কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমে ভর্তুকি বাবদ ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও পরে তা ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কৃষির একটি প্রধান উপকরণ হল বীজ। কৃষকদের মাঝে উন্নতজাতের বীজ সরবরাহ কার্যক্রমের আওতায় অগামী অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৫০ এবং ৮৪ হাজার ৮৩৮ মেট্রিক টন উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বীজ সংরক্ষণের জন্য বীজ গুদামের ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার মেট্রিক টন থেকে ১ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত করার কার্যক্রম চলছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১২ লক্ষ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ এবং ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত এলাকার ৫০ শতাংশ জমিতে লবণাক্ততা প্রতিরোধক ব্রি-৪৭ ধান আবাদের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার।
মৃত্তিকা জরিপের মাধ্যমে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা, ভূমিসম্পদ চিহ্নিতকরণ এবং উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী সঠিক ফসল উৎপাদনের পদক্ষেপ এ বাজেটে গ্রহণ করেছে সরকার।
সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জমির জলাবদ্ধতা নিরসন, হাওর এলাকায় পানি নিষ্কাশন করে জমির আওতা সম্প্রসারণ ও একাধিক ফসল উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিয়ে গত বাজেটে ৪২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এসব কাজ করার জন্য ৩৭৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৬৬টি কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ খাতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এপ্রিলে ২০১০ পর্যন্ত কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। আগামী অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে বলে তিনি জানান।
কৃষি গবেষণার মাধ্যমে ফসলের উন্নতজাত ও উন্নত উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গত বাজেটে ১৮৫ কোটি ২১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ অর্থ উন্নতজাতের ধান, বিশেষ করে লবণাক্ততা ও বন্যার পানি সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনসহ কৃষি গবেষণা কার্যক্রমে ব্যয় হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে ইতিমধ্যে গঠিত কৃষি গবেষণা ফান্ড সচল করা হচ্ছে। এই ফান্ডের আকার বর্তমানে ৪১২ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। শস্যবহুমুখীকরণের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এন্ডাওমেন্ট ফান্ডে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের জন্য গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে। কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের নিমিত্তে সারাদেশে ‘কৃষক বিপণন দল’ ‘কৃষক ক্লাব’ গঠনের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে ১২৮টি ও জেলা পর্যায়ে ৩০টি কৃষি বাজারের উন্নয়ন সাধনের পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের ১৫টি জেলায় ১টি করে পাইকারি বাজার অবকাঠামো এবং ১৬টি জেলায় ৬০টি গ্রোয়ার্স মার্কেট অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এ সকল বাজারের সাথে লিংকেজ তৈরির জন্য ঢাকার গাবতলীতে একটি সেন্ট্রাল মার্কেট নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের উৎপাদিত শস্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট হওয়ার কারণে তাদেরকে শস্যমূল্য সহায়তার জন্য ‘কৃষিবীমা’ চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও এ খাতের সার্বিক উন্নতি সাধনের জন্য জাতীয় কৃষিনীতি, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি, জাতীয় বীজনীতি, সমন্বিত সার বিতরণ নীতিমালা এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের জাতীয় কৃষিনীতি যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ‘জাতীয় কৃষিনীতি ২০১০’ প্রণয়নের কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদের কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মাছ, দুধ, মুরগি ও গবাদিপশু উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই ‘জাল যার জলা তার’ নীতির বাস্তবায়নের নিমিত্তে ‘সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০০৯’ প্রণয়ন করেছে। জাটকা নিধন প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ এবং চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় সে সম্পর্কেও সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।
মাংস ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে খামারিদের প্রণোদনা এবং সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম চলছে। প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সিমেন উৎপাদন, প্রুভেন ষাঁড় উৎপাদন, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম এবং ভ্রুণ স্থনান্তর প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে গবাদিপশুর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য উন্নয়ন ও শংকরজাতের পশুসংখ্যা বৃদ্ধি কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
আগামী অর্থবছরে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪১ কোটি ৩৬ লক্ষ ডোজ। টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য টিকা উৎপাদন প্রযুক্তি আধুনিকীকরণ ও গবেষণাগার সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। স্বল্পমূল্যে হাঁস-মুরগির বাচ্চা সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য হ্যাচারিসহ আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার স্থাপন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ৮৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পেশ করেন তিনি।
পানিসম্পদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, নদী খনন, পানি ধারণ, বন্যা-নিয়ন্ত্রণ, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, লবণাক্ততা রোধ এবং সমুদ্র হতে ভূমি উদ্ধার প্রকল্পসহ গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের মত বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য শক্তিশালী কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ‘পানি ব্যবহার নীতিমালা’-এর খসড়া প্রণয়ন এবং ‘পানিসম্পদ পরিকল্পনা আইন, ১৯৯২’ সংশোধন করা ও সেচ সুবিধার জন্য আগামী অর্থবছরে ১৫ হাজার হেক্টর এলাকায় সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে। এ ছাড়াও ২৫ কিলোমিটার সেচ খাল খনন, ৩৭০ কিলোমিটার পুনঃখনন, ২০টি সেচ অবকাঠামো নির্মাণ এবং ৭০টি অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ ও ৩টি রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হবে। এর ফলে প্রান্তিক ও দরিদ্র চাষিরা সেচ সুবিধা পাবে এবং ৩ কোটি কর্মদিবস কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এ প্রেক্ষিতে উপকূলীয় অঞ্চলে সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। লবণাক্ততার ঝুঁকিপূর্ণ বর্তমান ২৬.৩৭ লক্ষ হেক্টর এলাকার মধ্যে প্রায় ১২.৪০ লক্ষ হেক্টর রক্ষা করা হয়েছে এবং এভাবে প্রতিবছর অতিরিক্ত ২০ হাজার হেক্টর এলাকাকে লবণাক্ততামুক্ত করার কর্মসূচি নেয়া হবে। উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ১৮ হাজার হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া প্রায় ১১ হাজার ৫৫ হেক্টর এলাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠির ১৬ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকার মানুষ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অধিক গরিব। আগাম পাহাড়ি ঢলে এসব এলাকায় ফসল প্রায়ই নষ্ট হয়। ফসল রক্ষা এবং ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষাসহ হাওর এলাকার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সমগ্র হাওর ও জলাভূমির অতীত ও বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করে লাগসই ও টেকসই প্রায়োগিক কৌশল ও ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত মাস্টার প্লান তৈরি করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরে পানিসম্পদ খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পল্লী উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ সরকারের একটি প্রতিশ্রুতি প্রকল্প। প্রকল্পটি ২০০৯ হতে ২০১৪ মেয়াদে মোট ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ৫টি গ্রাম এবং প্রতিটি গ্রাম থেকে ৬০টি পরিবারকে এ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এতে ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪০০ পরিবারকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা যাবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২৯ লক্ষ।
খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, অতিরিক্ত প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সে লক্ষ্যে খাদ্যশস্য সংরক্ষণে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চলতি অর্থবছরে দেশের উত্তরাঞ্চলে ১৩৯টি খাদ্যগুদাম নির্মাণ কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে ২ লক্ষ ১৯ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৩৩৩টি নতুন খাদ্যগুদাম নির্মাণের লক্ষ্যে ২টি প্রকল্প একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১০ বিকাল ৫:০৪