আধুনিক কালে আকাশ যুদ্ধের সবচেয়ে আলোচিত বিমান হল আমেরিকান স্টেলথ ফাইটার এফ ২২ র্যাপটর (Lockheed Martin F-22 Raptor) । এখনও পর্যন্ত এফ ২২ র্যাপটর ই সার্ভিসে আসা একমাত্র স্টেলথ ফাইটার।
স্টেলথ টেকনোলজির কাজ হল রাডারকে ফাকি দেয়া। এফ ২২ প্রধানত এয়ার সুপিরিউরিটি ফাইটার যাতে স্টীল্থ, সুপারক্রুজ, ভেক্টরিং থ্রাস্ট সহ অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এটা সার্ভিসে আসে ২০০৫ সালে। এই ফাইটার তৈরীর প্রধান লক্ষ্য ছিলো F-15 Eagle কে রিপ্লেস করা।
এই এফ ২২ এর জন্মের ইতিহাস যথেষ্ট লম্বা । ১৯৮১ সালে আমেরিকান এয়ার ফোর্স Advanced Tactical Fighter (ATF) নামে একটি প্রযেক্ট হাতে নেয় যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন ধরনের এয়ার সুপিরিউরিটি ফাইটার তৈরি এবং F-15 Eagle কে রিপ্লেস করা।
এর কারন ছিলো সোভিয়েত ফাইটার সু ২৭ । অনেক রকমের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কোবরা ম্যানুভ্যারেবল সু ২৭ এর সাথে আমেরিকার ভোম্বা F-15 Eagle এর ডগ ফাইটে টেকার সম্ভবনা ছিলো মারাত্বক কম।
Soviet Su-27
কোবরা ম্যানুভ্যার
Advanced Tactical Fighter (ATF) প্রজেক্টে আমেরিকানরা সোভিয়েতদের সু ২৭ এর মতো আ্যাডভান্সড অ্যালয় , কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল, আ্যাডভান্সড ফ্লাই বাই ওয়্যার,হাই পাওয়ার প্রোপুলশন এবং লো অবজারভেবল বা স্টেলথ টেকনোলজি এ্যাড করা হয়।
এর পরে ১৯৮৬ সালের জুলাইতে আমেরিকান এয়ার ফোর্স এই ফাইটার তৈরীর জন্য request for proposal (RFP) ইস্যু করে । প্রাথমিক ভাবে Lockheed/Boeing/General Dynamics and Northrop/McDonnell Douglas এই ফাইটার তৈরীর ৫০ মাসের গবেষনার জন্য নির্বাচিত হয়। এর পরে ১৯৯১ সালে লকহিডের তৈরী YF-22 প্রটোটাইপটা F-22 এর ডিজাইন হিসাবে নির্বাচিত হয়।
এবং এর প্রোডাকশন শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। আর প্রথম F-22 হস্তান্তর হয় ২০০৩ সালে। আর F-22 আমেরিকান এয়ার ফোর্সে সার্ভিস শুরু করে ১৫ ডিসেম্বর ২০০৫ ।
এই ফাইটারের বিশেষত্ব অনেক দিক দিয়ে।যার অন্যতম আলোচিত এবং সমালোচিত বিষয় হল এর প্রোডাকশন কস্ট।
এফ ২২ র্যাপটর এখনও পর্যন্ত দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ফাইটার। এই ফাইটার তৈরীর টোটাল প্রোগ্রাম কস্ট ছিলো ৬৫ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা (২০০১০-২০১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বাজেট ছিলো ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৫০কোটি টাকা)।
আর এর পার ইউনিট প্রডাকশন কস্ট ১৫০ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১০৫০ কোটি টাকা । তবে টোটাল প্রোগ্রাম কস্ট কে টোটাল উৎপাদিত বিমান দিয়ে ভাগ করলে পার ইউনিট কস্ট দাড়ায় ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার
যা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ২৫৫৫ কোটি টাকা প্রতি পিস।
পারফরমেন্সের দিক দিয়ে এই বিমান বিভিন্ন ইউনিক পাওয়ার ডিজার্ভ করে।
এফ ২২ র্যা পটর একটি ৫ম প্রজন্মে ফাইটার এয়ারক্রাফট। এই বিমানকে ৪র্থ জেনারেশন স্টেলথ এয়ারক্রাফট হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এফ ২২ র্যাপটর এর এক্সটারনাল বডিতে ব্যবহার করা হয়েছে রাডার সিগন্যাল অবজরভার, যা রাডার সিগন্যালকে রাডারের কাছে ফেরত যেতে দেয় না। যা এই বিমানকে শত্রু পক্ষের কাছে অদৃশ্য করে তোলে।
এফ ২২ র্যাপটর এর ২টা Pratt & Whitney F119-PW-100 turbofans একে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 23,500 lb ড্রাই থ্রাষ্ট সাপোর্ট করে। যার সাহায্যে এই বিমান ২ ধরনের সুবিধা পায়।
প্রথমমত, সুপার ক্রুজিংয়ে আফ্টার বার্নার ছাড়াই ম্যাক ১.৮ (১৯০০ কি.মি./ঘন্টা ) গতিতে চলতে পারে । যেখানে সাধারন বিমানের ক্ষেত্রে এই গতি মাত্র ম্যাক ১.৫ (১৫০০ কি.মি./ঘন্টা)। এছাড়া আফটার বার্নিং এর এর সময় এফ ২২ এর গতি থাকে ম্যাক ২.২০ (২৪৫০ কি.মি./ঘন্টা ) যার সাপ্লাইং থ্রাস্ট থাকে 35,000+ lb
দ্বিতীয়ত, এর ভেক্টরিং থ্রাষ্ট ফ্যাসিলিটি । এই ফ্যাসিলিটির এর সুবিধা হল এই ব্যাপক থ্রাষ্ট ব্যবহার করে এই বিমান যে কোন সময় দীর্ঘক্ষন খাড়াভাবে উপরে উঠতে পারে। এমনকি টেকঅফ করার পর মুহুর্তে ও এই ফ্যাসিলিট ব্যাবহার করা সম্ভব।
এফ ২২ র্যাপটর এ ব্যাবহৃত রাডার X BAND AN/APG-77 AESA radar এর রেন্জ ২০০-২৪০ কি.মি.। এই দুরুত্বের মাঝে নূন্যতম ১১ স্কায়ার ফিট আকার পর্যন্ত যে কোন ফ্লাইং এলিমেন্টস কে এই রাডার ডিটেক্ট করতে পার। উল্লেখ্য, X BAND AN/APG-77 AESA radar এ ডেটা এন্যালাইসিস এর জন্য আছে ২টা Raytheon Common Integrated Processor ,যার প্রত্যেকটির ক্ষমতা 10.5 billion instructions per second।
এছাড়া এতে ব্যবহৃত RWR (Radar warning receiver) সিষ্টেম এর রেন্জ ২৫৮ নটিক্যাল মাইল বা ৪৬৫ কি.মি. । যার মানে এই বিমান তার ২৫৮ নটিক্যাল মাইল কিংবা ৪৬৫ কি.মি. এর মধ্যে থাকা যে কোন রাডার কে ডিটেক্ট করতে পারবে।
X BAND AN/APG-77 AESA radar
এফ ২২ র্যাপটর এর অস্ত্র সম্ভার ততটা জোরালো নয়। স্টেলথ হবার কারণে এই বিমান তার আর্মামেন্ট বিমানের ই্ন্টারনাল উইপন বে (Internal Weapons Bay) ভিতরে থাকে।কোন মিসাইল বা বোম্ব লাউন্চ করার সময় এই বিমান তার উইপন বে ওপেন করে তা লাউন্চ করে। এফ ২২ এর হার্ড পয়েন্ট মাত্র ৪ টা ।
Internal Weapons Bay
টোটাল স্পেফিকেশন :
পাইলট : ১ জন
লেংথ: ৬২ ফিট
উইং স্প্যান : ৪৪.৬ ফিট
শক্তির উৎস: 2× Pratt & Whitney F119-PW-100 Pitch Thrust vectoring turbofans
সর্বোচ্চ টেকঅফ ভর : ৩৮০০০ কেজি
ওয়েল ক্যাপাসিটি : ইন্টারনালী ৮২০০ লিটার
এক্সটারনালী ১১,৯০০ লিটার (২টা ফুয়েল ট্যাংক সহ)
পারফরমেন্স -
সর্বচ্চো গতি :
সুপারক্রুজিং : ম্যাক ১.৮ (১৯০০ কি.মি./ঘন্টা )
আফটার বার্নিং : ম্যাক ২.২০ (২৪৫০ কি.মি./ঘন্টা )
রেন্জ :
কমব্যাট রেন্জ : ৪৭১ মাইল বা ৭৫৯ কি.মি.
এভ্যারেজ রেন্জ :
৮৭০ মাইল বা ১৪০০ কি.মি. (ইন্টারনাল ফুয়েলিং)
১৮৪০ মাইল বা ২৯৬০ কি.মি. (এক্সটারনাল ফুয়েল ট্যাংক শ)
সার্ভিস সিলিং : ৬৫০০০ ফিট
আর্মামেন্ট
* একটা ৪৮০ রাউন্ড গুলি সহ ২০এমএম M61A2 Vulcan 6-barreled Gatling cannon
* ৬টা AIM-120 AMRAAM মিডিয়াম এয়ার টু এয়ার রেন্জ মিসাইল
* ২টা AIM-9 Sidewinder সর্ট রেন্জ এয়ার টু এয়ার মিসাইল।
এই বিমান যতটা আলোচিত এর ক্ষমতার জন্য ঠিক ততটাই সমালোচিত বিভন্ন দুর্বলতার জন্য ।এইবার দেখা যাক এই বিমানের দুর্বলতা গুলো ,
এই বিমানের স্টেলথ নিয়ে প্রশ্ন অনেক ,
এই বিমান স্টেলথ হলেও কোন মিসাইল কিংবা বোম্ব লাউন্চ করার জন্য Internal Weapons Bay এর হ্যাচ খুললেই তা কনভেশনাল রাডারের কাছে ধরা পড়ে। পরে এর হ্যাচ লাগিয়ে দিলে তা কনভেনশনাল রাডারের কাছে আবার অদৃশ্য হলেও দেখা যায় আগের ডাটা ব্যাবহার করে এই বিমান কে হিট সিকিং রাডার এর কাছে ভিজিবল করে ফেলা যায়। আবার ৪৫-৩০ কিমি রেন্জের মাঝে থাকলে মিগ ২৯ , সু ৩০,এফ ১৫ , ১৬ ,১৮ এ ব্যবহৃত ইনফ্রোরেড রাডার এই বিমান কে ডিটেক্ট করতে পারে এবং টার্গেট সিউর করতে পারে। আর সেকেন্ড 23,500 lb এর মতো মারাত্বক থ্রাষ্ট ডিটেক্ট করার জন্য ১৯৭০ দশকের হিট সিকিং মিসাইল ই যথেষ্ট।
এফ ২২ এর X BAND AN/APG-77 AESA radar এর ২০০-২৪০ কি.মি. দুরুত্বের মাঝে নূন্যতম ১১ স্কায়ার ফিট আকার পর্যন্ত ফ্লাইং এলিমেন্টস কে এই রাডার ডিটেক্ট করতে পারলেও তা দেখা যায় অনেক সময় ছোট আকৃতির মিসাইল যেমন : Vympel R-77 , PL-2, PL-5, PL-7 কে ডিটেক্ট করতে পারে না।
একই অবস্তা RWR (Radar warning receiver) সিষ্টেম এর। এটি বিভিন্ন মোবাইল রাডার সিষ্টেম যেমন ম্যানপ্যাড, কিংবা ছোটখাটো রাডার গাইডেড এন্টিএয়ার সিষ্টেম কে ডিটেক্ট করতে পারে না। এই বিমানের অন্যতম দুর্বলতা হলো এই বিমান বৃষ্টির মাঝে উড়তে পারে না ।
এফ ২২ র্যাপটর বিমান একটা ভয়াবহ খরুচে বিমান। এফ ২২ এর প্রতি ঘন্টা ফ্লাইং এর জন্য এর খরচ হয় ৪৪,০০০ হাজার ইউএস ডলার। এবং প্রতি ১ ঘন্টা ফ্লাইং এর পরে এর দরকার পড়ে ৩০ ঘন্টার মেইনট্যান্সের।
শুরুতে এফ ২২ বিমানের এভ্যারেজ ফ্লাইং ইরোর আওয়ার ছিলো মাত্র ১.৭ ঘন্টা, যার মানে প্রতি ১.৭ ঘন্টার পরে বিমানের কোন না কোন ক্রিটিকাল ইরোর পাওয়া যায়। তা বর্তমানে দাড়িয়েছে ২.৭৫ ঘন্টা, যেখানে ৫০ বছর আগের মিগ ২১ এর এভ্যারেজ ফ্লাইং ইরোর আওয়ার ৫১ ঘন্টা ।
এফ ২২ এর কমব্যাট সাকসেস রেট এখন পর্যন্ত ৬৫ %, যেখানে এফ ১৮ সুপার হর্নেট এর কমব্যাট সাকসেস রেট ৭২.১ % । এর মধ্যে আবার দুঃসংবাদ আসে রাশানদের স্টেলথ SU T-50 PAK FA টেস্টিং এর পরে। PAK FA এর টেষ্টিং এর কিছু পারফরমেন্সই নিশ্চিত করে দিয়েছে SU T-50 PAK FA ভবিষ্যতে এফ ২২ কিলার হয়ে উঠবে।
SU T-50 PAK FA
এই সব কারনে ইউএস গর্ভমেন্ট ২০০৯ সালে এফ ২২ এর প্রোডাকশন ১৮৭ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় , যেখানে টোটাল প্লান ছিলো ৭৫০+ এফ ২২ তৈরীর। এবং এফ ৩৫ লাইটিং প্রোগ্রামের উপর জোর দেয়া হয়।
বিদ্র : পোষ্ট টা একটু বেশি বড় হয়া গেলো :
পোষ্ট টা একবার দিয়েছিলাম ১২টা ৪৩ মিনিটে ..... ৩-৪ মিনিট পরে এই পোষ্ট সংকলিত এবং ক্রমানুসারে পাতা থেকে হারিয়ে যায় । এই আমি এডিট করতে গেলে সোজা ডিলিট সো এই রিপোষ্ট
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১:২৭