মোটেল থেকে ঢিল ছোটা দূরত্বে ছিলো সিমান্তদের বাড়ি। সরকারি প্রজেক্টের জন্য যায়গাটা নিয়ে নিলে ওদের ঠাই হয় বাঘিয়া নদীর ওপারের গ্রামের শেষ মাথায়, আর বেচে থাকার তাগিতে দেওয়া হয় মোটেলে চাকুরী। রাতে ঘুম এলো না, রাতভর চলল আমাদের গল্প। সীমান্তের দূর সম্পর্কের পিসি ছিলো স্থানীয় প্রাইমারী শিক্ষিকা, স্কুল কাছে হওয়ায় ওদের পাশেই একটুকরো ভিটে কিনে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু যায়গা করায়তের সময় ওনার ভিটেও পড়ে গেলে রাগে ক্ষোভে দুঃখে স্কুলে ইস্তফা দিয়ে পেনশন আর জমির টাকা নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। অথচ উনি চাইলে আরো ৩/৪ বছর চাকুরিটা করতেই পারতেন। আর সাথে সাথে অপরিপক্ক প্রেমের উপাক্ষানে উপসংহার টেনে দিতে হয়
“হেই, থামো থামো ! অপরিপক্ক প্রেমের উপসংহার বলতে ?”
স্কুলশিক্ষিকা পিসির একমাত্র মেয়ে চৈতি, তখন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া দুজনেই প্রেম নামক আবেগী ভাবনার আবেগ না বুঝলেও বাকি সব বুঝতে শিখেছে। পানসিতে ভেসে বেড়ানো, হইহুল্লড় আর একই সাথে স্কুলে যাওয়া সবই হয়েছে, কিন্তু ওরা কেউই বুঝতে পারেনি যা হচ্ছিল তা হল এক কল্পিত ভালোবাসার উচ্ছ্বাস মাখা ভাবনায় নিজেদের আবিস্কার। দেশ ছেড়ে যাবার আগে ষোড়শী চৈতি বা সীমান্ত কেউ কাউকে বলেনি তাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে অথবা, কখনো তাদের দেখা হবার সম্ভবনা আছে কিনা। হয়ত দুজনেই জানতো এটুকুই সব কিছু। থানার পিছনে প্রায় সতেরো বিঘার একটা ঘের কাটা হচ্ছিল তখন, পাড়ঘেষে কালো মাটির পাড়ের এপার থেকে কিছুই দেখা যায়না, সেবারের আশ্বিনে কলার চারগাগাছগুলো উর্বর নতুন মাটি পেয়ে যেন প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। সীমান্তদের শেষ দেখা হয় ঘেরের পশ্চিম পাড়ে কলাগাছের আড়ে, আগে থেকেই অপেক্ষা করা চৈতির পাশে গিয়ে মাটিতেই বসে পড়ে সীমান্ত, “আমাদের কি আর কখনো দেখা হবে না ?”
ততক্ষনে জলতরঙ্গে বান বইয়ে যাওয়া চক্ষুদ্বয় বা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছতে ব্যাস্ত। “কি করে বলবো, যে আমায় ভুলে যাও ! আমিতো কোনদিন তোমায় ভালোবাসতে বলিনি। জানোতো, মেয়েরা ছেলেদের থেকে একটু আগেই বড় হয়! বড় বোঝো ? পরিপক্ব, তুমি হয়ত তাও বুঝবে না। আমি সেটা হয়েছি তোমার অগোচরে কিন্তু তোমার হাত ধরে। একটা মেয়ে যার হাত ধরে বড় হয়েছে, যে তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে তাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতে কতটা কষ্ট হয় জানো না। ভুলে যেতে বলার সাহস আমার নেই, নিয়তী যদি কোনদিন সামনে নিয়ে আসে সেবার আর ছেড়ে যাবো না, আর যেতেও দেবো না। কিন্তু বড় হতে কিঞ্চিৎ বাকি থাকায় নিজেকেই দূরে সরিয়ে নিতে হচ্ছে”।
চৈতির বলা কথাগুলো অবিকলভাবে ন্যারেট করার সময় সিমান্তকে থামিয়ে বললাম, “তুমি কি বুঝেছিলে, লাস্টের কথাটা?”
“কোন কথা ভাইয়া?”
“ওই যে, বড় হতে কিঞ্চিৎ বাকি থাকা?”
“না, তখন বুঝি নাই। তবে এখন বুঝি কিন্তু এখন যে কিছুই করার নেই। অবস্য তখন বুঝলেও খুব বেশি লাভ হতনা। জানেন ভাইয়া বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি, আসলে নিজের কাছের মানুষ যখন হারিয়ে যায় তখন উত্তরের আকাশের রংধনুও ফিকে হয়ে যায়।”
সিমান্ত চৈতির সাথে সম্পর্কে একটা ব্যাপার মেইন্টেইন করেছিলো। সেটা হল একাগ্রতা ও গোপনীয়তা, এ যুগে নতুন নতুন প্রেমে পড়লে বন্ধুদের জানাতে মনে চায় বলতে ইচ্ছে করে জানিস, ওই আমার প্রেমিকা। কিন্তু খুব কাছে থেকে মিশলেও অভিভাবকরা ওদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে কোনদিন বুঝতে পারেনি ওদের মাঝে কোন সম্পর্ক রয়েছে। তুলনামূলক অবস্থাপন্ন চৈতির পরিবার থেকে কোন রকম বাধা আসতে পারে নুন্যতম সে সুযোগও রাখেনি ওরা। অবস্য এ ব্যাপারে চৈতির সাহায্য ছিলো বৈকি, সেবার যখন বাঘিয়া বিলে শাপলা তুলতে গিয়ে সিমান্ত পানসি ডুবিয়ে ফেললে চৈতি পানি খেয়ে পেট ফুলে ওঠে তখনও চৈতি বলেছিলো কাছের পুকুরেই আমি ডুবে যাচ্ছিলাম, আজকে সিমান্তই আমাকে টেনে তুলেছে। সেই থেকে পিসিও সিমান্তকে আলাদাভাবে স্নেহ করে তবে তা কোন ভাবেই মেয়েকে নিয়ে ভাবনা অব্দি নয়, একমাত্র মেয়ের ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে কৃতজ্ঞতা সরুপ যতটা সম্ভব আর কি।
“তুমি কখনো, ভারতে ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাওনি ?”
“না ভাইয়া, সাধ আর সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। তাছাড়া ওদের ঠিকানা জানি না, এমন কি যাবার পরে ওরা কোনদিন যোগাযোগ করেনি যে ফোন নাম্বার পাবো”।
“ওহ তাহলে ক্রিটিক্যাল তো। তবে তোমাদের কাহিনী শুনে ভালো লাগছে, যদি আমার কিছু করার থাকতো তাহলে মধুমতীর সদ্য সৃতির সাথে তোমাদের সৃতি নিয়ে আনন্দে ফিরতে পারতাম”
সে রাতে ঘুম হলো না, কেন যেন মনে হলো যদি সীমান্ত আর চৈতির আবার দেখা হয়, তাহলে কি হবে। কিভাবে হবে এত বছর পরে ওদের প্রথম দেখা, কোন ভাবেই যদি আমি ওদের দেখা করাতে পারতাম ! এপাশ ওপাশ করে সারারাত কেটে গেলো আমার ভাবনায় সিমান্ত আর চৈতি ছাড়া কিছুই নেই। চারিদিকে আজান পড়েছে, ঠিক কবে শেষ নামাজ পড়েছিলাম মনে নেই, আজকে নামাজ পড়তে ইচ্ছে করছে। জন্মসুত্রে আমি মুসলিম এটা মনে পড়লো অনেক পরে। কোন এক ঈদের দিনে আমার ফস্টার ফ্যামিলি মানে দত্তক বাবা-মা আমাকে নিয়ে যখন দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। তারপর থেকে ওনারা কোনদিন আমাকে বাধা দেননি বরং সেবারই ঢাকায় বসে নামাজ রোজার বেসিক আইডিয়াটা শিখিয়ে নিয়েছেন, বাংলা ভাষাটাও যাতে বুঝতে পারি সেই কাজটাও করেছিলেন।
নামাজ পড়ে ফিরতে ফিরতে দেখলাম পুরাতন ভাঙ্গাচোঙ্গা ঘরে অগ্রণী বাংকের সাইনবোর্ড টানানো। রুমে ফিরে অঘোর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম। সকালে কেউ একজন এসে চা নাস্তা দিয়ে গেলেও আমি শুধু দরজা খুলে নিলাম, কিন্তু তখনো আমার জেট-লেগ বিচ্ছিন্ন হয়নি, আমি না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। দুপুরের পরে সিমান্ত খাবার নিয়ে এলো, দরজায় নক করলে আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সকালের খাবার খাওয়া হয়নি, টিফিন ক্যারিয়ার রেখে ঠান্ডা চা’য়ের কাপ ও নাস্তার প্লেট নিয়ে চলে গেল। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে গোসল করে নিলাম, ওয়াশরুম থেকে ফিরে দেখি খাবারের প্লেট সাজিয়ে রেখেছে সিমান্ত। ছেলেটা বড্ড বেশি কেয়ারিং
“সকালে নাস্তা, খাননি না ?”
“নাহ, ঘুম হয়নি তো। সকালে ঘুম পাচ্ছিলো খুব, তাই ঘুমটাকে বসে আনতে পারিনি”
“আজকে স্পেশাল একটা খাবার আনছি। ভাবলাম আপনি টেস্ট করে দেখেন”।
“শাপলা চিংড়ি মাছ দিয়ে ভাজি। পরিচিত তবে স্বাদ ভুলে গেছি, আমার খেতে অসুবিধা নাই তুমি এদিকে দাও।
“জি ভাইয়া, শাপলার সাথে আরেক আইটেম আছে। শাপলা দিয়ে ইলিশ মাছ”।
“তাই নাকি, দাওতো ! আচ্ছা, তোমার পাসপোর্ট আছে?”
“কেন বলুনতো ভাইয়া, এখানে চাকুরি হবার আগে একবার মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিলাম বলে পাসপোর্ট করেছিলাম। তা পরে হয়ে ওঠেনি”।
“জানো, কাল রাত ধরে ভাবছিলাম। কি সৃতি নিয়ে ফিরবো আমি, একটা মৃতপ্রায় নদী ? তোমার কাহিনী শোনার পরে মনে হলো যদি আমি এই গল্পের অংশ হতে পারি ! ভাব্লাম তোমাকে নিয়ে ভারতে যাবো। অবস্য তুমি যদি রাজি থাকো তবে আমি ব্যাবস্থা করতে পারি”।
সীমান্তের পৌরষত্ব ভেদ করে অশ্রুসজল চোখ থেকে এক নদী পানি গড়িয়ে পড়লো। ও জানতো আমি হয়ত ওকে নিয়ে ভারত যেতে পারবো এতে ওর কোন খরচও করতে হবে না, কিন্তু ভারত কি খুব ছোট দেশ যে আমরা চৈতিকে খুজে পাবো? অনর্থক ওখানে গিয়ে কাজ না হলে সিমান্ত যেমন আশাহত হবে আমিও কষ্ট পাবো। সিমান্ত তবুও নিশ্চুপ থাকে। আমার জীবনটাই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে গড়া, অনেক কিছু চিন্তা করে শুরু করতে পারি না। তবে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায়, আমার কেন যেন মনে হয় চৈতিকে খুজে পাবো। সিমান্ত চৈতির পরিণতি কি হবে জানি না, এটুকু জানি ওদের দেখা করানোর মুহুর্ত আমি দেখতে চাই।
“আজকে, কি বার সিমান্ত”।
“শনিবার ভাইয়া”।
“কাল সকাল সকাল এসোতো, ন’টার মধ্যে”।
“আজকে বিকেলেতো বিল দেখতে যাবার কথা ছিলো’
“আজকে আর না, কাল যাবো। তুমি বরং কাল সকালে আসার সময় চৈতির মা’য়ের ফুল ডিটালস অর্থাৎ যতদুর পাওয়া যায় নিয়ে এসো”।
“আমি বুঝতে পারছিনা, আপনি কিভাবে শুরু করতে চাচ্ছেন !”
কয়েকবছর আগে জাতিসঙ্গের এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসাবে থাকা এক ইয়াং অফিসারের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। পররাষ্ট্র ক্যাডারে কর্মরত অফিসারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক হয়ে যায়, এখানে আসার আগে ওই আমাকে বাংলাদেশে থাকার ব্যাপারে সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলো। সীমান্তের ব্যাপারে ওই আমার একমাত্র ভরসা। মাঝরাতে বন্ধুর কাছে সহযোগিতা চাইলাম যাতে স্থানীয় শিক্ষা অফিস থেকে নির্বিঘ্নে তথ্য পাওয়া যায়।
শিক্ষা অফিসে ওনার বর্তমান কোন কনটাক্ট নাম্বার পাওয়া গেলো না। তবে একটা তথ্য পেলাম যা হল উনি ৫/৬ মাস অন্তর অন্তর ব্যাংক থেকে ওনার পেনশনের টাকা তুলে নেন, বাকিটা ব্যাংকই বলতে পারবে। সীমান্ত আশাহত হলেও আমি হইনি, কারন আমি জানি কিভাবে বাকিটা কিভাবে পাওয়া যাবে। পেনশনের নির্ধারিত ব্যাংকের ঠিকানা নিয়ে ব্যাংকে গেলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও ব্যাংক কোন তথ্য দিতে রাজি হয়নি, অগত্যা বন্ধুকে ফোন করে হেল্প চাইলাম। কিন্তু ও জানালো ব্যাংক সেক্টরে কোন হেল্প করতে পারবে না, তবে আগামীকাল কোন উর্ধতন ব্যাংক অফিসারকে দিয়ে বলিয়ে দিতে পারে। সাধারনত গ্রামের এইসব ব্যাংকের লেনদেনের তথ্য অনলাইনে থাকলেও বিস্তারিত থাকে না, ওইদিন আমাদের ফিরে আসা ছাড়া কোন কিছু করার ছিলো না।
বিকেলে বিলাঞ্চল ঘুরতে গেলাম, শরতের বিকেলটা আগের রাতের মত ভয়ানক ছিলো না, যদিও উত্তরের আকাশে মৃদু মেঘের আনাগোনা ঠিকই ছিলো। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শাপলা ফুলের সমাহার হলেও এই বিলাঞ্চলটাও আর আগের মত নেই। ফাকা ফাকা ঘরবাড়ি করে ফসলী জমিগুলো দখল করা হয়েছে, এখানে বছরে একবার ধানের চাষাবাদ হয়। কিন্তু এভাবে চাষযোগ্য জমি উজাড় করা হলেতো খাদ্যসংকট দেখা দেবে, যদিও শুনেছি এ দেশে বর্তমান সরকার খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। মানুষ এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে ঘরবাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। এই বিলের ভিতরও পাকা ঘরের অভাব নাই। একটু মাঝারি টাইপের নৌকায় চড়ে বিলের অনেকটা ভেতরে যাবার সুযোগ হলো, হায় চারপাশে শাপলার রাজত্ব। স্বচ্ছ পানির ভেতর খুব ভালো করেই নিচ অব্দি দেখা যায়। সীমান্ত কি যেন বলতে চায় করে করে বলতে পারছে না। আমি বুঝতে পারছি, সীমান্ত নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না।
“আমার মনে হচ্ছে কি যেন বলতে চাচ্ছো”। ওরদিকে তাকিয়ে এটুকু বলতেই,
“এখানে আমার আর চৈতির একটা সৃতি আছে, শুনবেন?”
কেন যেন আজকাল আর পরের গল্প শুনতে মনে চায় না, তবে সীমান্তের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমি যে ওর গল্পের সাথে জড়িয়ে গিয়েছি ! সীমান্তের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম,
“তখন ওর সাথে আমার নতুন সম্পর্ক, সম্পর্ক বলতে ওই টাইপের অফিশিয়ালি কিছু না, তিনদিন ঘুরে অনেক অনুরোধ করার পরে চৈতি আমার সাথে নৌকোতে উঠতে রাজি হয়, অথচ আমার জানাই ছিলো না, ও সাতার জানতো না। সেদিন বুঝেছিলাম অগাধ বিশ্বাস আর প্রবল ভালোবাসা না থাকলে একটা সাতার না জানা মেয়ে গভীর নদী পেরিয়ে এই পদ্মবিলে শাপলা তুলতে আসতে রাজি হত না। ওদিনের ঘটনার পরে আমি যেন অনেকটা ম্যাচিউড হয়ে যাই, বুঝতে শিখেছি কেউ আমাকে ভালোবাসে। পৃথিবীতে এমন কেউ আছে যে আমাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবে, আমাকে কেয়ার করে !
“এমন কি হয়েছিলো সেদিন ?”
“আপনাকে না বলেছিলাম, নৌকাডুবির কথা ! জানেন ভাইয়া, কৈশোরের রোমাঞ্চিত ওই ভাবনাগুলো কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে অস্পষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। সেদিনের নৌকাডুবির কথা এখনো চৈতির মনে দোল খায় কিনা জানি না, তবে নিজের মাঝে চরম অপরাধবোধ ঠিকই কাজ করে। চৈতিবিহীন দিনগুলো আর আগেরমত মধুর হয়না, কখনো কখনো মনে হয় ওর মা স্কুলে গেলেই এই বুঝি ও দৌড়ে এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলল !
সীমান্ত আমাকে ওদের সৃতিতে ফেরায় নিজেকে বড্ড বেশি অংশ মনে হতে শুরু হয়। আমার যে এত মধুর শৈশব ছিলো না, হোস্টেলের বদ্ধ কক্ষে বড় হয়েছি আমি, চারিদিকে প্রকৃতিই যা আমাকে ভালোবেসেছিল। শিতের তিব্রতায় বরফের আস্তরন অথবা সামারের পিচঢালা পথের পাশে যতসব বর্ণিল পাতাগুলো ফিকে হয়ে পড়ে থাকা কোন কিছুই আমাকে আলোড়িত করে না। আমি ফিরে যাই সেই শরতের বিকেলে যেখানে সীমান্ত ছিলো, চৈতি ছিলো আর আমি ছিলাম শুধু ছায়ার মত।
“জানেন ভাইয়া, এতক্ষন বলব বলবো করে কথা গুলো কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। বড্ড বেশি কষ্টগুলো এখন মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমার আবেগ অনুভুতি, ভালোলাগা আজ দুরত্বের কাটাতারে আলাদা করে রেখেছে। আপনি কি করতে যাচ্ছেন আমি জানি না, কি হবে না হবে তাও জানি না। আপনার পদক্ষেপ আমার সৃতিকে নতুন করে বর্তমান করে তুলেছে, নিজের মধ্যে অন্যরকম শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে। নিজের প্রথম চাওয়া, প্রথম ভালোলাগাগুলোর অপুর্নতা পূরনের খোয়ায়েশ যেগে উঠেছে। কিন্তু এই আমি একসময় নিজেকে দিগন্তের যাত্রী মনে করেছিলাম, জানতাম না দিগন্তের খেয়ায় নিজেকে কোথায় নিয়ে যাবো। ভাবতাম, হয়ত চৈতি থাকবে আমার সৃতির পাতায়, আর চৈতিময় ভালবাসার মুহুর্তগুলো জীবন্ত সৃতি হয়ে থাকবে।
সাধারনত কোন কিছু করতে যাবার সময় মানুষ ফলাফল চিন্তা করেই এগোয়, কিন্তু আসলেই কি কোন ফলাফল আসা করা যায় ? আমি আমার করনীয় জানতে পারলেও ফলাফল গড়ে দিতে পারবো না, তবে ওদের প্রথম দেখার মুহুর্তের জন্য যা যা করা দরকার তা হয়ত করবো।
প্রান্তরের পথ পেরিয়ে পুর্বের সিমানা চোখের পাতায় না পেলেও আমি জানি এই বিলের ও মাথায়ও কোন না কোন গ্রাম ঠিকই আছে, তেমনি সব কিছুতেই দিনের শেষে সন্ধ্যা নামার মত কুল খুজে পাওয়া যাবেই। আবার মোরগডাকা ভোরে ঘুম থেকে যেগে ওঠে সবাই হয়ত ঠিকই ছুটবে নিজ নিজ কাজে, নিজ দায়িত্বে। অন্য কারো একাট্টা এই ভালোবাসাময় যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এমন বুঝতে পারছি দায়িত্ব আসলেই কাকে বলে। তাই হয়ত আমাকেও ছুটতে হবে !!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৭:৪৩