মকবুল ফিদা হুসেন। লোকে তারে এম এফ হুসেন বইলাই অভ্যস্ত যদিও, তবে আমি ফিদা হুসেন বইলা বিশেষ আরাম পাই। এবং ফিদা হুসেন সম্বোধনে আমার এই আরাম লাগাটা তার প্রতি প্রেম আর অনুরাগের সামান্য প্রকাশ করে। মনে হয় যেনো, আমি খুব আবেগ নিয়া ফিদা হুসেন ডাকতেছি। ফিদা হুসেনের ব্যাপারে আমি কিছুমাত্র অল্পস্বল্প অভিযোগ ছাড়া কোন কিছুই নেগেটিভ আকারে প্রয়োগ করতে পারি না। আমার মনে হয়, শিল্পের মহানত্ব এবং দরকারিত্বকে ফিদা হুসেন বড়ই এট্রাক্টিভ কইরা হাজির করেন। যা একটা মনোরম দৃশ্যের ভেতর দিয়া মানুষের মস্তিষ্কের অসাধারণ ইম্প্রুভ আনে। ফিদা হুসেন মানুষের মগজে মারাত্মকভাবে বসে যান, এবং এই কাজটা তিনি করেন খুব সহজ ভঙ্গিমায়। মূলত এইটাই শিল্পীর একটা গুরুত্ব আদায় করে। আমি দেখি, তিনি বর্তমানের উপরে দারুন এক্টিভ থাকেন। ফলে হয় কি, আপনের মাঝে তিনি দূরাগত কিছু নন। এবং আপনাকে তিনি অনেক উচ্চাঙ্গের একটা নলেজ দিচ্ছেন।
ফিদা হুসেন বিষয়ে আমার অভিযোগটা বইলা নিতে পারি। সেটা আসলে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক। তবে বইলা নেওয়াই উত্তম, কেননা তাতে করে, আপনার মনে হইতে পারে যে, আমি খুব সত্যিকার একটা ডিসকাশন করতেছি। আমি ফিদা হুসেন-রে তুরুপেই বৈচিত্রের জনক বলতেছি না। এবং এটাও বলতেছি না যে, তিনি ভারতের পিকাসো। তাতে মনে হয় তারে ছোট করা হইবো।
ফিদা হুসেন মা হারাইছেন শিশুকালে। এই নিয়া তার অভিভ্যক্তি হইলো, এরপর থিকা তার জীবনে নারীর প্রতি দৃষ্টি-আরোপ মূলতই মাতৃ-মমতার গুঞ্জরণ ওঠায়। মানে, তিনি বলতে চান যে, সব নারীতেই তিনি মায়ের একটা রূপ আবিষ্কার করেন। বা করতে চান। তো, আপনে এইখানে খেয়াল করবেন, ফিদা হুসেনের এই মা-ময় অভিব্যক্তি যেনো একটা মিডলক্লাসের সম্মতি আদায় করতে চায়। উদাহরণ দিলে আপনে বুঝবেন, ফিদা হুসেন শিল্পের খাতিরে অনেক ছবি আঁকছেন। যেমন তিনি আঁকছেন নারীর নগ্ন শরীর। সেইটা দেবীদের অবয়ব ধারণ করায় ভারতীয় কট্টর হিন্দুরা তার উপর খেপছে। এরপরে তার বয়ান কিরকম? ফিদা হুসেন সাধারণভাবে দেশ ছাইড়া স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছেন। মিডলক্লাসরে মায়ায় জড়াইছেন। এবং দূরদেশ হইতে তিনি হিন্দু-জনতার কাছে একরকম ক্ষমাও চাইছেন। মানে, তিনি চান যে, এই মিডলক্লাসের আবেগ যাতে তার ব্যাপারে স্তিমিত হয়া না আসে। ফলে তার এই কার্যকলাপ অনেকভাবে মিডলক্লাসের অংশগ্রহণ চায়।
মানে, অনেক গরীবী হাল থিকা উইঠা আসছেন ফিদা হসেন। এক পর্যায়ে আগাইতে আগাইতে অনেক টাকা হইলো তার, সম্মান হইলো। এই পথ তিনি পার করলেন একজন মধ্যবিত্তের পিপল হইয়া। ফলে মধ্যবিত্তের চাহিদারে তিনি মান্য করেন। আবার শিল্পের জায়গাতেও তিনি বাঁইচা থাকেন। একরকম দ্বৈততা তৈরি হয়। শেষপর্যন্ত তিনি দুইটারেই মূল্যায়ন করেন। দুইটাই তার কাছে প্রধান। একজন শিল্পী হিসাবে এই জায়গার দ্বৈত-মনোভাব আমার ভাল্লাগে না। অভিযোগ দাঁড় করাই, আমি বলি, ফিদা হুসেনের এই মধ্যবিত্তপ্রেম বিশেষভাবে দরকার ছিলো না। তিনি মার্কেটবাদি হওয়ার কারণেই সেটা কাটায় উঠতে পারেন নাই। মার্কেটাবাদিতাও দরকার বটে।
ফিদা হুসেনের মুম্বাই চলে আসা আর পোস্টার বানানোর ভেতর দিয়া আগায় যাওয়া তার প্রথম জীবন, এ পর্যায়ে একটা গ্যারেজে তার স্টুডিও হয়া ওঠা, তারপর দিনে দিনে আগায় গেলেন বহুদূর। এইখানে সত্যিকার অর্থেই তার উন্নত শিল্পকাজের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাইতেছে। কেননা সাত্রিশ সালে তিনি বাবার লগে মুম্বাই ঢুকলেন, পঞ্চান্ন সালে ভারতের পদ্মশ্রী পুরুস্কার পায়া যান। এই পিরিয়ডটাই তার জীবনে বিরাট এক পরিবর্ত নিয়া আসে। সেটা খুব তো সোজা না, রাস্তায় শুইয়া পড়া লোক তাড়া খায়া নির্বাসনে যান দূরের দেশে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, শেষমেষ অনেককাল থাকেন দুবাই। ভারতে থাইকা এতোদূর আগাইলেন ফিদা হুসেন, সেটা আসলে ভারতের আমসমাজের প্রতি তার একরকম ফ্যান্টাসি তৈয়ার করে দিলো। সেই ব্যাপারে আমার বক্তব্য আছে। বরং আমি যে তারে পিকাসো বলি না, এইটাই আমার মতের পক্ষে সবচাইতে বড় যুক্তি।
পিকাসোর বৈচিত্র কোন অর্থে যাইতে পারে ফিদা হুসেনের সঙ্গে? সেটা তো দেশপ্রীতির মাঝখানে আলাদা হয়া যায়। আপনে দেখেন যে, একজন পিকাসোর সকল কাজে স্পেন, আবার স্পেন ঢুইকা পড়ে না। সেইখানে পিকাসোর কোন স্বীকারও নাই। কোন কট্টর বয়ান নাই। তবে ফিদা হুসেনের ক্ষেত্রে আমি দেখলাম, তার ভারত-সর্বস্বতা। তিনি বলেন, নিউিইয়র্ক কিম্বা লন্ডনের শিল্পকাজ কইরা থাকলেও সেখানে ভারতীয় আঁচড় ঢুকাইতে তিনি অত্যন্ত সিরিয়াস। এমনকি আরব নিয়া তার কাজগুলাও কখনো ভারত-বাদে দাঁড়ায় না। এইটা ফিদা হুসেনের নিজের স্বীকার, বরং তিনি এমন একটা কানেকশন সচেতনভাবে চালান। যা দেশপ্রেমের হিসাবে করলে অথবা, এই জাতির মধ্যে তার বাইড়া ওঠার বিবরণ করলে প্রতিয়মান হয়, তার মতো ভারতি আসলে কম আছে। পিকাসো ওই অর্থে কট্টর স্প্যানিশ না। আপনে গুয়ের্নিকা আর বিটউন দ্য স্পাইডার এন্ড দ্য ল্যাম্প— পিকাসো আর ফিদা হুসেনের এই দুইটা ছবি মন লাগায় দেখলেই বুঝবেন।
ফিদা হুসেনের এই ভারতপ্রীতি আমার বিশেষ খারাপ লাগে না। এতে কইরা নিজের দেশের প্রচার তিনি করতেই পারেন। তাছাড়া প্রজ্ঞার একটা ব্যাপার আছে, শিল্পের প্রতি শিল্পীর ভল্লাগার হিসাবটা। সেটা শিল্পীরই মনে গইড়া ওঠে। কোন্ শিল্পীর কি মনে ধরলো, তা আপনে আর আমি তো ঠিক করার অধিকার রাখি না। আসলে কোন অর্থেই এর বিরোধিতা করা যায় না। একদল লোকের সমালোচকের কাছে তিনি অনেক পুরান একজন অনাধুনিক হইতে পারেন, আমার কাছে না। ভারতের পাঁচশো বছরের ইতিহাস তুইলা আনার চিন্তা যখন প্যারিসের বিশাল গ্যালারি উদ্বোধনের আগ দিয়া বললেন ফিদা হুসেন, ভারতের অনেকের গায়ে লাগছে সেই বিষয়। কেননা, এতে কইরা মনে হইতে পারে, ফিদা হুসেনের আগে কি ভারতের ইতিহাস কোন শিল্পভাব দিয়া দাঁড়ায় নাই? এই প্রশ্ন আমারে কোনরকমে ফিদা হুসেনের প্রতি ভক্তির কমতি আনে না। আমি জানি, ভারতের ইতিহাস নিয়া চিন্তা কইরা এতো ভালো পেইন্টিং কেউ করে নাই। সারা ভারত ঘুইরা ঘুইরা তার এই বিরাট এক্সপেরিয়ান্স, ভারতের সভ্যতার রঙাল প্রকাশ— আমারে ফিদা হুসেনের প্রতি ভক্তি আরো বাড়ায় দেয়। রামায়ন কিম্বা কোন মহাভারতের চিত্রকর্মের ব্যাপারে আমার বিশষ আগ্রহ নাই বটে, কিন্তু সেটা যখন ইভেন্ট আকারে ফিদা হুসেনের তুলি দিয়া উজ্জ্বল হয়া ওঠে, তখন তো আর ফালায় দেয়ার কোন চান্স নাই। আমি ভাবি, কাজটা বিশাল জায়গা তৈরি করে।
তবে একটা বিষয় খারাপ বা সমালোচনা হইতে পারে, ভারতরে আগায় নিতে গিয়া মাঝেমধ্যেই তিনি হয়া উঠছিলেন সাম্প্রদায়িক। আমেরিকার দুইশো বছরের ইতিহাস, আর ভারতের হাজার বছরের— ফলে ভারতের কাজে আমেরিকা দাঁড়াইতেই পারে না। হইতে পারে, এইসকল ভাব তার ওই মধ্যবিত্তপ্রেমের জন্যই, তবে এইটা তো মূলত বয়ান করলে ভারতের সংস্কৃতি দাঁড়ানোর চাইতে বেশি ফল্ট করে। ভারতের দর্শনের হিসাব আর আমেরিকান দর্শনের ছলাকলায় আমি পা দিতেছি না। খুব সহজভাবেই ভারতের ইতিহাসের মূল্যায়ন অনেকভাবে আমেরিকা হইতে উত্তম হয়। বরঞ্চ আমরা ধইরা নিতে অভস্ত যে, সমস্ত পশ্চিম ভারত হইতেই শিক্ষা নিছে। ওইসব ধোঁয়াশা আলাপে আমি কম যাই। আমি জাস্ট তার সহজ অভিব্যক্তির একটা বাজে দিক দেখাইতেছি। সেইটা মনে হয় না ফিদা হুসেনরে মহান বানায়। তিনি ইতিহাসের মূল্যায়ন করতে গিয়া কিভাবে দেখান যে, বর্তমানের ভারত আমেরিকা হইতে নিম্নতর— শিল্পে। একটা ফোঁকর থাইকা যায়। আজকে পর্যন্ত আমি ছাড়া আর কেউ যেহেতু এই ফোঁকরের আবিষ্কার করতে চায় নাই, সো, আমার কথাতেও ফোঁকর থাকতে পারে। ফিদা হুসেন হয়তো প্রমাণ কইরাও দিতে পারেন যে, এইটা আমেরিকা-বর্জন না, এইটা ভারতের উপরে সত্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন। আমার মনে হয়, অজান্তেই ফিদা হুসেন তার মধ্যবিত্তপ্রেম নিয়া আছিলেন। মাঝে মাঝে সেই চিন্তাটাই বিভিন্ন আলোচনায়, চিত্রকাজে, এবং চলচ্চিত্রে দেশপ্রেম আকারে হাজির হইছে।
ফিদা হুসেনরে নিয়া এই ভারত-ভারত শেপের বাইরে কিভাবে কথা বলা যাইতে পারে, সেটা হয়তো তার ছবিগুলা নিয়া খুঁটায়া খুঁটায়া বিশ্লেষণ। একজন অ-শিল্পীর জায়গা থিকা সেই দায়িত্ব আমি কাটায় যাই। ফলে আমার সাবজেক্ট দাঁড়ায় মনোস্তত্ব। কঠিন অর্থে না, আমি তারে পড়ি। পরে সেইটাই লেখি। তারে আমি যেইরকম বুঝলাম, পাবলিকরে সেইটাই বোঝাই। ফিদা হুসেনরে আমার লিজেন্ড মনে হইলো, দ্বিতীয়ত ভারতবাদি, এবং একই সঙ্গে আমি টের পাই, তার মধ্যে একরকম মিডলক্লাসের প্রতি মমতা কাজ করে। এই জায়গাটা আমার পছন্দ হয় না। যদিও এর জন্য অনেক রিজন থাকে, কারণ বাইর হয়, বাট অপছন্দ তো অপছন্দই। তবে ফিদা হুসেনের একটা ব্যাপার খুব মজার, সেটা বাহ্যিক আচরণগত অভিনিবেশ। সহজ কইরা বললে, ডিফরেন্ট হইতে চাওয়া তার মনোভাব আমারে মজা দেয়। শিল্পীদের মধ্যে এই তাড়না থাকে, যেমন ফিদা হুসেনের খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি। এইটা অনেকেরে তার দিকে ফিরায় দেয়। অনেকেরে, তার প্রতি ফ্যানাটিক বানায় তুলে। খারাপ না তো, এইটা কোনভাবেই সস্তা মনোবৃত্তি হইতে পারে না। শিল্পী আলাদা হইতে পারেন। সবকিছুর পরে তার টাকা লুফে নেয়াটাও খুব সতঃস্ফূর্ত। মানে আপনে তারে বলতে পারবেন না যে, তিনি টাকার জন্য ছোটেন। ফিদা হুসেনের কিছু বক্তব্য আমি পাইছি, সেইখানে তিনি বলছেন, টাকার ব্যাপারে তার দৌড়ানো চিন্তা নাই। অনেকটাই গা-ছাড়া ভাব তিনি দেখান। আবার একই লগে তার ছবি বেচেন মিলিয়ন ডলারে।
ফিদা হুসেনরে আমার ভাল্লাগে। এইটা সহজ হিসাব। তার গজামিনীও আমারে বিশেষ আরাম দেয়। অনেককাল খুঁইজা তিনি যে মাধূরী দিক্ষিতরে ভালো পাইছেন, তা আবার তিনি যুক্তি দিয়া প্রমাণ করছেন। এই হিসাবটাও আমার মনে ধরে। চলচ্চিত্রে তিনি মাধুরীকে দিয়া ভারতি নারীর একটা অভাব দূর করছেন, এই কথা তিনি বলেন। দুবাইয়ের স্বেচ্ছা নির্বাসনের লাইফে অমৃতা রাওকে তার চিত্রকাজে ধরে রাখেন। ভারতের একজন ফিদা হুসেন, মকবুল ফিদা হুসেন যেনো কেবলই ভারতের নারীতে মনোনিবেশ করেন। রেডিসন এলিসির লবিতেও তার লগে থাকেন মাধুরী দিক্ষিত। চিত্রকাজে অমৃতা রাও।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৫৭