এদিকে আমির আলীর ছেলে ছলিম আলীর সাথে কথা বলে জানা গেল অন্য তথ্য। মেট্রিক পাশ করার পর আর্থিক দুরবস্থার কারণে পৈতৃক জমিজমা চাষে চলে আসেন তিনি। বাজেট সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কৃষকদের নানা চাহিদার কথা তুলে ধরে বলেন, এ বছর সবকিছু কৃষকদের অনুকূলে থাকলেও বোরো উৎপাদনের জন্য আমরা বিদ্যুৎ ঠিকমত পাইনি, বীজ-সারে ভেজাল, উৎপাদিত বোরো ফসলের দাম ঠিকমত পাচ্ছি না। সেচের ব্যাপারে সরকার যে ভর্তুকি দেয় তার সুফল কৃষকরা পায় না। দশ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো নানাভাবে হয়রানি করে। ছলিম আলীর মত আরো অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রি নিয়ে কৃষি কাজ করছে। তাদের বাজেট নিয়ে রয়েছে নানা ভাবনা। একটাই কথা, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের বাজেটে প্রাধান্য দিতে হবে কৃষি খাতকে। গত অর্থবছরের বরাদ্দর চেয়ে এ অর্থবছরে তারা কৃষি খাতে বেশি বরাদ্দ চায়। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য চায়।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট আগামী ১০ জুন প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হবে। বাজেটে জ্বালানি আর কৃষি খাত সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। আগামী বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে কৃষি খাতের জন্য ৭ হাজার ৬’শ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু কৃষিতেই ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা বেশি। ইতিমধ্যে কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পানি সম্পদ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫’শ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি। এর আওতায় কৃষি খাতে ৫৯টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৩ হাজার ৬’শ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৩.১৬ শতাংশ। পরে আবার ৬০০ কোটি টাকা এর সাথে যোগ করা হয়েছিল। আমরা বিগত অর্থবছরগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই কৃষি খাতে ভর্তুকি ক্রমশ বাড়ছে এবং কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ৬০০ কোটি টাকা। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ৩০০ কোটি টাকা। ২০০২-০৩ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ২০০ কোটি টাকা। ২০০১-০২ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ১০০ কোটি টাকা।
কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়লে আমাদের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আয়তনে ছোট এই দেশটিতে অধিক জনসংখ্যার কারণে বছরে আমাদের খাদ্যের চাহিদা ২ কোটি ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটি টন। দেশের মোট আবাদি জমিতে আমন, বোরো, ভুট্টাসহ নানা প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন হয়। বিবিএস-২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী চাল উৎপাদন হয় ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন, গম উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬ মেট্রিক টন। ডিএই প্রদত্ত তথ্যনুযায়ী চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন, গম ৯ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন এবং ভুট্টা উৎপাদন হয় ১৩ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া নানা ধরনের শস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর বৈরিতায় উৎপাদনে ক্ষতি না হলে চাহিদা মিটিয়ে দেশে অতিরিক্ত চাল মজুদ থাকে। কিন্তু বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলে অতিরিক্ত খরার কারণে মরুকরণ শুরু, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে অনাবাদি পড়ে থাকা জমি, অকাল বন্যা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে। সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। গবেষণা করতে হবে বর্তমানের সাথে খাওয়ানো কৃষি নিয়ে। বাজেটে এদিকে থাকতে হবে বরাদ্দ।
কথায় আছে কৃষিতে এক টাকা ভর্তুকি দিলে তা কয়েকগুণ বেশি হয়ে ফিরে আসে। বিশ্বের যে দেশ কৃষিতে যত বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে সে দেশের ভিত তত মজবুত হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কৃষিতে গড়ে ভর্তুকি দিয়ে থাকে নরওয়ে ৭৭, ফিনল্যান্ড ৭১, জাপান ৬৬, সুইডেন ৫৯, কানাডা ৪৫, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ১২টি দেশ ৪৯ ও শিল্পোন্নত বিশ্ব ৪৫ শতাংশ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের ৩.১৬ ভতুর্কি সে তুলনায় খুবই কম। জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন-সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সে পথে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি।
রাসায়নিক সার দিন দিন মাটির উর্বরা শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে রাসায়নিক সার আমদানির পাশাপাশি জৈবসার উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সেচে বিদ্যুৎ ও ডিজেলে ভর্তুকি বাড়ানোসহ তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক যাতে সে সুবিধা ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। ভারতে একজন কৃষককে তার বিদ্যুৎ বিলের ৮০ শতাংশ ভতুর্কি দেয় সরকার। ভাল বীজ ভাল ফসল। বীজে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ের বীজ সংরক্ষণ করতে হবে এবং খারাপ বীজ নিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফসল সংরক্ষণের জন্য হিমাগার, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা তৈরি, পোল্ট্রিতে বাচ্চা ও খাবারের দাম কমানো, উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য, মাছ চাষে ভূমি উন্নয়ন কর কমানো, অতিরিক্ত ফসল সংরক্ষণে হিমাগার তৈরি ইত্যাদি সরকারের মাথায় রাখতে হবে কৃষিকে এগিয়ে নিতে। সর্বোপরি কৃষি বাজেট যদি আলাদাভাবে পেশ করা হয় তাহলে কৃষির সাথে কৃষির উপখাতগুলোও অধিক বিবেচনায় আসবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ বিকাল ৪:২৮