মুর্তজা বশীরকে আদতেই আপন মনে হলো। কেমন যেনো লাগলো, ব্যথা কাজ করলো ভেতরে। একজন মানুষ, চুরাশি বছরের নিষ্প্রভ দিগন্তে এসে বসে আছেন। কিনারে বাইপাপ, নেবুলাইজার। দূরে একটা মনিটর। সেখানে হার্টবিট আর স্যাচুরেশনে কড়া নজর রাখতে হয়। আমাদের আর কিভাবে ভালো লাগতে পারে? তার সামনে বিশাল ক্যানভাস নেই। অয়েল কালার নেই। কোন এক অপেক্ষার করুণ আকুতি নিয়ে তিনি বসে আছেন। ধরা গেলো, এমন সময়ে আমি তার বাসায় গেলাম। আমাকে দেখে তিনি সামান্য হাসলেন। আমি বসলাম, জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, ঘুম হয়েছে দুপুরে? স্যার মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘কিসের ঘুম?’
আমরা খুব বুঝতে পারছি, বার্ধক্যের ওয়েদার স্যারকে ক্রমশ স্মৃতিকাতর করে দেয়। মনে হয় যেনো, তিনি ওইসব দিনরাতের কথা ভাবেন। তুমুল সময়ের কথা। ফ্রান্সের কথা। জোর-জবরদস্তি বিকালের কথা। আড্ডা, চায়ের কাপ, সন্ধ্যা, রাত, তারপরে রাতের নির্ঘুম প্রহরের প্রতিটা শব্দই যেনো ‘ডেড লিজার্ডে’র মতো হয়ে ওঠে। আমার মনে হয়, একজন স্মৃতিকাতর মানুষ। সম্ভবত স্মৃতিতেই বাঁচেন। তার আব্বার কথা মনে পড়ে, আম্মার কথাও মনে পড়ে। চিঠিগুলো বেজে ওঠে নিরব কবিতার মতো।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার পিতা। মুর্তজা বশীর তার ছেলে। অনেকদিন আগে থেকেই আমার জানার শখ ছিলো, মুর্তজা বশীর কি একজন পিতার একান্ত বাধ্যগত? খুব সম্ভব নিজের কারণেই আমার ভেতরে এই প্রশ্ন উদগত হলো। আমার পিতার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া, এবং স্যারের বেড়ে ওঠার হিসাব। ওইখানে তার পিতার সঙ্গে তার মনোভাবের খবর, সেটা আমি জানতে চাই। এই ব্যাপারটা আমাকে আগ্রহী করলো। আমি আসলে সবার মতোই বের করে আনতে চাইছিলাম ড. শহীদুল্লাহর জীবনের আনন্দ। এই যে মুর্তজা বশীর আর্টের উপরে জীবন কাটালেন, আর্টিস্ট হলেন। অনেক বড়। মহৎ সব শিল্প তার, এইসব কি পিতার ইচ্ছার অনকূলে। তথা, সেই জন্মের পরে শৈশবে, অথবা আরেকটু পরে, পিতা কি এমনটা চাইছিলেন
গতোকাল স্যারের সঙ্গে, জন্মদিনের আয়োজনে, বেঙ্গল গ্যালারি
মুর্তজা বশীর কী চান, আমাদের এটা বললেই হতো। বা এইটুকুই হতে পারে হিসাব্য। বাকি, যেহেতু তার পিতার নাম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুতরাং সেটাও আমাকে-আপানাকে ভাবতে হবে। শেষমেষ সামান্য তাকানোর পরেই আমি বুঝে গেলাম, মুর্তজা বশিরের এক প্রধান বাংলাদেশী শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে তার পিতা ছিলেন স্বতস্ফূর্ত সাহসের মতো। এটার জন্য আমার নিজের উপর কিছুটা রাগ হয়। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, মুর্তজা বশীর একজন বোহেমিয়ান বিক্ষিপ্ত ভাবুক শিল্পী। বোধহয় তাই, সবই তার মধ্যে আছে, ভাবালুতা, উচ্ছ্বলতা, এবং একটা সামগ্রিক শিল্পীর মতোই বোহেমিয়ান জীবনের প্রতি তাড়না। কিন্তু আমার দরকার ছিলো, তিরি আর তার বাবা- উপরোন্তু তাদের মাঝে একটা অবাধ্য পরিবেশ। সেটা হয়নি। আমি ভেবে দেখলাম, না-হওয়াই তো স্বাভাবিক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কেমন, এবং তার ছেলের প্রতি তার দরদের ছায়াপাত কেমন হবার কথা। সেটা তো নিখাদ ব্যাক্তিভাবপন্নতায় ক্ষুণ্ণ হবে না। যা হোক, কথা গুরুতর হচ্ছে। আমি বলতে চাইছি, মুর্তজা বশীর আমাদের সামনে একজন সম্মানিত বৃদ্ধরে চোখ নিয়ে বসে আছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন তার পিতা। কোন একটা চিঠিতে ড. শহীদুল্লাহ পুত্রকে বলেছিলেন, তুমি এটা-এটা করো। তাহলে এভাবে-এভাবে তোমার টাকা হবে।
মুর্তজা বশীর এখন খুব অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকেন। বসে থাকেন। তার ইকোনমিক একটা ব্যালেন্স থাকা দরকার। সেটা হয়ে উঠছে না। আমি কোথায় যেনো পড়েছিলাম, শহীদুল্লাহ তাকে বলেছিলেন, পুত্র হওয়ার কারণেই আমি চাই, তুমি ভালো থাকো। এই যে পিতা হওয়ার পরে তার দরদ, সেটা অতিকায় চিন্তিত হয়ে বলে উঠলো, সন্তানের জীবনের সুখি হওয়ার দরকারিত্ব নিয়ে। এই জায়গাটাই আমি পয়েন্ট করে আনলাম। তিনি এবং তার পিতা, একটা পারম্পরিক শিল্পোন্নয়নের শক্তিশালী তদারকি হয়ে দাঁড়ালো। আমাদের জন্য। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যা করলেন, করে গেলেন। মুর্তজা বশীর আসলেন তারপরে। এরই মাঝে এই আমাদের দেশের কালচার অনেকটা পোক্ত হলো। পিতা-পুত্রের তদারকি আমাদেরকে বিশাল শক্তি দিলো।
অনেক বছর ধরে তারা দুইজন, নিস্বার্থ ভাবনায় বসে বসে আমাদের কালচারাল আর্কাইভটি ভরে তুলছেন। প্রথমত পিতা, ভাষার জমিনে, সুষ্পষ্ট রোদেপোড়া কৃষকের মতো। দ্বিতীয়ত পুত্র, রঙের পাত্রে, তুলি হাতে, স্বাভাবিক, মানুষের নেচারের শুদ্ধায়নে। সৎ একটা স্বপ্নকে জাগিয়ে রেখে। নতুন স্বপ্নের বুঁদবুঁদ তৈরি করে, দারুন চ্যালেঞ্জের জায়গায়।
আমাদের কাছে তিনি চূড়ান্ত সমাদর পেয়ে থাকেন। এই যেমন, আমি চাচ্ছি, তার পা-ছুঁয়ে সালাম করতে। হাত ধরে বসে থাকতে, আমার মনে চাইছে, তাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেই। তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন, তার পায়ের কাছে বসি। ভাবি, তার ঘুমন্ত মুখ দেখি। মূলত এই ব্যপারটাই কোত্থেকে আসে? তিনি একজন শিল্পী। তা বটে, কিন্তু শিল্পী তো আসলে কেবল একজনই না। মুর্তজা বশীরের ইউনিক জায়গাটা আমি ধরতে চেষ্টা করি। তার প্রতি আমার বা আপনার ভিন্ন ভাবনা কিভাবে তৈরি হয়? তিনি যে জীবনে কারো তথাকথিত পোট্রেইট করলেন না, বুকজ্যাকেট করলেন না, স্বভাবতই একজন আন-কমার্শিয়াল মানুষ হয়ে বাঁচলেন। তার এই ভঙ্গিটা কি আমাদেরকে কোন নতুন আমেজ দান করে? আমারা কী মনে করি? তার এই আদলের ভিন্নতা অনেক মহৎ এক কাজ!
শিল্পী টাকা কামাই করবেন কি করবেন না, এটাকে অনেকে ব্যক্তিক একটা সিদ্ধান্ত বলে সাইড করে থাকে। আসলেই ব্যক্তিক, কিন্তু কথা আছে। মুর্তজা বশীরের শিল্পবোধ তাকে একটা উদারতম স্পেস দিয়েছে। তিনি ওইখানে বসে ভাবলেন, আমি আমার শিল্পসত্তাকে বেঁচে দেবো না। অন্য আরেকজন শিল্পী, তিনি টাকা কামাচ্ছেন, এবং তার কাছে এইটা অধিকারের প্রশ্ন। ‘আমি তো পারিই’ টাইপের। তবুও মুর্তজা বশীরের মাত্রাটা আরেকটু আলাদা হয়ে প্রতিপন্ন হলো। কেনো হলো? সেটা তো বুঝিয়ে বলতে হয়।
মুর্তজা বশীর কিন্তু বলতে চাইছেন, আমি কারো গোলাম না। তাতে করে খুব সহজেই তিনি একনায়কের ভুমিকায় দাঁড়িয়ে যান। মজার বিষয় হচ্ছে, অন্য অনেক শিল্পীর কথায় আমরা যা-তা বলছি। তার বেলায় পারছি না। কেনো পারছি না? তিনি মুর্তজা বশীর। তবে হ্যা, আমরা স্বীকার করি, এই যে আমরা মুর্তজা বশীরের ব্যক্তিক ভাবনাকে সার্জারি করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এটা অবশ্যই তার পার্সনালিটির ক্ষতি করলো। এই হিসাবটা অনৈচ্ছিকভাবে শরীর নিয়েছে। তথা, মুর্তজা বশীর কিন্তু কামনা করেননি, এইরকমের একনায়কীয়তা। তিনি নিজের শিল্পসত্ত্বাকে উন্নত, পরিশুদ্ধ, এবং সাফ রাখার জন্যই এইরকম জীবন পার করেছেন। আমরা ভাবতে গিয়ে এই অংক বের করে এনেছি। জীবনের এই প্রান্তে এসে তিনি চিকিৎসার জন্য হাঁপিয়ে ওঠেন। এই যুগে কতো টাকা লাগে, এতো টাকা তার হয়ে ওঠে না।
মুর্তজা বশীরকে পাঠ করতে হলে আমাকে আরো পড়তে হবে। সেই অনুভূতি লেখতে বসার পরে বারবার হচ্ছে। অনেক বিষয় মাথায় চেপে বসছে, কিন্তু আমি নিরবে কাটিয়ে যাচ্ছি। এইটা দুঃখজনক, এবং একটা লেখাকে নিরস করে তোলার জন্য এটাই যথেষ্ট। আমার মন চাইছে, রঙের জগতের বাইরে তার চৈতন্য কেমন, সেটা খুব ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিপুণ পুঁথির মতো পড়ে শোনাতে। দুষ্কর হবে, কিন্তু তার একটা প্রভাবের কথা বলা যায়। উন্নত মানুষের দিক্বিদিক যেই চাহনি, সেটা আমাদের জন্য অনেক বেশি কাম্য। আমরা যদি শুধুমাত্র রঙের মুর্তজা বশীরকে পেয়ে বহুতল আনন্দে ভরে উঠতাম, তার চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারতো? না, আমরা তার মধ্যে একটা সামগ্রিক মোহাচ্ছন্নতা টের পেলাম। এবার কিন্তু আমরা তাকে ভাবতে পারছি বিশাল করে, কালচারাল গ্যালাক্সি থেকে একজন স্রষ্টার দিকে আমরা কিভাবে তাকাবো? ঠিক সেইভাবে। যিনি আমাদের ভাবধারায় প্রতিনিয়ত শৈল্পিক সংস্কার করছেন। সেটা প্রধানত রঙের আশ্চর্য শিল্পর মধ্যে। এরপরে রঙের বাইরে। ক্রমাগত তিনি অজান্তেই শিল্পবোধকে নতুন জাগরণের কাছে উপুর করে দিচ্ছেন। ভাবতে গেলে কতো ভালো লাগে আমাদের, এইজন্য আমরা চাই, তিনি আরো অনেকদিন আমাদের মাঝে থাকেন। সম্মানে, আদরে, নির্বিবাদে, ভালোবাসায়। ধরা গেলো, আমি আরেকদিন তার কাছে গেলাম, তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে বললেন। তারপর আমাকে পায়ের কাছে বসতে বলে ঘুমিয়ে গেলেন। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪০