দৈনিক লা রিপাবলিকার সংবাদে আমরা আসলেও ভড়কে গেলাম। আমরা কেবল শুনেছিলাম, গার্সিয়া খুব অসুস্থ আছেন। লিম্ফাটিক ক্যান্সারের দানায় গার্সিয়ার শরীর ভরে গেছে। আমরা ভয়ে ছিলাম। লা রিপাবলিকা আমাদের ভয়কে নিরাশার মাটিতে চেপে দিলো। আশাবাক্য হলো, আমরা জানতে পারলাম তারপর- গার্সিয়া মরেন নি। এবং এটাও খুব সুখের সংবাদ ছিলো। আমাদের খুব সামর্থ্য ছিলো না গার্সিয়ার বাড়িতে যাওয়ার। একজন অসুস্থ গার্সিয়ার পাশে বসে দুপুরকে বিকেল করে দেবার। কিন্তু আমরা তাকে আঁকড়ে ধরে ফেললাম। শক্তপোক্তভাবে। গার্সিয়া আর কোনদিন আমাদের কাছ থেকে ছুটে যেতে পারেন নি। যেখানে যেরকম, এপাশে ওপাশে- যেই কাগজ কিংবা পর্দায় গার্সিয়া হেসেছেন, আমরা মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের কিছুটা অনুকরণ-নির্ভর কঠিন সাহিত্যের বিপরীতেই নিবাস ছিলো গার্সিয়ার। অনেকটা খোলামেলা। উচ্চতর ভাবনা-ক্রিয়া থেকে মুক্ত। পুরোটা সাবলীল নয়। কিন্তু অমায়িক মোহময়তার ভেতরে আমরা লুটোপুটি খেতাম।
‘সোমবারের সকালটা ছিলো উষ্ণ এবং বৃষ্টিবিহীন।’ আজকে সকালেই গ্যাব্রিয়ে্ল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পটা পড়ে ফেলে নিখাদ জেগে উঠেছি। এবং আমরা কথা দিয়েছিলাম গার্সিয়া মার্কেজকে ভুলে যাবো না। আমরা ভুলেও যাইনি কিঞ্চিৎ। মনে রেখেছি। উনিশশো সাতাশ সালের নয়ে মার্চ থেকে যেই দিনটা পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন। আমরা খুব আবেগ নিয়ে ভেবে থাকি, একদিন গার্সিয়ার বাড়িতে খুব করে হানা দিতো ক্যারীবীয় সাগরের অবাধ্য বাতাস। তিনি যখন অন্ধকার-মাখানো চৌকাঠ মাড়িয়ে যান নি। বিষণ্ন একা বাড়িতে দিন কাটান। আর তার বোনটি মাটি খায়। আমরা জেনেছিলাম, গার্সিয়া এক্জন কলোম্বিয়ান। ক্যারীবীয় উপকুলের আরাকাটাকা শহরে জন্মেছিলেন।
কোন এক সমুদ্রের বীচে গ্যাব্রিয়েল যখন কিশোর, পত্রিকাঅলারা বলে থাকে চৌদ্দ বছর বয়স। মের্সেদেসকে দেখে তিনি বললেন, এই মেয়ের সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। মের্সেদেস তখন মাত্র আট। আমরা অবাক হয়ে যাই, গ্যাবিয়েল এই মের্সেদেস্কেই বিয়ে করলেন। পরিপুষ্ট জীবনের পথে হেঁটেছেন বটে- মের্সেদেস অবশ্যই এই গ্যাব্রিয়েল-নামার নেপথ্য। দুর্দান্ত বন্ধু। গ্যাব্রিয়েল স্বীকার করেছিলেন, এবং সত্যের মতো নিরেট গলায় বলেছিলেন- ‘আমার ‘নিঃঙ্গতার এক শতাব্দী’র অর্ধেক কাটতি মের্সেদেসের পাতে যাবে’। গ্যাব্রিয়েল বেশি বলেন না। সত্যটুকুন লেখেন। একটা বই লিখতে চাচ্ছিলেন তিনি, একান্তে বসে থেকেই লিখবেন। যতোটা আড়াল, ততোটাই মগজপ্রয়োগ। একটা বাড়ি বন্ধক রাখলেন কোথাও, মের্সেদেসের হাতে গুজে দিলেন কিছু টাকা। ছয় মাস চলে যাবে। গ্যাব্রিয়েলের খুব দেরী হয়েছিলো। বইটা লিখে শেষ করতে করতে দেড় বছর। এতোটা সময় বোঝা টেনে নিলেন মের্সেদেস। যেনো খুব স্বাভাবিক, বাড়ি-ভাড়াটা বাকি করছেন। সময়মতোই মিটিয়ে দেবেন। রুটিঅলাকেও হাত করলেন। বাচ্চারা খেতো। মের্সেদেস নিয়ম করে কাগজ এনে দিতেন। গ্যাব্রিয়েল লিখতেন। বিয়েটা হয়েছিলো সাতান্ন সালে।
একটা জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে সাংবাদিকতায়। “এল এরালদো” থেকে “এল এস্পেক্তাদোর”- গ্যাব্রিয়েল কার্তাহেনা শহর থেকে চলে আসলেন রাজধানী বোগোতায়। সবটাই জগতের গণিত। আরো ছুটলেন রোম, প্যারিস, বার্সেলনায়। ক্যানসাস, নিউ ইয়র্কেও অনেকটা সময়। বিদেশী সাংবাদিক হিসেবে। কেবল জীবিকার তাগাদা থেকেই নয়, আমরা জানি, গ্যাব্রিয়েল সংকটের বিরুদ্ধে ভাবাপন্ন ছিলেন। উদ্বিগ্ন এবং কলোম্বিয়ান রাজনীতির ঘোর সমলোচক ছিলেন। নিজস্ব বোধ থেকেই একটা সময় কমউনিজমের কাছাকাছি ভিড়েছেন। ফিদেল কাস্ট্রো একদিন তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ষাটের দশকে। যখন পর্যন্ত একজন সুনামী সাংবাদিক, আমরা তখনো তাকে উপন্যাসিক কিংবা গল্পকারের রূপে চিনতাম না। কাস্ট্রোর সঙ্গে খুব বন্ধুতা হয়েছিলো। হেঁটেছিলেন পাশাপাশি। আমরা দেখেছি, গ্যাব্রিয়েল যেনো অনেকটাই একাকীত্বপ্রিয়। একা একাই তো থেকেছেন। দুইটা ছেলে ছিলো তার, রোদ্রিগো আর গোন্সালো। গ্যাব্রিয়েলের শরীরজুড়েই ল্যাটিন আমেরিকার গন্ধ ছিলো। কলমটা তবে মুক্ত আর ক্ষুধাতুর। একমাত্র এই কারণেই হয়তো আমরা বারবার হোর্হে বোর্হেসের কিনারে তাকে দাঁড় করিয়ে দেই। আমরা স্বস্তি পাই। সেইসাথে এটা সঙ্গত। আমাদের দেশীয় সাহিত্য যদিও খুব বিচ্ছিন্ন ল্যাটিন সাহিত্যের পৃরষ্পরিক যোগাযোগে। কিন্তু একটা সত্য কথা অনেকের মুখে শুনি, ল্যাটিন আমেরিকার কাহিনীময়তা, তথা চলতি পথে মানুষের জীবনের বহুলতা অনেক বেশি আমাদের সাথে মিলে যায়। গ্যাব্রিয়েলকে আমরা নিজের সাহিত্য-বন্ধু ভাবতে পারবো না। তবে তিনি আমাদেরই লোক। আমাদের সমান্তরাল জীবনে যেই বিপর্যস্ততার মুখোমুখি হয়ে থাকি আমরা, গ্যাব্রিয়েল সেইসব পার করেছেন। তিনি একজন লন্ডনী কিংবা রুশী লেখক নন। আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ। সাধারণ অনুভূতি বিভিন্ন চেহারায় বারবার যাকে ছুয়ে গেছে। এজন্যই বিপ্লবকে তিনি রাজনীতির মাঝ দিয়ে দেখতে পেরেছেন। একটা রচনায় সিরিয়াস হতে গিয়ে কার্যকারিতা খুঁজেছেন। সর্বোপরি তুখোড় জীবনবোধ, আমাদের গ্যাব্রিয়েলকে অসামান্য করে তুলেছে।
আমরা গ্যাব্রিয়েলের পিতার কাছ থেকে জেনেছি এইরকম। তার বিখ্যাত একটা উপন্যাস, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা।’ পিতা আমাদেরকে জানিয়েছেন, উপন্যাসটা নিখাদ ভাবনা থেকে নয়, উঠে এসেছে কাল্পনিক বাস্তবতার জঠর থেকে। গ্যাব্রিয়েলের পিতা-মাতা, তাদের প্রেম ও প্রণয়, এবং সর্বশেষ পরিণয়কে গ্যাব্রিয়েল দারুনভাবে বিছিয়ে দিয়েছেন। কলেরা রটে গেছে। মানুষ মরে যাচ্ছে। এবং গ্যাব্রিয়েল তুলে এনেছেন প্রেম। বলে যাচ্ছেন বার্ধক্যের কথা, তৃষ্ণার কথা- “আমি বাচতে চাই, আমি পানি চাই”। তিনি অসুখের গন্ধ বলে দিলেন, এবং বললেন অসুখের গন্ধ থেকেও বেশি কষ্ট দেয় বার্ধক্যের বয়ান। গ্যাব্রিয়েল সবগুলো কাজ অসাধারণ করে গেছেন। আমরা যৌনতা চাই, গ্যাব্রিয়েল লিখেছেন। আমরা বিপ্লব করি, গ্যাব্রিয়েল বুঝিয়েছেন। আমরা বাস্তব আর বাস্তবহীনতার মাঝ দিয়ে চলি, গ্যাব্রিয়েল রেখা টেনে দিয়েছেন। আমরা কল্পনা কিংবা ফ্যান্টাসির তালাশ করি, গ্যাব্রিয়েল আমাদেরকে হাসিয়েছেন। আমদেরকে কাদিয়েছেন। অদ্ভুত! একটা উপন্যাসের তিন কোটি কপি আমরা নির্দ্বিধায় কিনে নিয়েছি।
যাদুবাস্তবতার বিস্তার ঘটালেন। বোদ্ধারা বেহুদাই নিন্দা কপচে গেলেন। গ্যাব্রিয়েল একবার খুব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, সমলোচকদের তিনি পছন্দ করেন না। একটা উপন্যাস থেকে যতোটুকু চুষে নেবার থাকে, গ্যাব্রিয়েল আমাদেরকে বলেন- সমলোচকদের যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তার থেকে বেশি, এরা থেমে যান না। কাটাকুটি তো আর পারেন না, চিপড়াতে থাকেন। গ্যাব্রিয়েলের বিরক্ত হয়। তার পছন্দ ছিলো ড্রাকুলা, গার্গানতুয়াগার্সিয়া, জুলিয়ো সিজার, সংগীতের দুনিয়াতে বেলা বাতকের। আমাদের কিছুটা আনন্দ হয়, যখন শুনে থাকি, গ্যাব্রিয়েলের বিশেষ অপছন্দ হলো কলোম্বাস। ক্রিস্টোফার কলোম্বাস।
উনিশশো বিরাশি সালে নোবেল পান। লোকে বলে থাকে, উপন্যাস আর ছোটগল্পের গায়ে চড়ে এই সম্মান। আমরা কিন্তু একটা প্যাটার্নের শর্ত জুড়ে দেই। গ্যাব্রিয়েলের অবকাঠামো আমাদেরকে মুগ্ধ করে। অবশ করে। গ্যাব্রিয়েল নিজেও একথা স্বীকার করে নেন। সারাটা রচনাই গুরুগম্ভীর এগোতে থাকে। মাঝখানেই কল্পচাষ। এরই মধ্যে বাস্তবতার পরাবস্তবিক বয়ান। একদম স্বচ্ছ ল্যাটিনীয় স্বপ্নতা।
জীবনের প্রান্তে এসে তিনি গুটিয়ে যান। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কাছে লোকে যায়, দেখা করতে চায়। তিনি কাটিয়ে চলেন। একজন ভাই ছিলেন। দেখা করে আসেন। খোঁজ করেন। একটা সময় গ্যাব্রিয়েল স্মৃতিও হারিয়ে বসেন। অতীতপনায় ভাসতে অসুবিধা। জীবনের প্রতি রেগে ওঠেন। মরে যেতে চান কিনা- অথচ মরে যাওয়া নিতান্ত কঠিন। একটা আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটাই আমাদের হাতে আসে। আর বাকিগুলো বেরোয় না। আমাদের বাকিটা দরকার ছিলো, বর্ণনার এমন রুচিময় বিন্যাস আমরা কোথায় পাই? গ্যাব্রিয়েল সর্বদাই সংলাপ এভয়েট করেন। অবশ্য তিনি চান না, গল্পের পরিবেশ চর্বিযুক্ত হয়ে লোকের হাতে যাবে। তিনি পরিমিত শিল্পায়নেই বিশ্বাসী। কোন এককালে তার রাজনৈতিক দর্শন আমজনতাকে আঘাত করে। কথা বলতে শেখায়।
এবং শেষ্পর্যন্ত, আমদের বলতে কষ্ট হয় যে, গ্যাব্রিয়েল চলে যান। মেক্সিকোর একটা হাসপাতালের সফেদ বিছানায় কিছুদিন কষ্ট করে বলে দেন, তিনি ফিরবেন না। দুই হজার চৌদ্দ সালের সতেরো এপ্রীল। মের্সেদসের একান্ত গ্যাব্রিয়েল চোখ বন্ধ করে থাকেন। সাতাশি বছরের এক বার্ধক্যবাহী জাহাজ। তিনি দিগন্তে মিলিয়ে যান।