বহতা নদী আজ থেমে গেছে। দূষণের ভার বইতে পারছে না। শুধু নদী নয়, দূষণের এ ভার আমাদের গায়েও এসে পড়ছে। নানাভাবে দেশের মানুষ আজ শিকার এ দূষণের। টলটলে স্বচ্ছ জল আজ কলকারখানার নানা রঙে রঙিন হয়ে মানুষের ভেতর অসুখ-বিসুখ থেকে শুরু করে জীব-বৈচিত্র্য বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে বাতাসও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। নদীর জলকে জল না বলে বিষ বলেও অত্যুক্তি হয় না। নির্গত শিল্প-বর্জ্যে নদী-জলাশয়গুলো মারাত্মকভাবে দূষণের কারণে ৪০ লাখ মানুষ আজ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। ফলে এর ওপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠির শারীরিক স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে।
ঢাকার আশেপাশেই আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে নদীগুলো এক সময়ের জন্য আর্শীবাদ হলেও এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এক গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিদিন দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গৃহস্থলি বর্জ্যরে বিপরীতে প্রায় ৭ হাজার শিল্প ইউনিট থেকে নির্গত ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘনমিটার শিল্পবর্জ্য মূলত খাল-নদী-জলাশয় দূষণের জন্য শতকরা ৬০ ভাগ দায়ী। রাজধানীর চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বংশী, বালু নদীর প্রায় ১১০ কিলোমিটার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আজ দুর্বিষহ দূষণের শিকার। নৌ যোগাযোগককে প্রাধান্য দিতে এই সব নদীর তীরে গড়ে উঠেছে মিল-কারখানা। এসব নদীতে সরাসরি মিলের বর্জ্য এসে পড়ার কারণে পানি হয়ে উঠছে বিষ। ডাইং ইউনিটগুলোতে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট চালু না হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ পরিবশে দূষণের শিকার হয়ে জন্ডিস, ডায়রিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালী ও কিডনীজনিত রোগ, চর্মরোগসহ ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি নদীর পানি বিষাক্ত হওয়ার ফলে দেখা দিচ্ছে মাছের মড়ক। আবাদি ফসলের জমি হয়ে যাচ্ছে অনাবাদি। গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শুধু বেসরকারি উদ্যোক্তারাই নয়, বপজার অধীনস্থ ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলসহ অন্যান্য অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও ক্রমাগত মারাত্মক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। ঢাকা শহরাঞ্চলের ৪ হাজার মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আশপাশের অঞ্চলের আরো ৩ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০২টি ছাড়া বাকি শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখনো পর্যন্ত ইটিপি চালু করা হয়নি। ফলে এসব কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক মিশ্রিত গাঢ় কালো ও বেগুনি রঙের দূষিত বর্জ্য অবাধে নদীতে ফেলা হচ্ছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে নদীগুলোকে দূষণরোধ করার নজির রয়েছে। এমনকি ভারত সরকার গঙ্গা নদী দূষণরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী সরকার নদ-নদীসহ পরিবশের ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ নিলেও তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
নদী দূষণের ৬০ ভাগ হচ্ছে শিল্প বর্জ্যে আর ৪০ ভাগ হচ্ছে পয়োপ্রণালীর বর্জ্যরে মাধ্যমে। এসব নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে এ্যালুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম, লেড, মার্কারি ও ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা গেছে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বুড়িগঙ্গায় এর মাত্রা শূন্য দশমিক ৫ এর নিচে। বর্ষার সময় এর পরিমাণ গড়ে ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম। অথচ প্রতিলিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৮ মিলিগ্রামের ওপর থাকলে সে পানিই কেবল ব্যবহারের উপযোগী। ৫ মিলিগ্রামের নিচে থাকলে তা দূষিত পানি হিসেবে বিবেচিত হয়। ২ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেলে মাছসহ জলজপ্রাণী বেঁচে থাকার কোনো সম্ভবনা থাকে না।
ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্টস, ডায়িং, ওয়াশিং, প্লাস্টিক, পলিথিন, চামড়ার কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে বর্জ্য গিয়ে মিশছে বুড়িগঙ্গাতে। এদিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৬০ মাইল বিস্তুৃর্ণ শীতলক্ষ্যার অবস্থাও করুণ। নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশাল পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ৫শ’র বেশি ডাইং কারখানা। লাখ লাখ টন তরল কঠিন বর্জ্য এসে নদীতে পড়ছে ফলে নদীর পানিতে বাড়ছে দূষণ।
তুরাগ নদীও দূষণে ভরে উঠেছে। টঙ্গি বিসিক এলাকার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য মিশে নদীর আজ এই হাল। রাজধানীর উত্তরাংশে বালু নদীর দূষণ পৌঁছেছে চরমে। রামপুরা বাড্ডা এলাকার পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সরাসরি বালু নদীতে এসে পড়ছে।
১৬১০ সালে যখন ঢাকাকে মুঘল রাজধানী করা হয় তখন বুড়িগঙ্গার তীর ছিল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে অমাত্যবর্গ ও সুবেদাররা সেখানেই নির্মাণ করেছিলেন সুরম্য প্রাসাদ। নদীর বুকে রঙ-বেরঙের পাল তোলা নৌকা আর ভেপু বাজিয়ে লঞ্চ চলার মনোরম দৃশ্য সবাই মুগ্ধ করতো। ভাটিয়ালি সুরে মাঝিদের গান উদাস করত দু’পাড়ের মানুষদের। জলজ প্রাণীরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াত স্বচ্ছ জলে। এক সময় এ নদীর পানি অনেকেই পান করতেন, নদী পাড়ে হাওয়া খেতে আসেন হাওয়াসেবীরা। আজ সেদিনের সে চিত্র আর নেই। শুধু বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা নয়, দেশের ৩৬০ নদ-নদী কোনো না কোনোভাবে দূষণের শিকার।
জাতীয় পরিবেশ নির্বাহী কমিটিতেও বিষয়টি বারবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে নদী দখল, জরিপ, ড্রেজিং, বর্জ্য অপসরণসহ নদী রক্ষায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের সদ ইচ্ছা আর আমাদের সচেতনতাই পারে নদী দূষণের কবল থেকে নদ-নদীকে রক্ষা করতে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৭