একটা টাইমে আমরা নিয়মমাফিক নানিবাড়ি যাইতাম। সেইসব স্মৃতি বড় সুন্দর, এবং একই লগে মনোহরা। আমারে যথেষ্ট কাতর কইরা তোলে ওই টাইম। কতো আগের কালের দিনের-রাতের কিছু পিকচার, যা কি-না আমারে বারি মারে। আমি আঘাত পাইয়া বলি, কতো মজার দিনরাত ছিলো গো, কতো আনন্দের ছিলো।
তো, যাহা যাহা হইলো ওইসব দিনরাতে, মোমেনশাহীতে। বলতে গেলে একটা ফিরিস্তি দেওয়া লাগতেছে। ফলে ছোট কইরা বলাটা দুস্কর ঠেকতেছে। যেমন, একবার আমি উঠানের মাঝখানে বইসা আছি। বিশদ রোদ্দুর চড়তেছে চান্দিতে, খুব সম্ভব তাকানো যাইতেছিলো না। আমি চোখ বন্ধই রাইখা দিছি। তবু আমি তাকাইলাম একবার, কষ্ট-টষ্ট কইরা। তাকায়া দেখি একটা চিল আসতেছে। চিল মানে আকাশের চিল, বহুদূর দিয়া ওইসব চিল ওড়ে। কথা হইলো ওই চিল, সে আসতেছে আমারই দিকে। ভাবগম্ভীর একটা প্রোসেসে। ধীরলয়ে, আস্তে আস্তে সেই চিল আসতেছে। যেনো করুনাধারা ঝরাইতে ঝরাইতে। চিলের এই নীরবতম ভাবে আমি ভয় পায়া গেলাম। সে আসলে কি চায়? চাইতে পারে কি?
শেষমেষ সেই চিল আইসা পড়লো। দেন আমার ডান চোখটি খাবলা দিয়া নিয়া চইলা গেলো। আমি তাকায় রইছি বটে, তবু ডানচোখে আন্ধার। যেহেতু চোখটা আমার নাই। সুতরাং দেখা ইম্পসিবল। মোমেনশাহীতে এই ঘটনাটি ঘটলো ছোটবেলায়, চিলে আমার ডানচোখ নিয়া গেলো। সে কি ওই চোখ খাইলো নাকি ফালায় দিলো, সেটা বলা যাইতেছে না। বাট আমি কানা হয়া গেলাম। তো, কানা হইবার পরে আমি কি যে করি- বুঝতেই পারতেছি না। লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাই না। নানিবাড়ির পুবের ঘরে বামচোখ বন্ধ কইরা ঘুমাই। ডানের টা তো নাইই। যা হোক, চিল কর্তৃক আমার চোখ লইবার দুঃখরে আমি ঘুমায়া চাপা দিলাম।
এইগুলা খুব রঙিন দিন। মোমেনশাহীর আকাশে বাতাসে বর্ষা। সমস্ত টাইমেই বিষ্টি পড়তেছে। টিনের চালের ঘটনা। টুপ টুপ শব্দ হইতেছে। এরই মাঝে আমার চিন্তা হইলো, সেই কবে চিলে আমার চোখ নিছে। সেখানে কি নয়া চোখ গজায় নাই? হাত দিয়া দেখি, না। আশাহত ভঙ্গিতে তারপর আমি পুবের ঘরে পুনরায় ঘুম দিলাম। লাগে, কি একটা অভিমান আমার আমার মধ্যে বাসা বানাইছে, আমি সেই অভিমান পুষতেছি। অভিমান পোষার কথা না, ব্যাপার হলো, পরের ছয় রাত আমি জাস্ট ক্ষাণিকটা অভিমান লয়া ঘুমে কাটায় দিলাম। ঘুমানোর পর সকালবেলা উঠছি। বামচোখের উপর দিয়া এখন একলগে ছয়টা দিন অতিবাহিত হইবো, সেই প্রস্তুতি নিতেছি। মাটির দিকে তাকায় রইছি, আমার বিছানার কিনারে নানি একবাটি ডাইল দিছেন। ডাইলে আমার এলার্জি তৈরি হয়া গেছে। সেটা নানি টের পাইছেন, ফলে এই একবাটি ডাইল। মাটি তাকায়া রইছি, ডাইল খাইতে নিমু, দেখি যে একটা লাউডগা সাপ।
লাউডগা সাপ মোমেনশাহীর অন্যতম ঘটনা। আমি বামচোখ দিয়া লাউডগারে কঠিন নজর দিলাম। সে বোধ হয় আমারে পাত্তা দিলো না। বরঞ্চ একটা খিচ মারলো, ক্ষিপ্র গতিতে আসলো আমার নিকটে, গলায় কিনারে গুলাল হয়া বসলো, আমি বুইঝা ওঠার আগেই সে জোরে কইরা এক কামড় বসায় দিলো।
লাইডগা যে আমারে কামড়টা দিলো, সেটা কই দিলো? এবং ক্যান দিলো? সে আমারে কামড় দিলো গালে। ডানগালে। কামড় দেয়ার পরে আ-রে ব্যথা! সেই কঠিন ব্যথা আমি কিভাবে বোঝাই! মোমেনশাহীর সবথিকা তীব্র ব্যথায় আমি পড়লাম। সেইটা দশ বারো মিনিট ব্যাপী হইবে। পনেরো মিনিটের মাথায় আমি খুব ইজিলি ডাইলে চুমুক দিলাম। কোন পেইন নাই, এরপরে আমার গালটি দেখবার তাড়নায় আয়নার সামনে গিয়াই বিপত্তি ঘটলো। এই দ্বিতীয় লজ্জা আমি কই রাখি?
প্রথমবারে চোখ যাওয়ার পরেই আমার মধ্যে এক টাইপের লজ্জার সৃষ্টি হইছিলো। কারণ, সকলের মতো আমার চোখ-দুই আর স্বাভাবিক না। এইবার আমি প্রবল লজ্জায় পড়ে গেলাম। দেখি যে, গালের উপরে লাল-কালা রঙের কেমন জানি খোবলা-খোবলা হয়া গেছে। বিচ্ছিরি লাগতেছে। লাগে, আমার গালের গোশত ডেড গেছে। পঁচা এবং শুঁকনো গোশতের মতোন দশা, লজ্জায় দুঃখে আমার কান্না আসতে লইলো।
মোমেনশাহীর এইসব কান্নারা এখন বেলুন হইছে। যেনো একটা বাঁশের আগায় বিশটি বেলুন, ওইগুলা আকাশের দিকে উড়তে চাইতেছে। এই কথা রাখি, তখনের মোমেনশাহীর ঘটনা বলি। সুন্দর দিনগুলার কথা। আমার চেহারার ডানসাইডটা এক ভয়ংকর নিলো। নানি অথবা আম্মা, তারা আর আসতে থাকলো না ডাইলের বাটি লয়া। কেনোই বা আসবে? কহেন? তারা ডরাইতে থাকলো। এক পর্যায়ে তারা করলো কি, আমি একদিন ঘুমাইছি, বামচোখটি অফ দিয়া, এবং আমার খোবলা গালের উপর দিয়া মাকড়শা জাতীয় কিছু হাঁটতেছে। এমন সময় তারা বাজার হইতে মিস্ত্রি নিয়াইসা আমার ঘরের দরজাটি চিরতরে লাগায় দিলো। মানে হইলো, প্লাস্টার কইরা দিলো। ফলে আমার বাপ-মার কথা কিছু মনে হইলো। মনে হইলো যে, তারা তো আর আমারে দেখতে পারতেছে না লাইফে। আমিও পারতেছি না। এইটা ক্ষীণ দুঃখের সৃষ্টি করতেছে।
যাই হোক, আমি দুঃখ কাটায়া উঠবার পরে ভাবলাম, এই যে আমার খাওয়া-দাওয়া দরকার পড়তেছে না, তা কিন্তু বেটার। আমি এই ফাঁকে অনেক কাজকাম কইরা নিতে পারি। যেমন শোধ তুলতে পারি। লাউডগাটার উপরে। সে আমার মসৃণ গালটি খোবলা বানায় দিছে, যা খুবই বিভৎস আকার নিছে। আমি চাইলে তারে কোথাও হইতে ধইরা আইনা দাঁত দিয়া চিবাইতে পারি। তা, আমি এই বন্ধ ঘরের মাঝখানে অনেক পুরান এক খাটের তটে বইসা ক্যামনে লাউডগা পাই? কিন্তু তারে তো আমার চাই।
লাউডগার চিন্তু করতে করতে বিস্তর সময় গুজরায়া গেলো। মোমেনশাহীর দিনরাতের থিকা আমি দূরে চইলা গেলাম। যদিও আমি ওইখানেই আছি। ইতিমধ্যে নানিবাড়ির পুবের ঘরের দেয়ালে অসংখ্য গাছ-টাছ বেড়ে উঠতে থাকলো। আর আমার পায়ের হাটু থিকা পরম্পরায় নতুন একটা লোহা টাইপ কিছু জাইগা উঠলো। সমাজ হইতে দূরে আছি বইলা এইসবে আর লজ্জা লাগতেছে না। আয়নাটায় কঠিন জং ধরার কারণে সেখানেও নিজের হালচাল দেখা যাইতেছে না। আমি প্রতিদিন একটা সময়ে বিছানা ছাড়ি, তারপর ক্ষাণিকটা হাঁটি। এই সময়ে আমার দুই পায়ের লগে লগে সেই লোহার চোঙ্গাটিও নড়ানড়ি করে। টং টং শব্দ হয়। আমি দেয়ালের গাছগুলার ফাঁকে লাউডগা খুঁজি, নিয়মিতই করি এই কাজটা। মনে চাইলে ঘুমাই। ঘুমাইলে পরে একটা মজার জিনিস হয়, আমার ডান দিকের চেহারা হইতে গলগলানি আওয়াজ বাইর হয়। তার উপরে রক্ত নামে। সেই রক্ত আবার লাল-টাল হয় না, নেভিব্লু। স্মার্ট কালার। আমার খুবই ভাল্লাগে। কিছু জিনিস আবার ভাল্লাগে না, যেমন আমার অভ্যাস হইলো, শুইয়া সাইরা শরীর খোঁটানো। তো, শরীর খোঁটাইতে গিয়া প্রায়শই মন বেজার হয়। একদিন দেখি, আমার পেটের ডানপাশের একটা থলথলে ভাব হইছে। ইয়োলো কালার। ভ্যাবসা একটা ভাব দাঁড়াইছে। আরেকদিন দেখি, আমার ডানপাশের মাথায় নীরবে এক টিকটিকি হাঁটাহাঁটি চালাইতেছে। এইসব বিরক্তিকর, তবে আমার শরীরের দুইটি বিভক্তি মজাদার। বামপাশটা মসৃণ, সুন্দর, ফর্সা রঙ। ডানপাশটা মনে হয় কুৎসিত।
ইদানীং আমার মাথায় লাউডাগার বাইরেও আরেকটা ব্যাপার ঢুকলো। আমি কি ঘোস্ট হইলাম? নানিবাড়ির প্রথম দিনগুলার মধ্যে আমি এইসব কেচ্ছা-টেচ্ছা বহু শুনছি। একদা আমার নানি আমারে মিডনাইটে একটা ঘটনা বলছিলো, বড় অদ্ভুত সেই ঘটনা। যেমন, সে বলতেছিলো, ধর্ ভাই, তুই যদি ভূত হয়া গেলি, তাহলে তোরে কেমন দেখাইবো? আমি নানির কথা ভাবনায় পইড়া গেলাম। তারপরে ভাবতে লইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৪৮