আমার প্রথম লেখা।
শুরু করছি ভ্রমণ দিয়ে, স্পেশালি তাদের জন্য যারা প্রতিবেশী দেশ ভারতে বেড়াতে চান। ব্লগে ভ্রমণ নিয়ে অনেক লেখাই পড়েছি কিন্তু “কেরালা” ভ্রমণ নিয়ে লেখা দেখা হয়নি। কেরালারা খুব গর্বভরে নিজেদের প্রদেশ সম্পর্কে বলে God’s own country।
ভ্রমণপিপাশুদের আমার লেখা ভালো লাগলে ধারবাহিক ভাবে লেখবো। আজকের পর্ব, “কোচিন” বা কোচি।
কোলকাতা থেকে সরাসরি কেরালা যেতে সব চেয়ে ভালো উপায় ট্রেন। যদি কর্নাটকা অর্থাৎ ব্যাঙ্গালুরু বেড়ানোর ইচ্ছে না থাকে তাহলে ডাইরেক্ট কোচিন যেতে হবে, আর যদি কারো কর্নাটকা এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে থাকে তবে আগে এই পার্ট শেষ করা উচিত। যাইহোক এটা নিয়ে পরে একদিন লিখবো।
টিপসঃ ভারতের বাইরে থেকে যেসব টুরিস্ট ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে যায় তাদের যাতায়াতের জন্য ট্রাভেল কোটা রয়েছে। সুতারং ট্রেন টিকেটের যতই আকাল থাকুক আপনি টিকেট পাবেনই। এজন্য আপনাকে ট্রাভেল কোটায় বিশেষ কাউন্টারে আবেদন করতে হবে। সুতারং নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ুন। যদিও সব ট্রেনে ট্রাভেল কোটা থাকে না।
কোলকাতা থেকে কোচিন যেতে সব চেয়ে ভালো হবে সপ্তাহে মাত্র একটি ট্রেন যা শনিবার হাওড়া থেকে ছাড়ে। ০২৮৫৩ হাওড়া-এর্নাকুলাম সাপ্তাহিক সুবিধা এক্সপ্রেস। কোচিন পৌছতে মাত্র পাঁচটি স্টপেজ আছে এই ট্রেনে। এই ট্রেনে গেলে সকাল ছয়টায়* পৌছতে পারবেন, যদি আগে থেকেই হোটেল ঠিক করা থেকে তাহলে হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে সকাল আটতার মধ্যে বেরিয়ে পড়বেন।
টিপসঃ হোটেল খরচ বাচাতে রাতের ট্রেনে ভ্রমণ করা উত্তম, এতে টার্গেট করা স্থানসমূহ দিনের ভাগেই দেখতে পারবেন। কোচিনে বেশিরভাগ স্পটগুলো আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই খুলে ফেলে। বেশি জায়গা দেখতে তাই এর আগেই বেরিয়ে পড়া ভালো। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে দক্ষিণ ভারতের শহরগুলোতে ট্যাক্সি বা অটোর ভাড়া বেশি হয়, সুতারং অটো বা ট্যাক্সির চেয়ে এসব যায়গায় বেড়াতে পাবলিক বাস ব্যাবহার করাই শ্রেয়। যাওয়ার আগে হোটেল আর সাইটসিইং নিয়ে একটু স্টাডি করা উচিত, সব চেয়ে ভালো হয় হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব থাকলে ! গুগল ম্যাপের সাহায্যে অধিকাংশ বড় শহরের ট্রাফিক, যাতায়াতের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের নাম্বার, স্টপেজ ও দূরত্ব সম্পর্কে আইডিয়া পাওয়া যাবে। আগের রাতে এগুলো দেখে বের হলে সময় বাচবে আর অল্প সময়ে ঝামেলাহীন ভাবে কম খরচে ঘুরে দেখা যাবে। সমুদ্রের আসেপাশের শহরগুলোতে সাধারণত স্কুটার, মোটর বাইক ও সাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়, ভালো অভিজ্ঞতা থাকলে নিয়ে নিতে পারেন একটা। খরচ বাচাতে আর অনেক বেশি জায়গা দেখতে সাইকেলের ভূমিকা অনন্য। সব সময় সাথে স্যালাইন রাখবেন। সকালে বের হবার আগে স্যালাইন খেয়ে বের হবেন।
কোচিনে শুরু করুন ফোর্ট কোচির দিক থেকে, এর্নাকুলাম থেকে ফোর্ট কোচির বাসে মাটনচেরিতে নামুন। কারন এই অংশে নামলে আপনি সহজে সাইকেল ভাড়া পাবেন মালামাল রাখার জন্য লকার ভাড়াও করতে পারবেন। পশ্চিম কোচিনের কেন্দ্র এটা। আবার বলছি কচিনের এই অংশ দেখতে সাইকেলের চেয়ে উত্তম বাহন আর নেই। খরচ বাচবে আর বেশি জায়গা কভার করতে পারবেন।
ডাচ প্যালেসঃ মাটনচেরিতে নেমে প্রথম ঘুরে আসুন ডাচ প্যালেস। পনেরশো শতাব্দীতে কোচিনে পর্তুগিজদের ছিল ব্যাপক প্রভাব। মাটনচেরির এই প্যালেস বর্তমানে জাদুঘর হিসাবে রাখা হয়েছে। সকাল দশটায় খোলা আর সন্ধ্যা ছয়টায় বন্ধ হবার আগে দেখে ফেলুন ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের প্রভাব প্রতিপত্তির নিদর্শন, ১০ টাকা মুল্যের টিকেট কেটে উঠেপড়ুন প্যালেসে দোতলায়। ভুল করেও ক্যামেরা বের করতে যাবেন না
বাইরে রোদ ! ঘুরাঘুরি করবেন ভালো কথা, একটু কেনাকাটাও হয়ে যাক। প্যালেস থেকে বেরিয়ে দেখেন না বাইরেইতো এ্যান্টিক সব জিনিশপত্রের দোকান সাথে পাবেন হস্তশিল্প, কেনাকাটা করেন আর না করেন দামাদামি করেন, এখানে এতাই আনন্দ খুব অল্পদামের ছোট কিছু কিনলেও খুশি হবে ওরা। শিল্পে প্রেম থাকলে সাইকেলের তালা খুলুন বেরিয়ে পড়ুন একটু পাশেই।
জিউ টাউনঃ ভারতীয় বাণিজ্য প্রসারে জিউজ বা ইহুদীদের ভূমিকা ছিল অনন্য, দিনে দিনে ইহুদীরা ভারত ছেড়ে ইসরাইলে চলে গেলেও এখনো দেখা মিলবে হাতে গোনা ১২/১৩ ইহুদী বৃদ্ধার। কথা বললে বুঝতে পারবেন সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও দেশভক্তিতে ওরা কতটা এগিয়ে। জিউ টাউনের রাস্তায় রয়েছে সব চেয়ে বড় হস্তশিল্প ও এ্যান্টিক সপগুলো, পুরো কোচিনের সব চেয়ে বড় স্পাইচ সপ বা মশলার দোকানগুলোও ছোট এই জিউটাউন এরিয়ায়। বর্তমানে জিউ টাউনে অবশিষ্ট থাকা সবচেয়ে বড় আকর্ষন “পরদেশি সিনেগগের” ১৫৫৫ সালে শেষ হওয়া ভারতীয় ইহুদীদের সবচেয়ে পুরানো ধর্মিয় উপাসনালয়।
সান্তাক্রুজ ক্যাথেড্রাল বাসিলিকাঃ সুরুতেই বলেছি সাইকেল দরকার, সিনেগগ থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দুরের পথ সান্তাক্রুজ ক্যাথেড্রাল। ফোর্ট কোচি এরিয়ার মধ্যে হওয়ায় টুরিষ্টদের আগমন একটু বেশিই। চার্চের সব চেয়ে আকর্শনিয় দিক এর ভেতরে বাইরে বিলাসী আর্কিটেক্ট ডিজাইন। বেলা ১১টার পরে টুরিষ্টদের জন্য উন্মুক্ত, চাইলেই ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতে পারেন। ঘুরাঘুরি শেষ করতে হবে প্রার্থনা শুরু হবার পূর্বেই, প্রার্থনায় শরিক হবার ইচ্ছে থাকলে নিশ্চুপ বসে পড়ুন। যে ধর্মেরই হোন, একটা হলি ভাব পাবেন। সনাতনী হিন্দু ভাইবোনেরা ঘুরে আসুন পাশেই তিরুমালা দেবাস্রমে !!
হলি হলি ভাব কাটিয়ে উঠতে চেখে নিন স্পাইসি কোন স্ট্রিট ফুড আইটেম। যাদের লিমিটেড টাইম তারা এগুলো ঘুরে দেখতে কোন ভাবেই বেলা দুটোর বেশি লাগাবেন না।
মহত্মা গান্ধি বিচ রোডঃ ফোর্ট কোচির ভালোলাগার জায়গা এটা। আরব সাগরের মাঝে ভেসে বেড়ানো বাহারী মাছ ধরা নৌকা আর ঢেউএর আড় দিয়ে আসা বাতাস অন্যরকম এক স্বাদ দেবে যা সাধারণত অন্য সৈকতে পাবেন না। এই বিচরোডে বসে থাকার চেয়ে সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো উত্তম। যারা ফোর্ট কোচিতে রাত্রিযাপন করবেন তারা এখানে আসবেন সন্ধার আগে আগে। বিচ রোড বেয়ে পুর্বের দিকে আসলে পাবেন ফোর্ট কোচির প্রধান পর্যটন আকর্শন।
চাইনিস ফিশিং নেটঃ আমার কাছে বিকেলের সময়টা এখানে দেওয়াই উত্তম। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো ফিশিং স্টাইল ধরে রেখেছে এরা। বিশাল বিশাল এই মাছ ধরার পদ্ধতি আমাদের দেশে একটু ছোট আকারে রয়েছে, আঞ্চলিক ভাষায় আমরা ভ্যাশাল বলি। মাছ তোলার সময় নানা রকমের গান গেয়ে চলে ওরা। আপনি চাইলেই সদ্যতোলা মাছ কিনে সেতা এখানে বসেই ঝাঝালো মশলায় ভাজতে পারেন। ওহ ইয়ামি চাইনিস ফিশিং নেট ফোর্ট কোচির লোকদের গর্বের ঐতিহ্য।
শিল্পী সাহিত্যপ্রেমীরা টু মারুন “কাশি আর্ট গ্যালারী”তে অদ্ভুত সুন্দর আর শৈল্পিক নিদর্শনে ভরা এমন গ্যালারী কমই মেলে। প্রতিদিন আলাদা আলাদা এক্সজিভিশনতো রয়েছেই, রয়েছে ক্যাফেও। ফোর্ট কোচিতে এসে কাশি আর্ট গ্যালারির ক্যাফে থেকে কফির টেস্ট না নিলে সব কিছু বৃথা।
সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চঃ ২৪ ডিসেম্বর ১৫২৪ সালে ভাসকো ডা গামার মৃত্যুর পরে এখানে সমাহিত করা হয়েছিলো। পরে অবশ্য পর্তুগিজরা পরে তার দেহবশেষ তুলে নিয়ে যায়।
ফ্রান্সিস চার্চ থেকে বের হয়ে ঘুরে আসুন প্যারেড গ্রাউন্ড, আর বিচ মিউজিয়াম। এত কিছুইতো দেখলেন, গ্রিনিক্স ভিলেজে টু মেরে আসুন। ওখানে কথাক্কলির ডান্স চলছে, সারাদিন ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক নৃত্যানুষ্ঠান চলবে রাত দশটা অব্দি। আপনার শেষ দেখা হয়ে গেলো ? অকে বেরিয়ে পড়ুন মাটনচেরিতে, আপনার সাইকেলটি ফেরত দিতে হবে না ? এরপরে যে আরো কিছু আছে!!
ফোর্ট কোচির এবারের আকর্শন বোট টুর আসুন এবারও মেলার রথে চড়ি কলা বেচি। যেখানেই যাই আমাদের যে এর্নাকুলাম ফিরে আসতে হবে। মাটনচেরি বোট জেটি থেকে সন্ধায় বোটে চড়ে বসুন, নামবেন এর্নাকুলাম জেটিতে। এই সময়টায় আপনি উপভোগ করতে পারবেন আরব সাগরে সুর্যাস্তের অপুরুপ সৌন্দর্য। যাবার পথে আপনি গিয়েছিলেন বাসে ফিরলেন বোটে। এর্নাকুলাম বোট জেটি থেকে সামান্য দূরে কোচি মেরিন ড্রাইভ ওয়াকওয়ে। ঘুরতে যখন আসছেন এটাওবা বাদ যাবে কেন ? অসাধারন সুন্দর যায়গাটি আপনাকে মুগ্ধ করবে।
এতক্ষনে হাপিয়ে গেছেন না ? এত যায়গায় ঘুরালাম, খাওয়ানোর ব্যাপারে বলা হয়নি। দিনের বেলা ঘুরাঘুরিতে লাইট খাবার খাওয়াই ভালো এতে পেট সুস্থ থাকে। স্পেশালি ফোর্ট কোচির আবহাওয়ার সাথে নিজেকে মিলিয়ে রাখতে দুপুরে ভারী খাবার না খাওয়াই উত্তম। তবে রাতে কেনাকাটা করতে চাইলে লুলু হাইপার মল রয়েছে, সেখানেই পাবেন উন্নত ফুড কোট, স্থানীয় ও ওয়েস্টার্ন খাবারের সব আইটেমই একই সাথে পাবেন। আর বাইরে গেলে আমি “পাই দোসা" নামক একটা রেস্টুরেন্ট রিকমান্ড করি।
দিনের ঘুরাঘুরি এটুকুতেই, যারা কোচিন শহরের জন্য মাত্র একদিনের সময় নিয়ে যাবেন তাদের জন্য এটাই বেস্ট প্লান তবে যদি দু দিনের হয় তবে পরেরদিন ঘুরে আসুন হিল মিউজিয়াম, ও কোডানাড এলিফ্যান্ট ট্রেনিং সেন্টার।
আজকে এটুকুই, আমি শুধু কোচিন শহরের বা আশেপাশের দৃশ্য এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করেছি। আপনাদের ভালো লাগলে পরবর্তিতে কেরালার অন্য টুরিস্ট স্পটগুলো দেখাতে চেষ্টা করবো।
কেরালা ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্বের লিংক
*লং রুটে মাঝে মাঝে ট্রেন পৌছতে লেট করে।
*ছবিগুলো কিছু নিজের আর কিছু বন্ধুর তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৫:১৩