তারেক মাসুদকে পজেটিভ নাকি নেগেটিভ, কোন একভাবে তাকে দাঁড় করানোটা জরুরি। প্রথমতই একজন মানুষ, তিনি ভালো না মন্দ, এই বিচার করে ফেললে আরাম করা যায়। তারেক মাসুদের প্রশ্নে আসলে আমরা দেখি, অনেকেই তার বেহুদা চর্চা করছে।আবার একদল মূর্খ তাকে নিয়া লম্ফন করছে। তিনি এরই মাঝ দিয়া প্রতিয়মান হচ্ছেন দুইরকম। তো, তার ব্যাপারে লেখতে বসার পরে আমার দিলে ব্যথা কাজ করছে। এমন একজন মানুষ, তাকে নিয়া কতো অনর্থ ভুজরুকি হলো। এমনকি এক পর্যায়ে আমার প্রশ্ন জাগলো, তিনি কি আসলে ঠিক? নাকি অঠিক?
যা হোক, তারেক মাসুদের জন্য এই সিচুয়েশন ফলপ্রসু। বিতর্কিত মানুষ আলোচনায় আসেন, এবং বাঙালির মনে বিতর্কিত ব্যক্তিমাত্রই প্রতিভাবান এবং মেধাবি আকারে হাজির হন।আমরা সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, তিনি অবশ্যই সঠিক। পজেটিভ। দেশ, বিদেশ, মানূষ ও সোসাইটির সিরিয়াস প্রশ্নে তার দায় কাটায়া ওঠা কঠিন। তিনি বারবার বৈকিল্যকে সরায় দেন। সুন্দর, স্বাধীন এবং মানবিক একটা উত্তোরণ খোঁজেন।
তারেক মাসুদকে এই জাতির হঠকারিতা থেকে দূরে সরানো হলো। এবার আপনে খেয়াল করে দেখেন, তিনি যা করলেন, তথা যা কিছু করার পরে তিনি মারা গেলেন, এই বর্তমান সময়ে এসে তিনি কতোখানি ইম্পোর্টেন্ট? আমি একটা প্রেজেন্ট প্রেক্ষাপটের কথা বলছি। তিনি যেহেতু জীবনে কোন সময়েই একজন কমার্শিয়াল মানুষ হিসাবে নিজেকে জাহের করলেন না, তাহলে তার কাজের জায়গাটা উঁচা। এবং একই সাথে শুদ্ধায়নের শামিল। আপনে মনোযোগ বসায়া দিতে পারেন, তারপর জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের এই চলতি কালচারেও কি তাকে লাগে? বা লাগানো যেতে পারে?
এই যে আপনাকে প্রশ্ন করলাম সেটা আপনে সহজেই গ্রহণ করতে পারলেন। কেননা, তারেক মাসুদ ফাউ কাজে ছিলেন না। সেটার চাইতেও শক্তিমান আলাপ হলো, তিনি বুঝতে পারলেন, একপাক্ষিক হয়ে ওঠা জরুরি। মানে হলো, নিজেকে কোন এক পাশের মানুষ করে তোলা। তিনি তাই করলেন। দিনে দিনে আমাদের দেশে মুক্তমন চর্চার ফলন যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে অনেকেই যদি তারেক মাসুদকে টেনে আনেন, আস্তে করে বেঁচে যান। কঠিন কথা কিন্তু, কেউ যদি আবার তারেক মাসুদের মাটির ময়না বানাতে চায়, সে আলোচনায় আসবে। ওইখান থেকে পর্যায়ে চলে যাবে বিশ্ববাজারে। জার্মানি বলবে, তোমারেই তো চাই। সো, তারেক মাসুদের মনবৈষয়িক চিন্তাগুলোর চর্চা করলে যেহেতু একটা বিজলি চমকায়, সারা বিশ্ব ঘুরে তাকায়, তার মানে চিন্তাটা জীবিত। চলমান। তারেক মাসুদ মারা গেলেন, রয়ে গেলো তার সাবজেক্টগুলো। সেইগুলো পাতাবাহারের মতো, নীরবে ছায়া দিচ্ছে। তিনি যে এখনো দরকারি, এইটা বোঝা যাচ্ছে।
তারেক মাসুদ ফরিদপুরের মানুষ। উনিশশো সাতান্ন সালে তার জন্ম। শুরুটা মাদ্রাসায়, পড়ালেখার জীবনে। আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি, তাকে মাদ্রসাবিরোধি একজন পরিচালক করে তুলতে কিছু মানুষ প্রথমেই এই জীবনটার কথা আনেন। তারা অনেকটা সাইক্রিয়াটিস্টের ভাবে ধরে বলতে থাকেন, তারেক মাসুদের সমস্ত কাজ এই শিশুবেলার সময়ের প্রতিফলন। আমার হাসি লাগে, এই সময়টা তার অল্প। তাকে মৌলানাপাশ বানাতেও অনেকের অনেক তোড়জোর। এটাও একটা ভুয়া প্রশান্তি। মৌলানা হতে টাইম লাগে, তিনি এতো টাইম নষ্ট করেননি। যুদ্ধের সময়ে তিনি মাদ্রাসা ছাড়েন। এরপরে সাধারণ শিক্ষায় বড় হয়ে ওঠেন। আমি বলি, তার বয়স হয়। ফলে অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন ফাঁপা হয়। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকেই মাস্টার্স পাশ করেন, ইতিহাসে।
প্রসিদ্ধির বলয়ে তারেক মাসুদের ইন করার পিরিয়ডটা দীর্ঘ এবং স্লো। তার বড় কাজের বাইরেও কয়েকটা ছোট কাজ আমার প্রিয়। এর মঝে কাজ আছে, ডকুমেন্টারি, ওগুলো ভালো। ভয়েসেস অব চিলড্রেন, অথবা আ কাইন্ড অব চাইল্ডহুড- এই টাইপের। তবে বলতে হয় বড় কাজগুলোই প্রধান। শুধু প্রধানই না, মহান। এস এম সুলতানের জীবনের উপর একটা ডকুমেন্টারি করেন, সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো।ওইটার নাম ছিলো ‘আদম সুরত।’ উনিশশো বিরাশি সাল থেকে উননব্বুই সাল পর্যন্ত একটা বড় সময় তিনি এইটার জন্য ব্যয় করেন। ফায়দা হয়েছিলো, একথা তিনিই বলেছেন।
লিয়ার লেভিন নামের এক মার্কিন লোক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটা ডকুমেন্টারির অভিপ্রায় করেছিলেন। সেইটা বিফলে গেছে। তিনি তখন ঘুরে ঘুরে ফুটেজ সংগ্রহ করেন। বিশ ঘন্টার ফুটেজ পরে টাকার অভাবে গিয়ে জমা হয় নিউইয়র্কে।ডকুমেন্টারিটা তার হাতে হয়ে ওঠে না। লেভিনের দিক দিয়া দেখলে এইটা দুঃখের সংবাদ। কিন্তু এক সময়ে তারেক মাসুদ এবং তার বউ ক্যাথরিন মাসুদ সেই ফুটেজটি সংগ্রহ করেন। তখন দুঃখটা চাপা পড়ে। ভালো লাগে।তিনি এটাকে ‘মুক্তির গান’ নামে নতুনভাবে সংস্কার করেন। বলতে কি, তারেক মাসুদের কাজে ‘মুক্তির গান’ একটি বৃহৎ আবেগের সৃষ্টি করতে পারে। ছবি বানানোর কাজে।
আরেকটা ছবি আছে, অন্তর্যাত্রা। এইটাও আমার ভালো লাগলো। বেশিদিন হয় নাই, আমি এটা দেখেছি। চিন্তার একটা সুন্দর কারুকাজ আছে। মনস্তাত্বিক ব্যাপারগুলোই যখন চিত্রে উঠে আসে, তখন সেটা অসাধারণ না হয়ে পারে না। তুমুল মনের কথা, প্রশান্তি ও প্রত্যাশার চাহিদা ছবিতে দেখা যায়, দর্শক তখন যথাযথ মুগ্ধ হয়। বাধ্য হয়, নড়ে উঠতে। তবে আমাদের দেশে একটা প্রচলিত সমস্যা আছে, সেটা হলো অনুন্নত কাজ। আমি বলতে চাইছি, প্রেম-ভালোবাসা, সাংসারিক আদর-অনাদর, ইত্যাদি বিষয় নিয়া বহু ছবি হয়ে গেছে এই দেশে। ভালো ছবির সংখ্যা কম। তারেক মাসুদের অন্তর্যাত্রা সেই বেখাপ্পা জায়গাটা কিছু হলেও ঢাকতে পেরেছে। অত্যন্ত খুশি ও সাফল্যের খবর।
তারেক মাসুদের আরো দুইটা কাজ, মাটির ময়না এবং রানওয়ে। এই দুই জিনিস নিয়ে কেনো যে এতো হট্টগোল, আমি বুঝে উঠি না। সহজভাবে বোঝা যায়, মাটির ময়না ছবিটাতে মাদ্রাসার একটা পুরানকালের ভেতরগত চিত্র ফুটায়ে তোলা হয়েছে। যুদ্ধের সময়ের হিসাবে। তাতেই আমাদের দেশের মাদ্রাসা-সমাজ বহুল ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন রাগ ঝেড়েছেন। আসলে কিন্তু তাদের এই আন্দোলন, বিপ্লব, এইগুলা উচিত হয় নাই।আপনে দেখেন, সেই কতোকোলের আগের গল্প। এখন বানানো হইলো। আর আপনে তাতেই রেগেমেগে টম্বুর। এটা আপনার নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করে দিছে। আপনে বলতে পরেন, মাটির ময়না একটি তথ্যচিত্র। তাহলে এতো পুরনো সময়ের গড়নে কেনো? আমি বললাম, মাদ্রসাগণ্ডির আ্ওতাধীন অঞ্চলে এই কদাচিৎ সমস্যাগুলো এখনো পর্যন্ত আছে, মানে তারেক মাসুদের মাটির ময়নার দশ বছর পরেও এইসব অনাদর থেকে তারা মুক্ত হতে পারে নাই। এবং সেটা মাদ্রাসাঅলাদের জন্য খুব কঠিন কাজ হয়ে উঠছে। আমি কিছুদিন আগে নিজের ভাগ্যবর্তনের সময়ে ভাবতে আরম্ভ করছিলাম, আমিও যদি বানাই, তারেক মাসুতের মতোই, তথ্যচিত্র আকারে। আমি জানি, এই কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তবে আমি যদি সেটা করতাম, তবে মাদ্রাসাজনতা আবার পথে আসতো। বলতো, তারা যা যা বলতে চায়। বা বলে অভ্যস্ত।
এমনকি আপনে খেয়াল করবেন, রানওয়ে মুভিটা তারেক মাসুদের জন্য একটা নেগেটিভ বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকে ব্যাখ্যা করছে, তার মনন এমনই। তারেক মাসুদ বললেন, মাটির ময়নার বিরুদ্ধে এতো বেশি চিল্লাহল্লার কারণে সেটা ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের তরুণেরা দেখতে পারে নাই। রানওয়ে দেখাটা তাদের জন্য জরুরি। অথচ এই ছবিটাকেও পেষানো হয়েছে। শেষপর্যন্ত আপনে দেখবেন, মুক্তমনচর্চাকারী লোকজনও এইটাকে একটা ধর্মীয় বিদিশের মানদণ্ড বানিয়ে ফেলেছে। তাদের ন্যানো মাইন্ড দেখে আমার হাসি লাগে, তারেক মাসুদ দিনে দিনে ফিল্ম মেকার থেকে বেশি জরুরি হয়েছেন মৌলাবাদিতার বিরুদ্ধে একটা লিফলেট হিসাবে। আমি আগেই বলছি, কিছু মানুষ এমন করে দেখছেন, তারেক মাসুদ মাদ্রাসায় পড়ার সময় অনেক নির্যাতিত হয়েছেন।ফলত তার জীবনটা এইখানেই মার্কড হয়ে গেছে। তিনি কেবল এই মাপের উত্তোরণ দিতেই জানেন। তাদের বোঝা চাই, ব্যাপারটা তার মনের মাঝের শিশু-কল্পনা না। তারেক মাসুদ দেখেছেন, এই বিষয়টা তার বৈশ্বিক হয়ে ওঠার সরু সুরঙ্গ হতে পারে। হয়েছেও। তিনি আরো বুঝেছেন, এই ব্যাপারটা টিকে খাকতে পারে। কিভাবে? তিনি জানেন, পশ্চিম খুব তাড়তাড়ি দুনিয়ার দরবারে একটা এন্টি ইসলাম রূপে হাজির হচ্ছে। তাতে করে, পৃথিবীর তাবৎ ছবিবানানোঅলাগণ তাবেদারির জন্যই এই বিষয়টা হাইলাইট করবেন। তারেক মাসুদ সেই সুবিধা পেয়েছেন।
তবে, তার বৈশ্বিক হয়ে ওঠাটা যে নিখাদ নাম ওঠানো, এটা বললেও খুব বাজে প্রলাপ হবে। সাধারণভাবে ইসলামকে না বললে আলোচনায় আসা যায় বটে, কিন্তু তরেক মাসুদ শুধু আলোচনাই চান নাই। তিনি জীবনে সকল কাজই ডকুমেন্টরি বিভাগে উত্তির্ণ করেছেন। আমরা এর দ্বারা বুঝতে পেরেছি, তিনি খুব রেভ্যুলেশনের কামনা করেছিলেন। আপনে তার একটা ডকুমেন্টারি দেখে তো বসে থাকবেন না। আপনি প্রভাবিত হবেন। তারেক মাসুদ নিজের চিন্তার প্রভাব ফেলতে চেয়েছেন। সেটা সমাজের মেন্টালিটিকে আঘাত করেছে। তারপরে, আমরা বুঝেছি, অঘাতের ফলে মানুষের পরিবর্তন তারেক মাসুদের অণ্যতম পয়েন্ট।
তারেক মাসুদ নিয়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ হলো, আমরা তার কাজ ও চিন্তাকে সদ্ভাবে স্যালুট করতে পারছি। এটা বড় বিষয়। সেগুলো আমাদেরকে আরাম দিচ্ছে। প্রশান্তি দিচ্ছে। এবং সর্বোপরি তারেক মাসুদ কিন্তু আমাদের এই ভালো লাগার মধ্যেই টিকে আছেন। এখানে তার মৃত্যুটাও তাকে সাহায্য করেছে।
আমি বা আপনে অবগত আছি, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মরা গেছেন। এই পদ্ধতি খুব সামাজিক না। তবে এর দ্বারা কিন্তু তারেক মাসুদ একটা স্বাভাবিক আয়ুর আগেই মারা গেলেন। তাই সেটা রাজনৈতিক হলো। আমরা বলতে পারলাম, তার অকাল মৃত্যুতে আমরা দুখি। তথা, তার সামনে না জানি আরো কতোকাজের ভাণ্ডার ছিলো। এভাবে তিনি আমাদের মনের ভেতরে একটা স্বপ্নভঙ্গের চর্চা হিসবে রয়ে গেলেন। তারেক মাসুদ যদি বেঁচে থাকতেন, কতো ভালো হতো- এই কামনার প্রকাশে তিনি আবার জীবিত হলেন। তার মৃত্যুই খুব সম্ভব তাকে অমরতা দান করলো। ভেবে দেখেন, অমরতা কিন্তু এক বিশাল ব্যাপার।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৫