রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আক্তার জাহানের আত্মহত্যার সংবাদ পড়ার পরে ভেবেছিলাম কিছু একটা লিখবো। যদিও মনের খোরাক মেটানোর জন্যই অল্পস্বল্প গল্প ও কবিতা যা লিখি, কিন্তু বিয়ে, ডিভোর্স অতপর আত্মহত্যার মত বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর ও চিন্তার বলে এড়িয়ে গিয়েছি। ভাবলাম বন্ধু ও ফলোয়ারের নগন্য সংখ্যা নিয়ে এমন পোষ্ট না দেওয়াই উত্তম। গতকাল রাতে বন্ধুদের সাথে ঈদ উত্তর আড্ডায় বিষয়টা আবার উঠে এলে আমি এড়িয়ে বের হয়ে যেতে চাইলাম, অনেকেই তাচ্ছিল্যের সাথে অনেক কিছুই বলতে থাকলেও আমার থোড়াই কেয়ার!
জীবন থেমে থাকে না, থেমে নাই বাদামী খাম বয়ে চলা ডাকপিয়নের চলাচলও! অন্তত এই কাজটিই করে যাচ্ছেন অলস বসে থাকা ডাকপিয়নেরা, পঞ্চাশ টাকা ষ্ট্যাম্পে নোটারীর লাল সিলযুক্ত কাগজের এক ফটোকপি এসেছিলো আমার ঠিকানায়ও।
আবেগময় প্রেম, বিয়ের পরে রংধনুর মত মনমানুষিকতা নিয়ে সংসার শুরু করে সবচেয়ে বেশি সেপারেশনের শিকার হয় প্রবাসিরা, স্পেশালী মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসিরা। এরা অভাবের সাথে যুদ্ধ করে, পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে, পরিবারের সাথে যুদ্ধ করেও পরিশেষে কারও মন পায় না। কিছুদিন পরে অলস বসে থাকা ডাকপিয়ন বাদামী খাম নিয়ে বাড়িতে হাজির, যে মানুষটিকে কিছুদিন বা কয়েকমাস আগে আপন করে তাকে সাথে নিয়ে নিজের অবশিষ্ট জীবনের স্বপ্ন গড়তে শুরু করেছে সেই কিনা উকিলের মুখস্থ ফরমেটে ঠকঠক টাইপরাইটারে লেখার নিম্নাংশে সাক্ষর করে সাজনো স্বপ্নের ইতি টেনে দিলো। এর পরের শ্রেনীতে রয়েছে দেশের শিক্ষিত সমাজ, এরা সেপারেশন করে মিউচুয়ালি, এখানে বোঝাপড়ায় টানাপড়েনের কারনেই এই সমস্যা হয়। তবে সেপারেশন যে কারনেই হোক সেটা কয়েক বছর বা সন্তানের জন্মের পরে হলে মেনে নেওয়া কঠিন। সাধারণত নির্মম নিগ্রহের শিকার না হলে এধরনের সিদ্ধান্ত কাম্য নয়।
দেশের সর্বচ্চ বিদ্যাপীঠের একটিতে একই বিভাগীয় সহকর্মিকে বিয়ে করে এক সাথে বেশ কয়েকবছর সংসার করে পারিবারিক জীবন সুখের ছিলো না এটা মানতে রাজি নই। প্রকৃতির কতগুলো অদ্ভুত নিয়মের মধ্যে একটা হল বয়স, মধ্যবয়স পার হবার সাথে সাথে পুরুষালী মমনশীলতার তিব্র পরিবর্তন হয়। ভালবাসার মানুষটি তারকাছে আগের আবেদন হারায় অথবা কোন আকর্ষনীয় আবেদনময়ী নতুনত্ব তার মনকে আচ্ছন্য করে ফেলে আমার বিশ্বাস সেকারনেই স্বচ্ছল এক ছোট পরিবারের ভবিষ্যতের ফুল-স্টপ পড়ে, সেপারেশন হয়ে যায়। মিউচুয়ালি সেপারেশনের কয়েকবছর পরেও ম্যাডাম নিজেকে নিজের মত করে খুজে পাননি বলে মনে হয়েছে। বিভিন্ন ভাবে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সুইসাইডাল নোটটি পড়ে যতটুকু বুঝেছি ম্যাডাম চাননি যে তার মৃতুর পরে তাদের চৌদ্দ বছরের সন্তান সন্তানের বাবার কাছে থাকুক! হয়ত তিনি আগে থেকেই সন্তানের নিরাপত্বার কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং বাবা-মায়ের দাম্পত্ব কলহ যাতে সন্তানের মনে ইফেক্ট না করে তাই সন্তানকে ঢাকায় রেখেছিলেন (যদিও এবিষয়ে আক্তার জাহানের সাবেক স্বামী নিজের মতামত তার মত করে তুলে ধরেছেন, যা কোন ভাবেই আমার কাছে সম্পূর্নরুবে বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না) ডিভোর্সের পরে কিছুদিনেই যেখানে একটা মেয়ে নিজেকে মানুষিক ভাবে গুছিয়ে নিতে পারে সেখানে বছরের পরে বছর ধরে জলতে হয়েছে এই সুশিক্ষিতা মহিলাকে। এদিকে নিজের এককালীন ছাত্রীকে নিজের সহকর্মী বানিয়ে বিয়ে করে বসেন আক্তার জাহানের সাবেক স্বামী, ডিপার্টমেন্টাল বিভিন্ন আলোচনায় সাবেক স্ত্রীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্বের সাথে মানুষিক নির্যাতন করতে থাকেন। এর মাঝ থেকেও নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেক চেষ্টাও করেছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। স্ব্ল্পভাষী এই শিক্ষিকা ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে কোন একটা মুহুর্তে হয়তো তিনি আস্থার আর কোনও অবলম্বন দেখতে পাননি। আর এভাবেই হারিয়ে গেলেন।
কিছুদিন আগে Undercover Angel নামে একটা মুভি দেখেছিলাম, গল্পের নায়কের (Harrison Taylor) সাবেক বান্ধবী, প্রেমিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকায় তাকে ছেড়ে চলে যায়। ঘটনাক্রমে কয়েকবছর পরে ঠিক কোন এক কাজে কানাডা যেতে হচ্ছিল বলে তিনি তার ছয় বয়সী কন্যা সন্তানকে রাখার জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুজছিলেন, তিনি ভাবলেন Harrison এর চেয়ে ভালো নিরাপদে কেউই রাখতে পারবে না, যদিও Harrison জানতোই না যে তার একটি মেয়ে আছে। তাহলে শিক্ষিকার মত মহান পেশায় নিযুক্ত আক্তার জাহান বিশেষ কোন কারন আছে বলেই নিজের প্রয়াণের পরে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন !
নিজে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসি বলে কথার মাঝে একবার মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের কথা এসে গিয়েছিলো, আসলে এটা যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই হচ্ছে তা নয়। পূর্ব পশ্চিমাদেশগুলোতে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জীবনেও ঘটছে। কয়েকবছর আগে এক ছোট ভাই বাবা-মায়ের মতামতের বাইরে গিয়ে পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরমুখো হতে পারছিলো না, অনেক চেষ্টা করেও পথ না পেয়ে সমুদ্রপথ ও বনজঙ্গল পেরিয়ে ভাগ্যের অন্যষনে মালয়েশিয়া পাড়ি দিলো। দির্ঘ্য এপথ পাড়ি দেবার পরে গন্তব্য নিষচিত হবার পরে যখন প্রিয়জনকে জানানোর চেষ্টা করলো, জানতে পারলো বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করা প্রিয় মানুষটি তাকেই প্রিয়র একমাত্র লিষ্ট থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে ! প্রত্যয়ী ছেলেটা তার গন্তব্যকে আরেকটু পুর্বের দিকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া হয়ে অবশেষে অস্ট্রেলিয়াইয় পাড়ি জমায়। বাদামী খামের ভেতরের চিঠি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ না হলেও, সোনালী বা বাদামী চুলের কেউ একজনই হয়ত প্রিয় হয়ে উঠবে একদিন।
ডিভোর্স নিয়ে আমার মন্তব্য নেই, তবে এর নিয়ম নিয়ে রয়েছে ঘোর বিরোধিতা ! মেয়ে-দেখা, ছেলে-দেখা পর্ব পেরিয়ে ঠিক হয় এ্যাংগেজমেন্ট পর্ব, তারপরে দিনক্ষন দেখতে দেখতে আন্তর্জাল ও মুঠোফোনের কল্যাণে শুরু হয় মনের আদান প্রদান। বেশিরভাগের আবার কেটে যায় কয়েকমাস, অনেক ঘটাকরে দিনক্ষন দেখে হাজার খানেক মানুষের সামনে অবিভাবকের হাতে হাত রেখে পড়তে হয় বিভিন্ন দোয়া অবশেষে তিনবার কবুল। কাজী সাহেব পরম আনন্দে ও বিশ্বাসে নীলবইয়ে লিখে ফেলেন সব সামাজিক ও ধর্মিয় স্বীকৃতির যত দলিল। অথচ ডিভোর্স গুলো হয় নীরবে ও নিভৃতে, একভূত হবার আনন্দ প্রকাশে যতটা আয়োজন হয় ততটা নিভৃতেই শেষ হয়ে যায় সেই বন্ধন, অতঃপর দুজনের পথ দুটো দিকে বেকে যায়। এখানেও আমার বিরোধিতা নেই, কারন বন্ধন ছিন্ন করাতে পার্টি করার কোন মানে হয়না, সমস্যা হলো উকিলের করা ফরম্যাট ! যে কোন কারনেই হোক একটা মেয়ে (এভাবে মেয়েরাই বেশি ডিভোর্স দেয়) যখন তার স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়া লেটারে স্বাক্ষর করেন তখন তার উপরাংশের লেখা দেখার সুযোগ থাকে না, আর এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়ে কোর্টসাইডের সামনের বটতলায় টেবিলপাতা উকিল সাহেবও টুপাইস কামিয়ে নেন। অথচ তারা জানেনই না তাদের এই সামান্য স্টেপ যেমন দুটো মানুষের মাঝে আজীবনের দূরত্ব তৈরি করছে তেমনি ছেলেটাকে হতে হচ্ছে চরম অপমানীত! এই অপমানের তীব্রতা এতবেশি যে সামাজিক ও মানুষিকভাবে হেও প্রতিপন্ন হয়ে না জানি কত পুরুষও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অথচ হারো কাছে প্রতিবাদ বা আর্জি জানানোর যায়গা নেই, পূরুষ অধিকার এখানে খুবই সীমিত।
আত্মহত্যার পথ বেছে না নেওয়া ওইসব তালাকপ্রাপ্ত পূরুষরা যেমন সামাজিক নিগ্রহের শিকার তেমনি তালাক দেওয়া নারীদেরও রয়েছে অনেক বেশি কষ্টের যায়গা, অথচ একটু শক্তভাবে ভাবলে অনেক কিছুই অন্যরকম হতে পারে। পূর্নতা বা অপূর্নতা অথবা বোঝাপড়ায় সমঝোতার গ্রাফে যে ওঠানামা তা নিজ ইচ্ছেয় হোক আর পারিবারিক চাপেই হোক, সেপারেশন ইফেক্ট মেয়েটিকেই বহন করতে হয়, পাওয়া না পাওয়ার যতসব অংক মেলাতেই কেটে যায় বেশিরভাগ সময়। যখন সে সেপারেশন হয়েছিলো বা তালাক দিয়েছিলো তখন হয়ত তার কাছে সময়টা ঠিক ছিলো, কিন্তু এই সব অংক মেলাতে গিয়ে যখন নিজেকে সমাজের আলাদা একটা শ্রেণীতে আবিষ্কার করতে শুরু করে তখন বেশিরভাগ মানুষই হারিয়ে ফেলা মানুষটি নিয়ে আরেকবার অংক করে দেখে ! পরক্ষনে হিসাবের যতসব সুত্র ও ধাঁরা এলোমেলো করে দিয়ে শুরু করে নতুন দিনের যাত্রা। কেউ হয়ত পথ খুজে পায় কেউ আবার আক্তার জাহান জলির মত হারিয়ে যায়।
সবাই সবার যায়গায় ভালো থাকুক !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৬