ইন্দিরানগরের ফিফট মেইনে কাটানো সময় গুলো এমনিতেই বিভিন্ন দিক দিয়ে স্পেশাল হয়ে আছে। প্রেম, আবেগ, অনুভুতি ও জীবনের গভীরে প্রবেশ করে জীবনের মানে শিখতে ওটাই ছিলো শ্রেষ্ঠ সময়। তখন আমি নতুন, মানে ব্যাঙ্গালোরে প্রথমবার গিয়েছি ! ৫৭৫ এ যে পিজিতে থাকতাম তার তার পাশে অর্থাৎ ৫৭৪ এর লনে বসে প্রতিদিন বিকেলে ছয় বছরের একটা ছেলে খেলা করে, আমার ছাদে বসে লনটা খুব ক্লিয়ার দেখায়, দুই তিনদিন পরে একদিন বাচ্চাটাকে একা একা কাঁদতে দেখেছি। বাসার দরজায় জার্মানি কুকুর পাহারা দেয়, বিকেল পাঁচটা নাগাত হোন্ডা এ্যাকর্ড চালিয়ে গেটের কাছে এসে থামে, ড্রাইভার সিট থেকে আনুমানিক ত্রিশের একজন মহিলা বের হয়ে নিজেই গেট খুলে কুকুরটাকে একটু আদর করেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ভেতরে ঢুকে আবার গেট বন্ধ করে দেন। ততক্ষণে ছুটে আসে খেলতে থাকা বাচ্চাটা, পরম আদরে তাকে কোলে তুলে নেন "মা" ! চুমু খান দু গালে, অনেকক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে রাখেন। এটা প্রতিদিনের নিয়ম, কিন্তু বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরার সময় চোখের সানগ্লাশ খুলেন না। অফিসিয়াল ড্রেসেই মা-ছেলে মিলে কতক্ষন খেলাধুলা করে বাচ্চাটাকে কোলে করে ঘরে ঢুকে যান।
ঘটনাক্রমে এই মহিলার সাথে আমার পরিচয় হবার পর থেকে এখনঅব্দি উনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মত দেখেন। উনি একজন 'মা" যাকে আমরা সিঙ্গেল মাদার বলি। আর পাঁচজনের মত ভদ্রমহিলাও একসময় স্বপ্ন সাজাতেন ঘর হবে, সংসার হবে। হ্যা তার ঘর হয়েছে সংসারও হয়েছে তবে তা সুধু ছয়বছরের এই বাচ্চাটাকে ঘিরে। যাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিজের সাথে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে যান, খাইয়ে স্কুলে দিয়ে আসেন বাসায় ফিরে নিজে রেডি হয়ে অফিসে যান আবার দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় বাচ্চাকে রেখে লাঞ্চ করিয়ে নিজে করে অফিসে যান। এভাবেই কেটে যায় রুটিন, হয়ত মিস করেন এমন কাউকে যার স্প্যামে বাচ্চাটা পেটে এসেছিলো ! আবার ঘৃণায় ভুলে যান। বাবা-মা বলতেই একজনকেই বোঝে ছেলেটা। নিজের সব জৈবিক চাহিদাকে সরিয়ে রেখে ভদ্রমহিলা সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের রুটিন তৈরি করতে করতে নিষ্পাপ সন্তানকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে, সৌদিতে অবস্থানরত ডাক্তার দম্পতির দিনগুলো কর্মব্যস্ত কাটলেও মন পড়ে থাকে দেশে আত্মীয় স্বজনের জন্য। সর্তানুযায়ী সিরিয়ো প্রফেশনাল ক্যাটাগরির কর্মকর্তা নিজে সাথে থাকা সাপেক্ষে তার আত্মীয়দের সৌদিতে অন-অ্যারাইভাল ভিসা করাতে পারবেন। ডাক্তার ভদ্রমহিলা একটু রিস্ক নিয়ে চলে গেলেন তার বৃদ্ধ বাবা মাকে নিয়ে আসতে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি আর ফিরতে পারলেন না। তাই তিন বছরের কন্যা সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলেন ডাক্তার বাবা। হাসপাতাল ও বাসা করে করে শুরুতে পেরে উঠছিলেন না, কিন্তু কিছুদিনেই হাসপাতালের সহকর্মি নার্সরা আপন করে নিলেন ছোট্ট শিশুটিকে।
ঈদের ছুটির পরে স্কুল খুললে আমার সাথে দেখা, জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে যাচ্ছে দিন গুলো ? আর কেনইবা বিয়ে করছেন না ! সন্তানের নিরাপত্তার কারনে উনি আর বিয়ে করবেন না ঠিক করেছেন, অনেকে হয়ত ভাবে তাড়াতাড়ি বিয়ে করি নাহলে এই ছোট সন্তান কিভাবে বড় হবে কে দেখাশোনা করবে কিন্তু ভদ্রলোক সন্তানের জন্য নিরাপদ আশ্রয় অন্য কারো কাছে খুজলেন না !
প্রায় একই ধরণের, দুটো ঘটনা আমাকে খুব ভাবায় ! এক মহিলা, যিনি সন্তানের নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে কখনো বাসায় কাজের মেয়েও রাখেন নাই ! অগোচরে সন্তানকে কেমন রাখবে সেই সন্দেহে। অন্যদিকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি সন্তানের প্রপার কেয়ার না করা যায়, অথবা নিজের মত করে যদি দেখাশোনা না করা যায় তাহলে কি হবে।
আসলে শারীরিক সুখের চেয়েও এমন অনেক সুখ রয়েছে যা সব ভালোবাসাকে একত্র করে সুধু মৃত্যুর পরে নাম বয়ে বেড়াবে বলে সে আসায় সব কিছুই বিসর্যন দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:০৮