তুমি বাঁচতে চাইতে পারো ও সোনাভাই, আমি তোমারে বলি, আমার মনটা কেমন করে। যেইরকম কাঁদে। তোমার নীরব মুখের ছবি আমারে আদর করে। আর যেমন, আমার মনে হয়, আমরা যদি বন্ধু হইতাম। একদিন ভোরবেলা বের হয়ে যাইতাম মাঠে, খেলতাম, নাইতাম। রোদ্র উঠতো থাকতো আস্তে, ও সোনাভাই! কোন নদীর কিনারে গিয়া ভিজতাম। সাঁতার দিতাম। তুমি কি সাঁতার জানো?
কিছুদিন আগে একবার তোমার বাড়ি গেলাম। যদিও তুমি নাই, আমি গেলাম। এটা-ওটা দেখলাম, তারপর বের হয়া দেখি বিকাল হইছে। ঝিমায়া পড়ছে রোদ। মানুষেরা হাঁটতেছে-চলতেছে, কয়েকজন বন্ধু, ওরা লেকের কিনারে গিয়া বসছে। ওইখানে পাখি আছে, ওরা চিকুর-চিকুর করতেছে। আমার কান্না আসলো। তাতে কি? আামি কাঁদি উঠলাম না। কতোদূর গিয়া পেছনে চাইলাম। তোমার বাড়ি, একটা সন্ধ্যার মতোন তাকায়া রইছে, যেনো আমারই দিকে। ও সোনাভাই! তুমি কই?
তুমি শেষবার মায়ের কাছে যেতে চাইলা। সেই কঠিন দৃশ্য আমি ভুলে গেলাম। আজকে বাসা থেকে বাহির হইবার পরে দোকানে দাঁড়াইলাম। শুনি, মাইকে গান চলতেছে। সেই সুন্দর সুর এখানে-ওখানে বারি খাইতেছে। মানুষেরা চেয়ারে বসে রইছে। সোনাভাই, তোমারে এতো বেশি মনে পড়তেছে। তুমি বলতেছো, মায়ের কাছে যাইবা। বোনের কাছে যাইবা। তোমার বাপ কইতেছে, পালায়া যাইতে। তুমি তাও পারলা না, সোনাভাই রক্তাক্ত করিডোরে কেমন করে আগাইবা?
মায়ের কাছে যাইতে পারলা্ না আর, আমি প্রতিদিন রাতে মায়ের সামনে বসে বষে খাই। কথা কই, কই যে, কি করলাম সারাদিন। মায়ের কাছে পানি চাই। তুমি শেষবার কেনো মায়েরে পাইলা না বলো? তোমার মায়ের রক্তভেজা বুক তোমারে কেমন বানায় দিলো। হাসু আপা ছিলো কতোদূরে, হাসু আপার কাছে পাঠায় দিতে বললা। কে পাঠাবে? তারাই তো তোমারে মারলো। গুলি করলো, তোমার ছোট বুক রক্তে ভরে গেলো। সেই কঠিন ভোর আমি কিভাবে কাটায়া উঠি? আমার মনে পড়ে। কান্না আসে। লোকেরা আজকে গান বাজায়, তোমার কথা কার মনে আছে? আমি তোমরে ভুলি নাই। সোনাভাই, তুমি আছো। আমরা বন্ধু লাগি। চলো, মাঠের দিকে যাই। তারপর নদীর দিকে যাবো নে। তারপর শহরের স্কুলে যাবো। তুমি পড়বা, গান বলবা।
ওরা যখন তোমারে আর আদর করতে চাইলো না। বাবার মতোন তোমরেও মহান করে দিলো। গুলি করলো, আমি ভাবি, তাগোর মুখ। তাগোর চোখ। কেমন সেইগুলা? তারা কি তোমার দিকে চাইছিলো? তারা কি কেঁপে উঠছিলো? সোনাভাই! তারা কি হাসছিলো? সেই ভোরে, যখন ট্যাঙ্ক দিয়া বত্রিশ নম্বর ঘেরাও দিয়া ফেললো, তুমি কি জানলার কাছে গেলা? তুমি আকাশটা দেখলা? শেষ আকাশ। ওই আকাশেই তুমি চলে যাইবা। শবা্দগুলো তোমার কানের ভেতর দিযা ছোট্ট মনে কষ্ট দিলো। ওইসব শব্দে তোমার বাবা সিঁড়িতে পড়ে গেলো। তোমার মা জীবনের অন্তিমকালে তোমার দিকে চাইলো। তুমি বাঁচতে চাইলা। তুমি তারপর নীরবে ঘুমাইলা। সেই ঘুম আমারে নিস্তেজ করে দেয়। সেই ঘুম ক্ষাণিকটা ভোরের মতোই। দুঃখমাখা আলো নিযা আসে।
তুমি ওই ভোরে ঘুমানোর আগে পৃখিবীর মানুষেরা জেগে উঠছিলো। তাদের মনে কি তোমার চোখের ছায়া পড়ছিলো? বয়স হইছিলো তোমার দশ। সোনাভাই, আমার একটা ভাই আছে। সেও দশ। গতোকাল মনে হয় সে মার্কেট হইতে একটা ব্যাট কিনে আনলো। আমারে জিগাইলো, খেলবা? আমি তাকাইলাম। চলো খেলি গিয়া! ও সোনাভাই, দূর হইতে তোমার বাবার কণ্ঠ ভাসতে ভাসতে আসতেছে। আমি আর আমার ভাইটি খেলতে যাইতেছি। সোনাভাই, লও তুমিও যাইবা। খেলবা। তারপরে নদীতে যাবো নে। নদীতে আমরা তিনজন গাইবো দেশের গান। সন্ধ্যা হইবার অনেক আগে আমরা চলে আসবো। তোমার বাড়িতে তুমি ঢুকে পড়বা, যখনও আলো নিভে নাই। যেনো এই বাড়িতে কোনদিন কিছু হয় নাই। কোন শব্দঅলা ভোর নামে নাই। তোমরা সবাই আছো, তুমি চাইলেই বলতেছো, মায়ের কাছে যাইবা। সোনাভাই, তারপরে তুমি মায়ের কাছে যাইতেছো।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৬