গতকাল সকালে নিউজপেপারটা হাতে নিয়ে টের পেলাম ঈদ আসন্ন।
কুরবানীর ঈদ!!
এই ঈদটা বড়ই হুট করে চলে আসে। সেই তুলনায় রোজার ঈদ আসে রয়ে সয়ে, পুরো একটা মাস ধরে।
ছোটবেলার ঈদ আর এখনকার ঈদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত আমার কাছে। আগে ঈদ মানে কম করে হলেও ৮-১০ টা ড্রেস হবে। ঈদের পর টানা কয়েকদিন নতুন ড্রেস পরেই দিন কাটবে। পাঁচটার কম ড্রেস হলে মনে হত কেউ আমাকে ভালোবাসে না, তাই কম দিয়েছে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার এই চাহিদাটা কেমন যেন মিইয়ে গেছে। আগে যারা ড্রেস কিনে দিত, এখন তারা টাকা দিয়ে বলে নিজের পছন্দমত কিনে নিও। নিয়মটা অবশ্য ভালই, কিন্তু আমার ভাল লাগে না।
আজকালকার মেয়েরা যেখানে শপিং করতে পছন্দ করে, সেখানে শপিং যেতে আমার বড়ই আলসেমি। এ বছরের রোজার ঈদের কথাই বলা যায়। মার্কেটের ভীড়, রাস্তার জ্যাম-জেলী, অসহ্য গরম আর কষ্ট করে রাখা রোজা হাল্কা হয়ে যাওয়ার ভয়ে ঈদের শপিংই করিনি। আমার অনেক ফ্রেন্ড সেটা শুনে মনে করেছে আমি ভাব নিচ্ছি। ঈদের দিন সকালে দাদী যখন আফসোস করে বললেন যে সবার ছোট হয়েও আমি পুরানো জামা পরলাম অথচ সবাই নতুন পরলো তখন আমার নিজের জন্য একটু মায়াই হল। পরক্ষণে আবার এটাও চিন্তা করলাম, আসলে ঈদ মানে কি নতুন জামা পরতেই হবে এমন কিছু? যার প্রতিযোগিতায় আজ সবাই মেতে থাকে। একের উপরে দুই-তিন নতুন জামা-শাড়ী লাগে। একটার থেকে আরেকটা দামী থেকে দামীতর। তার সাথে ম্যাচিং গয়না, জুতা তো আছেই। কি হয় এতসব কিছু দিয়ে? ছোটবেলায় ধর্ম বইতে পড়েছিলাম ঈদ মানে আনন্দ, খুশী। সেই আনন্দ-খুশীতে দিনটা কাটাতে পারাটাই তো আসল কথা। পরীক্ষার পর রেজাল্ট যদি ভাল হত (যদিও সেটা খুব কমই হয়েছে), তবে আমরা বলতাম আজ তো ঈদ লেগে গেল, মানে খুশীর দিন একটা। যদিও আমাদের আনন্দ করার জন্য তেমন কোন কারণের দরকার হত না। এমনি এমনিই আমরা ফ্রেন্ডরা পার্টি করতাম। একসাথে হইচই, খাওয়া-দাওয়া, অযথা হাসি-ঠাট্টা আর হুল্লোড়। এই হল আমাদের আনন্দ। কই সেসব দিনে তো নতুন জামা-কাপড়ের খোঁজ হত না। আসলে আনন্দের দিনে আনন্দ করতে পারাটাই হল আসল ব্যাপার।
ছোটবেলায় ঈদে আনন্দ হত প্রচুর। ওবেলাটা কেটেছিল আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে। বাবা তখন থাকতো ইংল্যান্ড। তাই তার অভাব যেন টের না পাই তার প্রতিযোগিতা করতো সবাই মিলে। সেই জন্য দিনগুলো বেশ কেটেছিল তখন। ঈদে সালামি যা পেতাম তা তখনকার সময়ের জন্য বেশ ভালই বলতে হয়। তখন কেউ ২০ টাকা দিলে মনে হত হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। আর এখনকার বাচ্চাদের ১০০ টাকার কম দিলে মুখ গোমড়া করে ফেলে।
সময় যেমন বয়ে গেছে, তেমনি ঈদের খুশীর ধরণ-ধারণও পালটে গেছে। ছোটবেলায় দেখতাম ছেলেরা সব একজন আরেকজনের সাথে কোলাকুলি করছে। কোন মেয়েকে কখনো আরেকটা মেয়ের সাথে কোলাকুলি করতে দেখিনি। এটা আমাকে অবাক করত খুব। তবে আমরা ভাই-বোনরা সবাই সবার সাথে কোলাকুলি করতাম। সালামির টাকা নিয়ে মারামারি করতাম। যারা একটু ছোট, তাদেরকে ২ টাকার ৫ টা নোট দিয়ে তার থেকে ৫০ টাকার একটা নোট হাতিয়ে নিয়ে বলতাম, দেখ তোকে ৫ টাকা (৫টা নোট, এক একটা নোট এক এক টাকা) দিয়েছি আর আমি মাত্র এক টাকা নিয়েছি। সে বেচারীও বেশী পেয়েছে মনে করে খুশী হয়ে যেত।
সব থেকে মজা হত ঈদের আগের দিন রাতে। চাঁদ দেখতাম সবাই একসাথে। কিংবা কেউ একজন আগে দেখতে পেলে চেঁচিয়ে জানান দিত সবাইকে। তখন সবাই ছুটতাম একসাথে হইচই করতে। সবাই মিলে টাকা উঠিয়ে খাবার আর বাজি-পটকা কিনে আনা হত। আমাদের হইচই এ বড়রা যখন অস্থির হয়ে যেত তখন আমরা যে যার বাড়ি যেতাম পরদিনের প্রস্তুতি নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে।
ঈদের দিন সারাদিন ঝাঁক বেঁধে দল ধরে এর বাড়ি ওর বাড়ি ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া আর কার সালামি কত বেশী করা যায় তার প্রতিযোগীতা চলত। আমার মনে আছে একবার আমার কিছুতেই সালামির পরিমাণ বেশী হচ্ছিল না তাই আমার জমানো ১৪৫ টাকাও তার সাথে যোগ করে বলেছিলাম আমার সব থেকে বেশী হয়েছে।আর কি বিপদ! সাথে সাথে টাকা বড় ভাইলোগ কর্তৃক হাইজ্যাক হয়ে গেল। সেই টাকা কিছুক্ষণের মধ্যে পরিণত হয়ে গেল বিভিন্ন খাবারের ঠোঙ্গা আর বাজি-পটকাতে। সবাই মিলে উদরপূর্তি আর সন্ধ্যার পর আলোর ঝলসানি-ফুলঝুরি। টাকা হারানোর আফসোস কিছুটা হলেও তা আনন্দের বন্যায় ভেসে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
এখনকার ঈদেও আনন্দ হয়। কিন্তু তা ডিজিটাল আনন্দ। বড় হয়ে গেছি বলে ঈদের দিনটা বাসাতেই থাকতে হয়, বাড়িতে আসা মেহমানদের মেহমানদারীতে আম্মাকে সাহায্য করতে। তার ফাঁকে ফাঁকে চলে ফেইসবুকে খুচরো উইস, ফ্রেন্ডদের সাথে কোলাকুলি, ট্যাগ খাওয়া খাবারের ছবিতে লাইক দিয়ে পেট ভরানো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা চলে ঈদের পরদিন থেকে।
টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান আগে তবুও যা দেখা হত, এখন আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে দেখানো ঈদের অনুষ্ঠান দেখতে ইচ্ছা করে না। আর এখন এত এত অনুষ্ঠান হয়, যে কোনটা যে আসলেই দেখার উপযোগী তাও বুঝি না।
ছোটবেলার থেকে এখন সব কিছুতেই সুযোগ সুবিধা বেশী হলেও আগের মত ছুটিতে আয়েশ করে পায়েশ খাওয়ার দিন আর নেই। সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যে না করতে পারা জমিয়ে রাখা হাজারটা কাজ করি কোন একটা বড় ছুটি পেলে। বড় হওয়ার সাথে সাথে না চাইতেও কিছু দায়িত্ব এসে পড়েছে কাধেঁ। সেগুলো শেষ করতে করতে আজকাল ছোটবেলার ঈদটাকে মিস করি বড় বেশী। মন চায় ছুটে যেতে সেই ছোটবেলায়। ছোট হওইয়ার পক্ষে কি এতই বড় হয়ে গেছি যে আজকাল আর বড়বেলা ভাল লাগে না, ছোট হতে চায় মন বারবার।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
সবার ঈদ ভাল কাটুক!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:২৯