ভালো রাত হইছে। আমি যেহেতু জেমসকে নিয়া লেখতে বসছি, তারে আমি ভাবতেছি। আবার তার গান শুনতেছি। মনে হইতেছে, জেমসের লগে দেখা হইলে ভালো হইতো। জমতো, আমি ইমাজিন কইরা নিতেছি। জেমস চিল্লাইতেছেন— হোমায়রার নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে।
মনে হয় আমিও তার একজন ভক্ত। তার নগরবাউল-জীবনটারে আমি জানি। সেই চট্টগ্রাম, ওইখানে তার ‘ফিলিংস’-এর লগে আমি পরিচিত না। তবু এই একজন নগরবাউল, আমি তার ভক্ত হইছি। ফলে তার ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে চুরি হয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। যেমন, জেমস আমার বিচারশক্তিরে চুরি করছেন। তারে কেবলই আমার এখন ভাল্লাগতেছে। তার অনেক সস্তা গান রইছে যদিও— আমি বলতে পারতেছি না, জেমস তিরিশ পার্সেন্ট সস্তা।
এই সকল ঘটা-ঘটনা কেমন, আমি জানি না। তবে এইটুকু বলা যায়, ব্যাপারগুলো জেমস-এর জন্য কৃতিত্বের মতোন। মানুষের বিচাররে পক্ষপাতদুষ্ট কইরা তোলা সহজ না। মহামান্য জেমস তা পারছেন। আমরা দল-দল হয়া তার মধ্যে ডুইবা আছি। আহ, তিনি গাইতেছেন— সুসমিতার সবুজ ওড়না উড়ে যায়।
এই যে আমি এখন লেখতেছি, খুব সম্ভব জেমস বিমানে বইসা আছেন। হইতে পারে, তিনি ঘুমাইছেন। আজকে রাতেই তার ফ্রান্সে যাওয়ার কথা। কালকে তার এক কনসার্ট আছে। প্যারিসে। ওইখানে তিনি জন্মদিনটা কাটাইবেন। ঘটনা ভালোই, তবু দেশের মানুষ কালকে তারে পাইতেছে না। এটাও একরকম বেদনা দিয়া থাকবে। যা হোক, আমি গতকালকে বিকালে যাইতেছিলাম চ্যানেল আইয়ের অফিসে। কারওয়ান বাজারে দেখলাম, বড় সাইনবোর্ড।
এই সাইনবোর্ডে বিরাট কইরা জেমসরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হইছে। আমি মুহূর্তের জন্য কিরম জানি ভাবালু হয়া উঠলাম। ভালো কইরা তাকাইলাম, সাইনবোর্ডটার দিকে। গুরুর প্রতি কোন এক শিষ্য ভালোবাসা দেখাইছে। অতো সোজা কিছু না কিন্তু, আপনেরা ভাবেন। আমি জানছি, জেমসের কানে এই আলাপ গেছে। তার ভক্তের কাণ্ডে তিনি খুশি হইছেন। জেমসের খুশি হওয়াতে আবার— সেই ভক্ত না জানি কি আনন্দে ভরপুর হয়া গেছে। জেমস তারে লুটপাট কইরা দিছেন। ফলেই ব্যাপারটা কেমন যেনো একটা মহান প্রেমের মতোই হয়া দাঁড়াইলো। আপনেরা খেয়াল করবেন, জেমসের এক্সট্রিম ভক্তরা কেমন একটু দূরে দূরে থাকে। তারা জেমসের গান শুনে। ওইখানেই ডুইবা থাকে। তারায় তারায় রটায় দেওয়ার প্রবণতা তাগোর মাঝে কম। আমি দেখি, এক মানুষ হইতে আরেক মানুষের যেই কানেকশন, যেই রিলেশনের হিসাব-কিতাব, জেমসের ক্ষেত্রে আইসা সেইটাই আরেকটা মাত্রা পায়। জেমসরে লোকে আর সেইরকম কইরা ভালোবাসে না। যা মানবিকভাবে স্বাস্থ্যকর কিম্বা অস্বাস্থ্যকর। ভক্তরা অন্যরকম কইরা দেখে তারে। তার ওই ভক্তের নাম প্রিন্স মোহাম্মদ। প্রিন্স তারে বলে, শুভ জন্মদিন গুরু! যেনো গুরু বইলাই তার শান্তি। একটা আধ্যাত্মিকতার ছোটমোট অবয়ব আছে, বা এইরকম একটা কিছু। আমি দেখতে পাই।
জেমসের একটা গান আছে। কে লেখছে, আমি গীতিকাররে খুঁইজা পাই নাই। জেমস সেই গানে বলেন, দেবদাস বলো না আমায়। মজার কিন্তু, ভাবি, আমরা তারে এতো আলাভোলামতোন দেখতে থাকা সত্ত্বেও কখনো কিন্তু দেবদাস কইতে পারি না। কেউ গুরু কয়। আমি জেমস কই। অনেকেই জেমস কয়— কিন্তু সবারই মাঝে ভক্তি দেখা যাইতে থাকে। শত হইলেও তার বাউলপনা, নগরের মধ্যে একজন বাঙালি রকস্টাররূপে তার উদয়নটা যেনো কোনভাবেই তারে দেবদাস পর্যায়ে নিয়া যায় না। একটা গুরুগম্ভীর অভিনিবেশ, উপরোন্ত আরেকটা ভিন্নরকম আমেজ দেখা যায়। ফলে জেমসের পক্ষে কারো বন্ধু হয়া ওঠাও সম্ভবজনক হয় না। আপনেগোরে গান শুনাইতে থাকলেন যদিও তিনি— তবু যেনো অধরাই থাইকা যান। এই বিষয়টারে আর কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে? আপনেরা জেমসের গানশোনা লোকজন, ভাবেন যে— জেমস আপনার সামনে আইসা বসলেন। আপনে কি কইবেন? দোস্ত নাকি গুরু। চাইলে আপনে ওস্তাদ কইতে পারবেন। বাট, পারবেন না তারে বন্ধু বানাইতে।
আমার মনে হয়, এই ভক্তিটাই কেবল জেমসরে বাঁচায়া রাখে। এবং এই ভক্তি গইড়া ওঠার পেছনে মূল হাতিয়ার হইতেছে গান, দ্বিতীয়ত গানের লগে তার শারীরিক মুভমেন্ট। এতে লোকের বিশ্বাস দাঁড়ায়, জেমস খুব মন থিকা গাইতেছেন। এবং শেষমেষ তার চুল ও বোতামহীন শার্টের অসমাজিক ভঙ্গি— সব মিলায়েই আপনে তার ভক্ত হয়া ওঠেন।
আমি বলতেছিলাম, এই ভক্তি-ভক্তি ক্যাটগরির সম্মানই জেমসরে বাঁচায়া রাখে। তার একান্ন বছর বয়স হইলো— আমরা জানি না, তিনি আর কতোকাল বাঁচবেন। এবং আমরা জানি না, মরণের পরে কি জেমস টিকবেন? তথা মানুষের গান শোনার কিম্বা বলার চাহিদায়। অন্য অন্য নতুন গায়কদের সুরে। সকলের আত্মায়— টিকা থাকার হিসাবটা আসেল বলা মুশকিল। একটা বড় মাপের আপেক্ষিক গণিত। তবে আমার মনে হয়, জেমসরে নিয়া আশা করা যায়, অন্তত বাংলাদেশে যেহেতু তার চাইতে পপুলার গায়ক আর নাই, কাজেই তার পপুলারিটি তারে ধইরা রাখবে। মৃত্যুর পরে জেমস বাঁইচা যাবে।
এতো দূর তার আগায় যাওয়া, জেমসের— সেইখানের পথটা অতো আরামদার হওয়ার কথা না। অন্তত এই দেশে, গান-বাদ্যরে লোকে বিনোদন মনে কইরা গ্রহণ করছে। এর ফলে পিতা-মাতা এইটারে দেখে ছোট কাম হিসাবে। নিজর সন্তানরে তারা জড়াইতে চায় না। এই হইলো স্বাভাবিক মধ্যবিত্তের ঘটনা। যেহেতু তারা মেন্টালি খুবই বাজে স্বভাবের থাকে। এবং এরাই সবচাইতে সুযোগ মিস করে। ছোটবিত্তর হাতে সুযোগ পৌঁছে না। বড়বিত্তের তো আর সুযোগ দিয়া কোন ভাত খাওয়ার দরকার নাই। সচরাচর তারা এইটারে খুঁজে না। সুযোগ চইলা আসলেও অন্তত মধ্যবিত্তর মতোন এইটারে ছোট কাম ভাবে না। আমি খেয়াল কইরা দেখছি, সবচাইতে সুযোগ পায়, মাঝারি শ্রেণি। এরাই সবচাইতে বেশি বেশি হারায়। জেমস যেই পরিবার থিকা উইঠা আসলেন, সেইখানে তারে নিয়া অসন্তুষ ছিলো। মধ্যবিত্ত সমস্যা। আপনেরা কি মনে করেন, আর কেউ জেমস হইতে পারতো না? দেশের ছোটলোকির কারণে আরো আরো জেমস বাইর হয়া আসে নাই। ট্রাস্ট মি! একজন জেমস, কেবলমাত্র পিমা-মাতার অনাক্কলি তদবীর থিকা বের হইতে পারছেন বইলাই, নগরের বাউল হইছেন। আপনেগোর গুরু, আমার জেমস হইছেন। এই কৃতিত্ব আমরা তারেই দেই। মধ্যবিত্তের নিকৃষ্ট একটা মনোভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কইরা তিনি ঘর ছাড়ছিলেন। এই ঘর-ছাড়াটাই দিনে দিনে অনেকদূর গড়াইছে।
সেই চট্টগ্রামে, তখন ঘর ছাইড়া দিয়া জেমস বানাইছেন ‘ফিলিংস’ নামের একটা ব্যান্ড দল। আমি তার এই সময় সম্পর্কে অবিশেষ জানি, তথা আর্টিকেল পইড়া যেই জ্ঞান দাঁড়ায়, ওইটা কেবল আমার আছে। আমি কইতে পারি, এই তার ফিলিংসের লগে বসবাস, উনিশশো আশি সাল হইতে শুরু হওয়া তার দিনরাত, ওই সময়ে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ জেমস হয়া উঠতে তার সময় লাগছে। বাঙালিত্বের লগে রক-গানের একটা আনঅফিসিয়ালি মিলমিশ, এইটা দাঁড় করাইতে দশ বছরের মতোন টাইম লাগছে। ‘জেল থেকে বলছি’ দিয়াই মূলত তার সঠিক আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এর আগে, ‘অনন্যা’ অ্যালবামের গানগুলা মাটি-মাটি লাগে। ‘স্টেশন রোড’-এর মধ্যে একরকম চাটগাম-চাটগাম রব আছে বটে— সেইটাও চলা-চলতি জেমসময় হইতে পারে নাই। তবে বলা যায় যে, এরপরের সময়ে জেমস বিষয়ে কোন দ্বৈততা নাই। তার গান, এবং গানের কাঠামোর মধ্যে শক্তির সঞ্চার একরকমই। পর্যায় বা আঙ্গিকের বদল হইছে, রূপান্তর ঘটছে। বাট সূত্র উৎপাটন হয় নাই। ভালো গান, এবং আরো ভালো গান, সেই সঙ্গে অপক্ষাকৃত কম ভালো গান, মাঝারি মাপে উত্তির্ণ গান— এইসকল গানের ভেতর দিয়া জেমস কেবলই আগাইছেন। দেশ পার হইছেন। ইন্ডিয়ায় ‘বিগি বিগি’ বাইজা উঠছে। এইমতোন আরো কিছু হিন্দি গান। এশিয়ায়, এমনকি ইউরোপ থিকা নিয়া মিডলিস্টেও জেমস বিস্তৃত হইছেন
আপনগোর মত কি, আমার জানা নাই। তবে জেমসের মধ্যে একরকম কূটনামি আছে। সেইটার আড়ালে তিনি জনপ্রিয়তা কামাই করেন। যেমন, আপনেগোর মনে তার প্রতি অসাধারণ ভক্তিভাব ইস্টাবলিশ হয়া আছে। আমারও মনে হয়। এইটা একজন সরল জেমসের প্রতি। যে কি-না জীবন সম্মন্ধে, যাপনের হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে ভাবলেশহীন। কিন্তু আমার মনে হয়, ঘটনা অন্যরকম। জেমস বুদ্ধি খাঁটান। ফলেই একরকম কূটনামি তারে পায়া বসে। আপনে তারে আর বুইঝা ওঠেন না। অতি বুদ্ধিমানরা এই কাজ ভালো পারে। এই নিয়া আমার কোনই এশকাল নাই। আমি বরং, বিশেষ কইরা এই বাহ্যিক বুদ্ধিমত্তার টেকনিকরে স্বাগত জানাই। এইটার জন্য, একজন পলিটিশিয়ান জেমসকে আমি ভালো পাই।
যা হোক, জেমসের বুদ্ধির দৌড় আবিষ্কার করতে চাইছিলাম। বুদ্ধি বলতে, আপনেরা ধইরা নিতে পারেন— জেমসের মেধার প্রয়োগ কেমন, সেটা কোদ্দুর উন্নত, আমি এইটাই জাজমেন্টের ভেতর দিয়া দেইখা নিতে চাই। তো, জেমসরে যেহেতু লোকে বলে, তিনি জিম মরিসন দ্বারা প্রভাবিত। এবং আমি দেখি যে— ব্যাপারটা সত্য হইতে পারে। যেমন, তার রইছে ‘এপিটাফ’ নামে একটা এলবাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হইলো, জেমসের এই জিমপ্রীতি তার নিজের মধ্য দিয়া বাইরা ওঠে। অন্যরা যারা, জিমের মধ্যে ডুবেন, তারা হারায় যান সেই পুরান এক আমেরিকায়। জেমস এইখানে একটা দারুন রূপান্তর ঘটাইতে পারছেন। কাজটা কঠিন, এর দ্বারা জেমসের বুদ্ধির একটা ফলাফল দাঁড়ায়। সেই চট্টগ্রাম, পরে এই ঢাকা, এর ভেতরেই জেমস চর্চা করেন— জিম মরিসন। এইটা একরকম টাইনা আইনা নিজের মতোন গইড়া নেওয়া যেনো— জিম মরিসন আমেরিকার সেই জমানায় যেমনে থাকেন আর পাগলামি করেন। জেমস থাকেন এই জমানায়, ঢাকায়, অথবা চট্টগ্রামে। তিনি অন্যসব জিমপ্রেমীগোর মতো হ-য-ব-র-ল লাগায় দেন না। জিমের আমেরিকার মৃত্যুরে তিনি ঢাকার মধ্যবিত্তর জয়জয়কারে আইনা মারা দেন না। মরতে যান না, লাইক জিম মরিসন।
জেমসের বুদ্ধি আরেকটা জিনিস ধরতে পারে। সেটা দুর্বল পয়েন্ট। সেটা মধ্যবিত্তর বিশাল আয়তন। বিরাট মিডলক্লাসের হুরুস্থুলরে তিনি ধইরা আনেন। তাগোর প্রেম, চিল্লাচিল্লি, চিঠি-চালাচালি, পিতা-মাতার প্রতি তাগোর ফ্যান্টাসি, শহরের প্রতি, কিম্বা শৈশবের প্রতি, এইসকল কিছুই তিনি বিভিন্ন গীতিকারের থিকা কালেক্ট করেন। এরপরে নিজের আনন্দে সেটারে মাঝারি সম্প্রচারতুল্য কইরা বাজারে ছাড়েন। আহ, একসময় মানুষ দাঁড়ায় থাকতো বাজারে, তার অ্যালবামের উদ্বোধনের দিনে। কখন তার ক্যাসেট আসবো, পরে সে কিন্না নিবে জলদি জলদি। আমি এইসব ভাবতে বাই বোর্ন জেমস হয়া যাইতে চাই। মানুষের মনে সেই যে এক দোলা লাগে লাগে— যখন সে হাতে লয় ‘দুখিনী দুঃখ করো না’ অথবা ‘লেইস ফিতা লেইস’ অথবা লয়, ‘নগর বাউল’, ‘দিওয়ানা মাস্তানা’, ‘যন্ত্রণা’— এইসব অ্যালবামের খাপমারা ক্যাসেট।
আচ্ছা, আপনেরা কি এমন ভাবতে পারেন? ধরেন, একজন জেমস মেইনরোডের কিনারে দাঁড়ায়া সিগ্রেট ধরাইলেন। আর আপনে বউ এবং মেয়েটিরে নিয়া তার পাশ দিয়াই যাইতে লাগলেন। ঘটনা কী হইতে পারে?
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৭