প্রবাসে দেশের কথা বলার ইচ্ছে জাগলেও ব্যাস্ততার কারনে বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু এখন হয়ত মনের ঈশান কোন থেকে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে বের হতে চাচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে নিজের ভাবনা। প্রবাস, স্পেশালি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ভাবেন এই লেখা তাদের জন্য। বাকিদের জন্য বোনাস।
ভৌগলিক দৃষ্টিতে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব। তেল সমৃদ্ধ এই দেশ এক সময় বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করতো। পশ্চিমাবিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হলেই পড়তে থাকে তেলের দাম, ব্যারেলপ্রতি যা প্রায় ১৫০ থেকে বর্তমানে ২২ ডলারে নেমে আসে। তেলবাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতিতে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করা সৌদিআরব বাদশাহ আবদুল্লাহ ক্ষমতায় আসার কয়েক পর থেকেই অভ্যন্তরীণ সংস্কার শুরু করে। কিন্তু মুল সংস্কারটা শুরু হয় ২০১০ এর পর থেকে। কারন বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা সৌদি রাজপরিবারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তেলবাণিজ্য হারালে কতটা বিপদের মুখে পড়তে পারে তারা। মুলত তখন থেকেই শুরু হয় কিভাবে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়িয়ে তেলবানিজ্যে নির্ভরতা কমিয়ে আনা যায়।
এভাবেই শুরু হয় বাধ্যতামুলকভাবে বিভিন্ন নামে বে নামে ট্যাক্স আদায়, আর সেটা নির্বিঘ্নে করতেই মুলত সব সেক্টরকে ২০১২/১৩ সালেই ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়, স্পেশালি পেমেন্ট সিস্টেমকে। বাদশাহ আব্দুল্লাহর শারীরিক অবস্থা আর পরবর্তি দুই যুবরাজের মৃত্যুতে কিছুটা ধীরগতি হলেও ইরানকে চাপে রাখতে ও আরব বসন্তে নিজেদের দূরে রাখতে ও রাজপরিবার নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে সামরিকশক্তি বাড়াতে গুরুত্ব দেয়। তেলের পড়তি দাম আর সামরিক ব্যায় বৃদ্ধি, সবশেষে বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পরে রিয়াদের গভর্নর হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাদশাহ সালমান যখন মসনদে বসেন তখন অবস্থা অনেক নড়বড়ে। বন্ধ হতে থাকে বড় বড় কোম্পানি, এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি সৌদি-আরামকো তাদের ২৫% শেয়ার প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিকবাজারে উন্মুক্ত করে দেয়। ভঙ্গুর এই অর্থনীতিতে দেশকে বাঁচাতে রাজপরিবারের বেক্তিগত তহবিলগুলো বিভিন্নভাবে উন্মুক্ত করে দেয়। আর এতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসলেও গ্রাফ নিজের দিকেই থাকে। এবং তাই বছরের শুরুর দিকে ভাবতে হয় কিভাবে বেকারত্ব কমিয়ে তেলভিত্তিক বাণিজ্য থেকে সম্পুর্ন সরে আসা যায়। বাদশাহ সালমান প্রাচ্যে লেখাপড়া করা ত্রিশবছর বয়সী তার ছেলে মোহাম্মাদ বিন সালমানকে দেওয়া হয় দায়িত্ব। নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্বের বাঘা বাঘা সব অর্থনীতিবিদদের, সাথে সরকারী ভাবে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হয় কিভাবে সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়। চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত মোহাম্মাদ বিন সালমান অর্থনীতিবিদদের কাছে কিছুই গোপন করেনি, এমনকি ফলো করে চলেছেন বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের রুপরেখাগুলো। বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ প্রভাব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে উন্নয়নের রুপরেখা প্রস্তুত করা হয়। নাম দেওয়া হয় ভিশন ২০৩০।
বেকারত্ত দুরিকরনে ইতিমধ্যেই দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দশ পারসেন্ট সৌদি নাগরিক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এমাসের মাঝেই টেলিকমিউনিকেশন ব্যাবসা সেক্টরকে একশভাগ সৌদিদের করে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব খাত থেকে প্রবাসীদের সরালেও ব্যাবসার ক্ষেত্র বাড়ায় অসুবিধে হচ্ছে না। ভিসন ২০৩০ প্রণয়নে অনেক ভাবেই বাংলাদেশকে ফলো করে চলে, এমনকি অভ্যন্তরীণ সহযোগিতাও চাওয়া হয়, অটিজম নিয়ন্ত্রনে বাংলাদেশের ভূমিকা, তথ্য ও প্রযুক্তি, কৃষি ও মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পে সাহায্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ডানঘেঁষা সৌদি রাজপরিবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যবেক্ষন করলেও অন্যদেশগুলোর মত প্রতিবাদ করেনি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পরে আট বছর পরে প্রথমবারের মত দেশটির সর্বচ্চ পর্যায় থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রন জানানো হয়। এবং ইতিহাসের সবচেয়ে জৌলশ অভ্যর্থনা জানানোর সাথে সাথে দুই দেশের মধ্যে কিছু লিখিত ও অলিখিত চুক্তি করে ফেলে। আর ততদিনে প্রতিবেশী দেশগুলো এমনকি ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো শুধু প্রত্যক্ষ করতে থাকে।সময়ের সাথে সাথে বুদ্ধিবিলাস ঘটে সৌদিরাজ পরিবারের, বিভিন্ন প্রতিকুলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াওটা যে অনেকটা ঈর্ষনীও তা নিয়ে স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স আর প্রিন্ট মিডিয়াতে আলোচনা হতে থাকে।
সৌদি আরবের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করলে হয়ত কিছুটা অস্থিতিশীলতা পাওয়া যাবে কিন্তু ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করা গেলে এদের ঘুরে দাড়াতে সময় লাগবে না, যা এরা অনেক আগেই করতে পারো তা এখন শুরু করেছে। বিনিয়োগ সুবিধা না থাকায় অবৈধ পথে আয়করা প্রবাসীরা যেভাবে অর্থপাচার করেছে তা যদি আইনগত ভাবে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হত তবে নতুন কোন ভিসন রাখতে হত না সৌদি আরবের।
পক্ষ-বিপক্ষে অনেকেরই মতামত থাকতে পারে তবে একজন সৌদি প্রবাসি হিসাবে আগের থেকে কিছুটা কষ্টে চলতে হলেও আমার মনে হয় এই অবস্থা সাময়িক। আর এই অবস্থা কাটাতে সব দেশের প্রবাসীরা স্থানিয়দের সাথে নিয়ে যদি আইনের হাত ধরে চলে তবে অবস্থা উত্তরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এটাতো প্রবাশি তথা প্রবাসিদের দেশের দায়িত্বের পর্যায়েও পড়ে যে দেশ আর্তসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্নভাবে পাশে দাড়িয়েছিলো এখন তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমার মনে হয় দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এই কাজটা ঠিক মতই করছে, আর তার ফলশ্রুতিতে দির্ঘ্য সাত বছর বাংলাদেশিদের বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। এখন দেশ হিসাবে আমাদের উচিত সুযোগটা ঠিকঠাক ভাবে ব্যবহার করা। অর্থনীতির এমন অবস্থায় ভারত যদিও তাদের শ্রমিকদের ফেরত নিতে চাচ্ছে সেখানে কিছুটা কম মুল্যে হলেও বাংলাদেশ থেকে আসা দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক এদেশের উন্নয়নে যেমন অবদান রাখতে পারবেন তেমনি নিজেদের দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সৌদি সম্পর্কে নেগেটিভ নিউজ প্রকাশ করলেও রেমিটেন্স গ্রাফে এখনঅব্দি সৌদি আরবই এগিয়ে, আসাকরি ভবিষ্যতে এতা আরো জোরালোভাবে এগিয়ে যাবে, সুতারং এধরনের সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
সবশেষে প্রসঙ্গ ভিসা কেনাবেচা, আমরা সুযোগ দিচ্ছি বলেই সৌদিরা আমাদের কাছে ভিসা বিক্রি করছে সেখানে অন্যদেশ থেকে নিজ খরচে শ্রমিক নিয়ে আসে। এর জন্য দরকার, জাতিগত সচেতনতা। এখানে এমনিতেই আইনগতভাবে ভিসা কেনাবেচা নিষিদ্ধ আর অপরাধ হিসাবে গণ্য হলেও আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারছি না। সাময়িক লাভের জন্য মানুষ কেনাবেচায় মত্ত হয়ে এখান থেকে দেশে টাকা পাঠানোর উল্টোটা করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে আসছি। সুতারং সরকারী পর্যায় থেকে শুধু আইন নয়, বাংলাদেশে এই ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। যে পরিস্থিতিই হোক আমি কাউকেই এখানে আসতে নিষেধ করবো না। কারন ভিসন ২০৩০ এর রুপরেখায় অদুর ভবিষ্যতে নাগরিক বরাবর সুযোগ সুবিধার সাথে সাথে এখানে নির্বিঘ্নে ব্যাবসা বাণিজ্যও করতে পারবেন। সুতারং দক্ষ হয়ে এখানে আসতে পারলে কয়েকমাস পরেই আপনার নিজ কর্মসংস্থানে সমস্যা হবে না।
Vision 2030 of Saudi Arabia and Bangladesh's deepening engagements
সৌদিআরবের পরিস্থিতি নিয়ে সবশেষ তথ্য পেতে সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য ফেসবুক পেজ "আমরা সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশী"
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৫:৪৬