দর্শকের হৈ হুল্লোড় শুনে বঝা গেলো তারা একটা কিছু expect করছে। expect তো করবেই, ইউ টিউবে জিরো ডিগ্রী মুভির ট্রেইলারে বলা হয়েছিলো Expect unexpected। ওই লাইনটির অসঙ্গতি তুলে ধরে একজন কমেনন্ট করেছিলো expect the unexpected হবে। গত কয়েকদিনের ব্যাপক প্রচারণা আর ফেসবুকে প্রশংসা দেখে ছবিটি প্রতি আমারো expectation টা একটু বেশীই ছিলো। তা মনিকা কি পেরেছিলো দর্শকদের expectation মেটাতে? সেই রহস্য জড়ানো থাক মনিকার তোয়ালেতে। আমি বরং সেই কমেন্টদাতার মতোই গল্পের কিছু অসংগতি তুলে ধরে ব্যাখা করতে চাই পরিচালক অনিমেষ আইচ কতটুকু প্রত্যাশা মেটাতে পারলেন।
“রাতের বেলা বোরখা পড়ে খঞ্জর হাতে মারিয়া ব্যাস্ত কাচা বাজারে তাড়া করছেন আরেকজনকে। বাজারের বাকি লোকদের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই, তারা তাদের মতো বাজার সদাই করছে। মারিয়া লোকটিকে খুন করলেন, লোকজন চারপাশে জমা হয়ে সেটি ভিডিও করতে লাগলো। খুন শেষে মারিয়া লক্ষী খুকীর মতো ভীড় থেকে বের হয়ে আসলেন,লোকজন সরে জায়গা দিলো। আরো পরে দেখা গেলো পুলিশ সেই খুন নিয়ে আলোচনা করছে।পুলিশ তো চাইলেই যারা ভিডিও করেছিলো তাদের থেকে ফুটেজ নিতে পারতো ।এই ফেসবুকের জামানায় কেউ ঐ ভিডিও শেয়ার দেয় নাই এটা বিশ্বাসযোগ্য না। আপনি হয়তো বলতে পারেন ডিরেক্টরের কাছ থেকে এতো বিস্তারিত কেন চাচ্ছি? গোটা সিনেমাতে কয়েকবার ডিরেক্টর অযথাই ডিটেইলসে গিয়ে এই expectation তৈরী করেছে।
অসংগতি বলতে গিয়ে খুনের যে ঘটনার কথা বললাম সেটি সিনেমার গল্পের শেষ ভাগের দৃশ্য থেকে নেয়া হয়েছে। সাধারণত থ্রিলার মুভিতে বাড়তি রহস্যযোগ করার জন্য গল্পের শেষের দিকটাই প্রথমে দেখানোর একটি ট্রেন্ড আছে। গল্প বলার এ পদ্ধতিকে বলা হয় reverse chronology (লিঙ্ক) . কিন্তু জিরো ড্রিগ্রী মুভিতে প্রথমার্ধে গল্প বলার ভঙ্গি ছিলো chronological মানে একজনের গল্প একদম প্রথম থেকেই শুরু করা আর দ্বীতিয়ার্ধে ছিলো প্যারালাল মানে কয়েকটি গল্প পাশাপাশি বণর্না করা, সেই সাথে ছিলো কোন গল্পে অযথা ডিটেইলসে যেতে গিয়ে অসংগতিতে ঢুকে পড়া। এর ফলে থ্রিলার দাবি করা গল্পের গতি দ্বীতিয়ার্ধে বেশ শ্লথ হয়ে গিয়েছে। আরেকটি উদাহরণ দেইঃ
মিউজিশিয়ান মুশফিকের সাথে রীনার দ্বন্দ্ব দেখানো হলো। যদিও সিঙ্গাপুরে তারা বিয়ে করে আছে, নাকি লিভ টুগেদার করছে নাকি আলাদা আলাদা বাসায় আছে সেই ডিটেইলসে যাওয়া হয় নাই। জেমসের গান শুরু হতেই দর্শক কড়তালি দিয়ে উঠে এবং সেই গান চলাকালে রীনার সাথে মুশফিকের মৃদুমন্দ জাপ্টাজাপ্টির দৃশ্য দেখানোতে বোঝা গেলো তাদের ভেতরে দ্বন্দ চরমে উঠেছে। এদিকে মিলন ফোন করে রীনাকে জানায় সে সিঙ্গাপুরে এসেছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে তার ভয়েস ন্যারেশনে জানা যায় সে রীনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চায়। রীনা পালাতে চাইলে মুশফিক বাধা দেয় এবং দুইজনের একটি ফাইনাল জাপ্টাজাপ্টি শেষে মিললো রীনা মুক্তি পায়। সে বাংলাদেশে এসে মিলনকে ফোন দিয়ে বলে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি। এর আগে দেখানো হয় মিলনও সিঙ্গাপুর থেকে এসে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কিন্তু তারা তো দেখা করলে সিঙ্গাপুরেই দেখা করতে পারতো? তাহলে মিলনকেই বা সিঙ্গাপুরে নেবার কারণ কি?
রীনা আর মুশফিকের জাপ্টাজাপ্টি দেখে আমার পেছনের সারির সিটে বসা এক আপু বলে উঠলেন “একের পর এক রেসলিং ম্যাচ দেখতে ভালোই লাগতেছে”। উল্লেখ্য, পূরো সিনেমা জুড়ে গল্পের সাথে রেসলিং করেছেন ডিরেক্টর অনিমেষ আইচ নিজেই। ডব্লিউ ডব্লিউ ই রেসলিং-এ প্রায়ই দেখা যায় ম্যাচ চলাকালে একে অপরকে পিটাবার পর দুইজন রেসলারই রিং-এ কুপোকাত আর তখন রেফারি কাউন্ট করতে থাকে। ছবির এক পর্যায়ে এসে মনে হয়েছে কিছু ঘটনা স্রেফ সময় কাউন্ট করে যাচ্ছে, মূল গল্প আর ডিরেক্টর দুইজনই রেসলিং করে কাইত। সেই সময়টুকু চিয়ার করার মতো কিছু না পেয়ে কয়েকজন দর্শক বিনোদনের দায়িত্ব নিজেদের কাধে নিয়ে নানা কমেন্ট করতে শুরু করলো। রীনার একটি ডায়ালগ ছিলো “মুশফিক আমাকে ভালোবেসে পেটায়” বা এই টাইপ কিছু (মনে রাখার মতো কোন ডায়ালগ ছবিতে নেই)। একজন বলে উঠলো “বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তো একটু মাইরাই খেলে”।
এতক্ষণ যে চরিত্রগুলোর নাম বললাম সেই নামে আসলে জিরো ডিগ্রীতে কোন চরিত্র নেই। আমি ইচ্ছে করেই নামগুলো ওলটপালোট করে দিয়েছি। হুবুহু নাম দিলে রিভিউ পড়েই হয়তো অনেকে হলে যাবার চিন্তা বাতিল ককরে দিতেন বা হলে গেলেও কি হতে যাচ্ছে আন্দাজ করে নিতেন। আমি তো ধরা খেয়েছি ট্রেইলার দেখেই। সিনেমায় ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ও ইন্টারেস্টিং চরিত্র হলো ওয়াহেদ। আপনি যদি ট্রেইলার ভালো করে দেখেন তাহলে আগেই আন্দাজ করে ফেলবেন ওয়াহেদ এর ভূমিকা কি হবে। ডিরেক্টরের উচিত ছিলো ট্রেইলার থেকে এটি কেটে দেয়া। থ্রিলার ছবি ‘উধাও’ নিয়ে সামইয়োয়ারইনে আমার লেখা সর্বশেষ মুভি রিভিউতেও অভিনেতা অনিমেষ আইচকে ট্রল করেছি তবে অভিনেতা হোক বা পরিচালক হোক, তিনি যদি বাংলাদেশে থ্রিলার ঘরানার কোন ট্রেন্ড এনে দিতে পারেন আমি সেটিকে সাধুবাদ জানাবো। ছবিটি কিন্তু অনেকের কাছে ভালোও লেগেছে, তবে বাংলা সিনেমার দর্শকদের এই নতুন ধারা নিয়ে এখনো কোন কালেকটিভ চয়েস তৈরী হয়নি তাই ভালো লাগাটা অনেকটাই individualistic। যেমন আমার পেছনের সীটের আপুর এটি ভালো লেগেছে রেসলিং হিসেবে, বা অন্য কারো কাছে নতুন কিছু করার চেষ্টা হিসেবে।অনিমেষ আইচের এই চেষ্টা যদি আপনি স্বচোক্ষে হলে গিয়ে দেখতে চান, তাহলে এখনই আমার লেখা শেষ করে উঠে যান। শেষ কটি প্যারা পড়ার আর দরকার নেই। আপনার প্রতি একটাই সাজেশন "জিরো এক্সপেকটেশন নিয়ে হলে যাবেন, ভালো লাগার সম্ভাবনা তাহলে হয়তো বেশী থাকবে”।
রেসলিং নির্ভর এ ছবিতে মাহফুজ এর চরিত্রটি অনেকটা আন্ডারটেকার-এর মতো। তিনি বদ্ধ অন্ধকার ঘরে থাকেন, সেই ঘরে এতোই গন্ধ যে জয়ার মতো খুনীও সেখানে ঢুকে নাক মুখ কুচকে ফেলে। আর রুহী তো বলেই ফেলে “বাবাগো, কী গন্ধ”। আমরা তো রহস্যের গন্ধের জন্য হলে এসে কিছুই পেলাম না, জয়া আন্টি আর রুহি আপু এটলিস্ট কিছু একটার গন্ধ পেলেন। হ্যা, এই সিনেমাকে ব্ল্যাক থ্রিলার, ডার্ক থ্রিলার বা কালা থ্রিলার যাই বলেন না কেন, এখানে কোন রহস্য নেই। এটাও বলা হয়েছিলো যে এটি গতানুগতিক বাংলা সিনেমার মতো নয়। গতানুগতিক বাংলা সিনেমায় নায়ককে বাবা-মার হত্যাকারীর প্রতিশোধ নিতে দেখা যায়, এখানেও চরিত্রগুলো নিজেদের আগের জীবনের হত্যাকারীর উপর প্রতিশোধ নিতে চায়।যেহেতু থ্রিলার দাবি করা হয়েছে আমি ভেবেছিলাম প্রতিশোধ নেবার ধরণে কোন চমক থাকবে। কোন চমক নেই। হয় প্রতীশোধকারী হাটতে হাটতেই রাস্তার মোড়ে তার টার্গেটকে পেয়ে যায় নতুবা টার্গেট কোন অতীব কাকতালীয়ভাবে তার সামনেই হাজির হয়। বাংলা সিনেমায় দেখেছি নায়িকা বাসর ঘরে ঢুকে স্বামীকে পা ছুয়ে সালাম করে। এখানে স্ত্রীও স্বামীকে পা ছুয়ে সালাম করে তবে বাসর ঘরে নয়, এয়ারপোর্টে। বাংলা সিনেমাতে দেখা যায় নায়ক নায়িকাকে উদ্ধার করে। সিনেমার বেশ কিছুক্ষন ধরে মনে হয়েছে এখানে নায়ক নায়িকা নেই, সবাই অভিনেতা অভিনেত্রি। কিন্তু যখন সেই অভিনেতাই একজন অভিনেত্রীকে উদ্ধার করলেন এবং সেই দৃশ্য দেখে হলশুদ্ধ দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়ে তখনই বোঝা যায় ডিরেক্টরের এবং দর্শকদের কারোরই গতানুগতিক পরুষতান্ত্রিক ছাপ থেকে বের হবার কোন ইচ্ছা নেই।
ছবির ভালো দিক হলো ছোট বা বড় সকল চরিত্রেরর শিল্পীদের দারুন অভিনয়, তবে তাদের অভিনয়কে সম্মান করার ক্ষমতা গল্পটির ছিলো না। সিনেমার গানগুলো বেশ ভালো, বিশেষ করে জেমসেরটা এবং একদম শেষে রবিন্দরথানের ‘আনন্দধারা’ গানের রক ভার্সন। এই গানটি আর কোথাও শোনা হয় নাই, এমনকি বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে ছবির যে পাচটি গানের তালিকা দেয়া আছে সেখানেও গানটিটি নেই। কলকাতার সিনেমা হলে তারা ছবির প্রচারণার জন্য এই গানটিকে আরো গুরুত্ব দিতো।
আমার মনে হয় বাংলা সিনেমার ডিরেক্টররা যারা একটি নতুন ধারা তৈরীর চেষ্টা করছেন তারা একটি ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছেন। তারা আইটেম গান দিয়ে ছবি বানালে মনে হয় বলিউডকে ফলো করছেন, অলৌকিক এ্যাকশন সিন দিলে মনে হয় তামিল ছবি প্রভাবিত, আবার খোলামেলা দৃশ্য দিলে কলকাতার আর্ট ফিল্ম অনুসরণ করার ঝুকিতে থাকেন। আবার এ সবই বাদ দিতে গেলে সিনেমার বদলে নাটক বানিয়ে ফেলেন। অভিনেতা নাহলে হিরো বনে গিয়ে অভিনেত্রীর বদলে হিরোইনকে উদ্ধার করে নিলো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমাদেরকে এই ট্র্যাপ থেকে কে উদ্ধার করবে???
সামহোয়্যারইনে লেখা আমার আগের দুটি মুভি রিভিউ
উধাও
চোরাবালি
ফেসবুকে আমার পেইজ ব্লগব্লাস্টার