এমন একটা সময় ছিল যখন চলচিত্র বিষয়ক প্রচারণা আর মানুষকে হলমুখী করে তোলার অন্যতম একটা মাধ্যম ছিল সিনেমার ব্যানার পেইটিং!
সিনেমা প্রেক্ষাগৃহের সামনে ব্যানার পেইন্টিং নিশ্চয়ই আপনারা খেয়াল করেছেন, সাধারণত প্রেক্ষাগৃহের উপরে বিশাল আকারে যে সব ছবি আঁকা থাকে হয়, সেটাই!
কিছুকাল আগ পর্যন্তও কিছু বিশেষ চিত্রশিল্পীগন এই সব ব্যানার গুলো হাতে আঁকাতেন! কাপড়ের বিশাল ক্যানভাসের উপর খুব উজ্জ্বল সব রঙে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অতিরঞ্জিত পোট্রেট ভিত্তক এই পেইন্টিং এর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে শিল্পধারায় নতুন এক ধারার সূচনা হয়েছিল!
ঠিক কবে থেকে বাংলাদেশে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং এর সূচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনিশ্চিত কোন তথ্য অবশ্য জানা যায়নি! তবে এখনও যারা বংশপরম্পরায় এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছেন, তাদের মতে দেশ বিভাগের পর থেকেই বাংলাদেশে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং শিল্পের পথ চলা শুরু হয়েছিল!
বানিজ্যিকভাবে চলচিত্র প্রদর্শন ও প্রেক্ষাগৃহ নির্মানের সূচনা, বিবর্তনের সাথে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং এর ইতিহাস ঘনিষ্ট ভাবে জড়িয়ে আছে!
প্যারিসের একটা ক্যাফেতে জনসাধারণের সামনে বিশ্বের প্রথম চলচিত্রটির প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করেছিলেন লুমিয়ের ভাতৃদ্বয়, দিনটা ছিল ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর! এর ঠিক তিনবছর পরে ১৮৯৮ সালে ঢাকাবাসীর কাছে উন্মোচিত হয় প্রথম সিনেমার রূপালী পর্দাটি! ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে এই প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করেছিল কোলকাতার ব্রেডফোর্ড কোম্পানী!
ধীর ধীরে চলচিত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে ফলে এক সময়ে প্রয়োজন দেখা দেয় স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহের! ঢাকায় প্রথম যে প্রেক্ষাগৃহটি তৈরি হয়েছিল, সেটা 'পিকচার গ্যালারী! সিনেমার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে ৪০ দশকের মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অনেক প্রেক্ষাগৃহ নির্মানের কথা জানা যায়, দেশ বিভাগের সময়ে বাংলাদেশে মোটমাট ১২০ টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল!
তো সেই সময়ে সিনেমার প্রচারণার ধরতে গেলে একমাত্র মাধ্যমই ছিল ব্যানার, পোস্টার আর লিফলেট! দেশ বিভাগের আগে এই ব্যানার পেইন্টিংটা একটু ভিন্ন রকমের ছিল! তখন সিনেমা হলের একটা নির্দিষ্ট দেয়ালে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি আর সিনেমা নাম বড় বড় করে লেখা থাকতো! বলা যায় এটাই ছিল বাংলাদেশে সিনেমা ব্যানারের আদি রূপ!
ততদিনে অবশ্য আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত আর পাকিস্তানে অবশ্য ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রীর কারনে সেখানে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং বেশ ভাল ভাবেই অবস্থান করে নিয়েছিল!
ভারতে ব্যানার পেইন্টিং ধারাটা মোটামুটি তিনটি ধারায় গড়ে উঠেছিল,
১। রবি বর্মার ফিগার কেন্দ্রীক ওয়েল পেইন্টিং।
২।বোম্বে স্কুল অব আর্টের ইউরোপীয় সাদৃশ্যধর্মী শিল্পরীতি।
৩।Art Deco, এটা সরাসরি ইউরোপীয় রিতী!
যাই হোক, পরবর্তী সময়ে যখন দেশ বিভাগ হলো তখন বিপুল সংখ্যক অবাঙ্গালী বাংলাদেশে অভিবাসন করে, তাদের অনেকেই এই সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং এর কাজে জড়িত ছিল। মূলত: এদের হাত ধরেই বাংলাদেশ এই শিল্পের সূত্রপাত হয়! যেমন ঢাকার সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং এর অন্যড়ম পথিকৃৎ মুনলাইট সিনেমা হলের মালিক মোহাম্মদ সেলিমের আদি নিবাস ছিল মুম্বাই। এছাড়া আবদুল ওহাব (সৈয়দপুরের বিখ্যাত 'দাদা আর্ট') ছিলেন চেন্নাইয়ের!
এই সকল বহিরাগতদের এই কাজে তখন হাত দিয়েছিলেন ছিল দেশীয় স্বশিক্ষিত বেশ কয়েকজন পেইন্টার!
তিরিশ চল্লিশের দশকের এমন ঢাকার বিখ্যাত পেইন্টার ছিলেন পিতল রাম সুর, তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠিনিক শিক্ষা ছিল না! জনশ্রুতি আছে যে, পিতলরাম একবার কাউকে দেখে হুবহু তার ছবি একে দিতে পারতেন! এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, ঢাকার ওয়াইজা ঘাট এলাকায় তার 'আর্ট হাউজ' নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানও ছিল যেখানে সিনেমার ব্যানার থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড, ফটোস্টুডিওর দৃশ্য এসবও আকাঁ হতো!
বাংলাদেশে সিনেমা ব্যানার শিল্পের গড়ে উঠেছিল প্রধানত দু'টো শহরকে কেন্দ্র করে......
১। সৈয়দপুর: সৈয়দপুরে চেন্নাই থেকে আসা আবদুল ওহাব, আবদুল হাফিজ ও এস.এম.শাহবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাইরের প্রভাব মুক্ত একটা বিশেষ ধরনের সিনেমা ব্যানার চিত্রের প্রচলন হয়! স্বাধীনতার পরে এসব অবাঙ্গালীদের অনেকেই এ দেশে ছেড়ে চলে গেলও তাদের কাছে যারা কাজ শিখেছিল, সেই ধারা এখনও অনেকটাই ধরে রেখেছে!
এটা সৈয়দপুর ধরায় আকাঁ ব্যানার!
২। ঢাকা: আর ঢাকায় সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং প্রভাব পড়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীদের! এখানে একটা কথা না বললেই নয়, চিত্রকলার অনেক শিক্ষার্থীরাও এক সময়ে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং এর কাজে জড়িত ছিলেন, তার মধ্যে এ. জেড. পাশা, সুশীল ব্যানার্জী, সুভাষ চক্রবর্তী, যতীন্দ্ কুমার সেন প্রমূখ অন্যতম! এছাড়া পরবর্তীকালে নিতুন কুন্ড, আজিজুর রহমানের মতো প্রথিতযশা ব্যাক্তিরাও সিনেমরা পেইন্টিং জড়িত ছিলেন!
ঢাকাই রিতীতে আকাঁ ব্যানার, পার্থক্যটা সুস্পষ্ট!
তবে এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিল্পীরা বেশি দিন এই কাজে যুক্ত থাকেননি, যে কারণে তাদের অংকন রীতি বা কৌশল তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সিনেমার ব্যানারে!
ফলে এক সময় এটা ধীরে ধীরে শুধু মাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের একক আয়ত্বে চলে আসে, আর তারা নিজেদের মতো করেই আলাদা অংকন শৈলী তৈরি করে নিয়েছে। তাদের আকাঁ ছবি গুলোতে গাঢ রঙের ব্যাবহার, কম্পজিশন, লেটারিং খুব আবছায়া ভাবে চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিক ছায়া খুব আবাছা ভাবে বোঝা যায়!
তবে প্রতিষ্ঠানিক ছোয়া থাক কিংবা না থাকা, সিনেমার এই সকল ব্যানার পেইন্টিং নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য ও চরিত্র, বিশাল বিশাল ক্যানভাস, খুব উজ্জ্বল গোলাপী, হলুদ, নীল, লাল রঙের ব্যবহার, মানব দেহের অতিমাত্রিক উপস্থাপন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে!
রঙ এবং তুলি
ব্যানার পেইন্টিং আঁকার ধরনটাও সরারচর পেইন্টিং থেকে একদমই আলাদা! সেই ষাটের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত বেশিরা ভাগ সময়েই এখানে ক্যানভাস হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে মার্কিন, টেট্রন জাতীয় কাপড়! এক সময়ে পাটের চটও এই কাজে লাগানো হতো!
ছবি আকাঁ সময়ে ক্যানভাসের উপরে এপিকেন, বাইন্ড, জিংক অক্সাইড ও পানির মিশ্রনের সাহায্যে বেইজ তৈরি করে কয়েক পরত আস্তরন দিয়ে তার উপর গ্রাফ করা হয়! এরপর গ্রাফের উপর প্রথমে পেন্সিল ড্রয়িং করে নিয়ে তারপরে রং করা হয়!
ছবি আকাঁ চলছে দেখে দেখে
রং করার কাজে প্রচলিত তেল বা জল রং এর কোনটাই ব্যবহৃত হয়না, এখানে বাজারে পাওয়া সাধারণ গুড়ো রং এর সাথে তিসির তেল মিশিয়ে বিশেষ এক রকমের পেস্ট তৈরি করে সেটা দিয়ে রং করার হয়! সৈয়দপুরের শিল্পীরা এখনও এভাবেই রং বানায়, ঢাকায় অবশ্য ষাটের দশক থেকেই খরচ কমানোর জন্য রং এর কাজে প্রেস ইঙ্ক বা প্রেসের রং ব্যবহার করা হচ্ছে! আর ছবির উজ্জ্বল্য বাড়াতে ফ্লোরোসেন্ট রং ব্যাবহার করা হতো!
ব্যানারের জন্য শিল্পীদের কাছে ছবির পোস্টার দেয়া হয়, তারা সেখান থেকে চরিত্র বেছে নিয়ে নিজেদের মতো করে কম্পোজিশন করেন!
ষাটের দশকে কিছু ব্যানারে স্প্রে' এবং কোলাজের কাজের ব্যাবহারের কথাও জানা যায়! খানা আতা পরিচালিত 'ঝড়ের পাখি'; সিনেমার বিশাল একটা ব্যানার করা হয়েছিল কোলাজের মাধ্যেম!
আধুনিক ডিজিটাল ব্যানার!!
বাংলাদেশে সিনেমা ব্যানার শিল্পের সুসময় ছিল মূলত পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত! আশির দশকের শেষ থেকে এই শিল্পে ধ্বস নামতে শুরু করে সার্বিক ভাবে!
বর্তমানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারনার সুবিধা, ব্যানার পেইন্টিং এ ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাবহার ইত্যাদি কারণে হাতে আকাঁ ব্যানার শিল্প একদমই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে! এছাড়া এই কাজে যারা জড়িত এদের পারিশ্রমিকও খুবই নগন্য! সেই পঞ্চাশের দশকে ব্যানার তৈরির মজুরি ছিল প্রতি বর্গফুটে এক টাকা, এখন এই ২০১২ সালে সেটা ৮-১০ টাকায় বেড়েছে, সুতরাং শিল্পীরা আর এই কাজে থাকতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে!
তারপরও শত দারিদ্র, কাজের অপ্রতুলতা ইত্যাদিকে সাথে নিয়েও যে সব পর্দার আড়ালে থাকা স্বশিক্ষিত নিম্নবর্গের প্রান্তিক শিল্পীরা বিশাল বিশাল ক্যানভাসে নিজের দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের হয়তো মূলধারা 'শিল্পী'গন নিজের এক কাতারে দাড় করাতে চাইবেন না! তবে এদের শিল্পভাবনা, রঙের বিন্যাস ইত্যাদির চমৎকার উদাহরন হিসাবে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং বাংলাদেশের চিত্রকলায় অন্যতম একটা 'পাবলিক আর্ট' হিসেবা স্থান পেয়েছে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়!
তথ্য নেয়া হয়েছে: লালা রুখ সেলিম সম্পাদিত 'চারু ও কারু কলা' (৮), বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি!
এবং নেট