে হয়রানি হলাম। প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে মনে হলো- আমি না হয় পৌঁছাতে পারলাম কিন্তু অন্য কেউ তো পারবে না। কারণ পথে পথে বাঁধার প্রাচীর। কেউ যেন অফিস করতে না পারে। শুধু সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছাড়া।
হরতালকারী কিংবা সরকার বোঝে না। একদিন সরকারী অফিস না করলে কারো বেতন কর্তন করা হয় না। কিন্তু বেসরকারী সেক্টরে একদিন অফিস না করলে বেতন তো কর্তন করা হয়-ই। উপরন্তু শুনতে হয় অযাচিত অনেক কথা।
বিগত হরতালগুলোতে শত শত গাড়ি ভাংচুর হলেও মানুষ অফিস করতে পেরেছে। কিন্তু এ হরতালে মানুষ অফিসে যেতে পারছে না। এতো শান্তিপূর্ণ হরতালে যদি মানুষ অফিস করতে না পারে তাহলে সামনের অরাজকতাপূর্ণ হরতালগুলোতে আমরা সাধারণ মানুষ অফিসে যাব কিভাবে? আমাদেরওতো প্রাণের মায়া আছে। চলুক না রাস্তায় শত শত গাড়ি। সরকারী বিআরটিসি গাড়ি। তখনতো আমরা নিরাপত্তা পাবো না!