শিরোনামটা কিছুটা জলিল মার্কা হয়ে গেলো, কি আর করা!
যাক সে কথা, বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের নৌকোর গ্যালরীটা কি আপনারা খেয়াল করেছেন? বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব নৌকোর রেপ্লিকা আছে সেখানে, সাথে প্রমাণ সাইজের একটা বাইচের নৌকা যার আকার রুমের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত!
এই নৌকোটা মিউজিয়াম ডিসপ্লেতে রাখা হয়েছিল অনেক কেরামতি করে! মিউজিয়ামের সাবেক পরিচালক ড: এনামূল হক স্যারের কাছে শুনেছিলাম, মিউজিয়াম ভবন যখন বানানো হয়েছিল ঠিক সেই সময়ে ঐ ফ্লোরের কাজ চলার সময়ে ক্রেন দিয়ে নৌকাটা সেই রুমে রেখে এর পরে উপরের ফ্লোর গুলো বানানো হয়েছে!
নৌকা বললে আমাদের চোখে ভাসে সাধারণ পালতোলা বা ছইওয়ালা ছোটখাট গড়নের একটা ফিগার, কিন্তু বাংলাদেশে এক সময়ে যে কত হরকে রকমের নৌকা ছিল, সেটা বোঝা যায় এই গ্যালারীটা দেখলে!
নদী মাতৃক বাংলার যাতায়তে অন্যতম বাহন এক সময়ে ছিল বিভিন্ন রকমের এই সব জলযান গুলো! নদীগামী নৌকা এবং সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মান শিল্পে বাঙ্গালীরা যে দক্ষ ছিলেন সে সব কথা প্রাচীন বাংলার লিপিমালা এবং সংস্কৃত সাহিত্যে বিভিন্ন ভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
নৌকার অন্য প্রতিশব্দ গুলো ভেলা, ডিঙ্গি-ডিঙ্গা-ডোঙ্গা হলো আদি অস্ট্রিক ভাষার দান এবং এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় আদিমতম কাল থেকেই বাংলার সাথে এদের ঘনিষ্ট একটা সম্পর্ক ছিল।
আপনারা নিশ্চয়ই প্রাচীন বাংলার অন্যতম কেন্দ্র চন্দ্রকেতুগড়ের কথা জানেন! এই চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া বেশ কিছু পোড়ামাটির সীলে পাওয়া লেখ'তেও নৌকার উল্লেখ আছে, দু'টো নৌকার নামও পাওয়া গেছে একটা হলো এপ্য বা এপ্পগ অন্যটা জলধিসক্ল (জলধিশত্রু)......জলধিশত্রুটা ছিল সম্ভবত যুদ্ধ জাহাজ!
খ্রী: প্রথম শতকের পেরিপ্লাসের বিবরনীতেও এপ্পগ নামের জলযানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়!
মনসা মঙ্গল ও চন্ডী মঙ্গলেও বাংলা অঞ্চলে নদীপথ ও সমুদ্রপথে চলাচলে উপযোগী দাড় টানা পন্যবাহি জলযান নৌকা' বা ডিঙ্গার কথা একাধিক বার খুঁজে পাই আমরা!
কবি মুকুন্দ রায় আর চন্ডিমঙ্গলে 'জঙ্গ' নামের এক ধরনের বানিজ্যিক জাহাজের কথা লিখেছিলেন! এখনও বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জামালপুর এলাকা 'ঝঙ্গ' নামের এক ধরনের নৌকো দেখা যায়, যা সম্ভবত সেই প্রাচীন 'জঙ্গের'ই উত্তরসুরি!
জলবহুল বাংলায় নৌকার ব্যাপক প্রচলন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক!
আর তাই পনের শতকের শেষের দিকের কবি বিপ্রদাস পিপলয়, মুকুন্দরায়ের বর্ণনায় বর্ণাঢ্য নাম আর বিবরনের সব নৌকো উঠে এসেছে মাঝে মাঝে! কি দারুন সব নাম ছিল তাদের; নরেশ্বর, সর্বজয়া, সুমঙ্গল, নবরত্ন, চিত্ররেখা, শশিমঙ্গল, মধুকর, দূর্গাবর, গুয়ারেখি, শঙ্খচূর আরও অনেক অনেক!
সে সময়ে নৌকো বাননো হত কাঁঠাল, পিয়াল, তাল, শাল, গাম্ভরি, তমাল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে!
আগেই বলেছি, প্রাচীন বাংলা জাহাজ নির্মান শিল্পেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। মাহুয়ান এদেশের সমুদ্রপোতে জাহাজ তৈরি হতে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন, সম্ভবত বর্তমান চট্টগ্রাম ছিল তার কেন্দ্রস্থল।
ফেডারিক বলেছেন আলেকজান্দ্রিয়ার নির্মিত জাহাজের তুলনায় তৎকালীন বিশ্ববাজারে সপ্তগ্রামের জাহাজের কদর ছিল বেশি!
পরবর্তী কালে মুসলমান শাসকদের আগমনের পরে বাংলার নৌ-শিল্পের আরও বিকাশ হয়েছিল! কারণ এরা দেখেছিলেন কিভাবে বাংলার স্থানীয় শাসকগন এই ণদী শক্তিকে কাজে লাহিয়ে এই অঞ্চলে দীর্র্ঘদিন স্বাধীন ভাবে শাসন করেছে!
সুতরাং বাংলার উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য মুলত: মুঘল আমলে বিশাল শক্তিশালী এক নৌবাহিনী গড়ে তোলা হয়! 'নাওয়ারা' নামে পরিচিত এই নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল ঢাকায়!
কালক্রমে স্থলপথের উন্নতি, জলপথ গুলোর নব্যতা হারানো, বানিজ্য ক্ষেত্র ও কেন্দ্রের পরিবর্তন ইত্যাদি কারণ এক সময়ের নৌ-শিল্পের এই অতীত গৌরবের কোন কিছুই আজ আর তেমন অবশিষ্ট নেই।
তবু নদীর দেশ হবার কারণেই হয়তো এখনও দেশের আনাচে কানাচে সেই বৈচিত্রময় জলযান গুলোর লুপ্তপ্রায় কিছু চিন্থ টিকে আছে কোন রকমে।
চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক তাদের........
১।মলার:
এই নৌকাটির নাম মলার! পাবনা অঞ্চলে এক সময়ে নির্মিত হতো মলার নৌকা, এটা মূলত: মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো!
১২ থেকে ৫৬ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম মলার নৌকায় পাল থাকে দুটি, দাড় ৬ টা!
তবে গত দু'বছর ধরে এই ধরনের নৌকা আর নতুন করে বানানো হয়নি, ধারনা করা হচ্ছে এটা এখন বিলুপ্তির পথে!
২! জোড় নৌকা:
জোড়া নৌকা রাজশাহী অঞ্চলে তৈরি হয় এবং এগুলো এখনও ব্যবহার করা হয়! এক সময়ে যখন দেশে ফেরীর প্রচলন ছিল না, তখন এই জোড়া নৌকাই ফেরীর কাজ করতো!
৩। হরোংগা:
এটা হরোংগ নৌকা, বানানো হতো সিরাজগঞ্জে! তবে ১৯৯৫ এর পরে আর নতুন কোন হরোংগা নির্মিত হয়নি বলে ধারনা করা হচ্ছে এটাও বাতিলের খাতায় চলে গেছে!
৪০ থেকে ৩০ টন ওজনের ভর বহনে সক্ষম হরোংগা মালবাহী নৌকো, এটাতেও পাল দুটি এবং দাঁড় ৪টা!
৪।বাইচের নৌকা :
এটা মোটামুটি সবার কাছে পরিচিত মনে হবে আশাকরি! পাবনা অঞ্চলে বানানো বাইচের নৌকা গুলোই প্রতি বর্ষার নৌকাবাইচ অনুষ্ঠানে আমরা দেখি! এক সাথে ৫০-৮৫ জন মানুষ চড়তে পারে লম্বাটে এই নৌকায়!
৫।বজরা:
বর্তমানে একটু টাকা-পয়সাওয়ালা লোকেদের আনুষাঙ্গিক যেমন প্রাইভেট কার, তেমনি এক কালে বাংলার জমিদার এবং বড়লোকেদের ছিল 'বজরা'!
বজরা বানানো হতো পাবনা আর সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে! দুই পালের মাঝারি আকারের বজরায় সর্বমোট ১০ জন লোক চড়তে পারে!
তবে ১৯৭১ এর পর থেকে বজরা মোটামুটি বিলুপ্ত!
৬।ফেটি:
মাছ ধরার ছোটখাট নৌকা ফেটি তৈরি হতো গাইবান্দ্ধায়! ১৫০ থেকে ২৫০ কেজি ওজন ধারনে সক্ষম ফেটিতে কোন পাল থাকে না, মাঝি দু'জন!
গত ৪/৫ বছর ধরে ফেটি আর দেখা যায় না!
৭।ডিংগী:
আমি আগে ভাবতাম ডিংগী হয়তো ছোট পিচকা নৌকা, আসলে কিন্তু তা নয়! সাড়ে ৫ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা এই নৌকার ১০/১২ জন লোক চড়তে পারে! সাভারে তৈরি ডিংগী নৌকা এখনও ব্যাবহার করা হয় যাত্রী পরিবহনের কাজে।
৮। বালার:
বালার আর বজরা দেখতে অনেকটা এক রকম তবে মালবাহী বালারের আকৃতি বেশ বড়! ১৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা বালার নৌকা ১২ থেকে ৫৬ টন পর্যন্ত মাল বহন করতে পারে!
কুষ্টিয়ার বলার নৌকা গত দু'বছর ধরে প্রায় নিশ্চিন্থ!
৯। গয়না:
রাজশাহীতে তৈরি হওয়া গয়না নৌকা যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা হতো। সর্বোচ্চ ১৯ মিটার পর্যন্ত লম্বা গয়না নৌকা এক সাথে ৪০/৫০ জন যাত্রী ধারন করতে পারতো।
১৯৯৫ এর পর থেকে এই নৌকা বিলুপ্ত!
১০। পদি/বাতনাই:
পদি বা বাতনাই তৈরি হতো খুলনায়! প্রায় ২২ মিটার অবাধি লম্বা এক পালের পদি নৌকাটি ছিল মালবাহী বানিজ্যিক নৌকা, ভার বহন করতে পারতো ১৪০ থেকে ১৬০ টন পর্যন্ত!
এটাও ১৯৯৫ এর পর থেকে আর দেখা যায় না!
১১।পটোল:
ফরিদপুরের বানিজ্যিক নৌকা পটোল! এই নৌকা গত দুই এক বছর ধরে নিশ্চিন্থ!
১২।বাছারি:
বাছারি নামের নৌকাটিও বানিজ্যিক নৌকা ছিল, তৈরি হতো রাজশাহীতে!
৪০ টন ওজনের ভার বহনে সক্ষম বাছারি গত ২/৩ বছর ধরে বিলুপ্তির পাতায় চলে গেছে।
১৩। দৌড়ের নৌকা:
নামেই বোঝা যাচ্ছে এই নৌকা কি কাজে ব্যবহার হতো!
যা ভাবছেন ঠিক তাই, কিশোরগঞ্জের দৌড়ের নৌকা আসলে হলো রেসিং বোট! এক একটা নৌকায় বসতে পারতো ৫০ জন করে মানুষ!
১৯৯৫ এর পর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি একে!
১৪। ঘাসি:
চমৎকার এই নৌকার নাম ঘাসি! চাঁদপুরের ঘাসি ছিল মালবাহি নৌকা, এটাও বিলুপ্ত!
১৫। গসতি:
বাংলার গল্প উপন্যাসে বহুল ব্যাবহৃত নৌকা গসতি! এটা তৈরি হতো সিলেটে। যাত্রিবাহী গসতি নৌকায় লোকধারন ক্ষমতা ছিল ১০/১২ জন!
যথারিতী এটাও এখন আর দেখা যায় না!
১৬।গোঘী:
বানিজ্যিক নৌকা গোঘীও সিলেটের! নৌকার সামনের দিকের গঠনটা দৃষ্টি আকর্যনীয় ছিল!
গোঘী নৌকার সর্বশেষটি দেখে গেছে ১৯৮৫!
১৭। ময়ূরপঙ্খি:
নৌকার মধ্যে এটা খুব প্রচলিত একটা নাম! রূপকথায় কত গল্পেই না আছে সওদাগরেরা ময়ুরপঙ্খী সাজিয়ে বানিজ্যে যাচ্ছে!
আসলে ময়ূরপঙ্খি কিন্তু বানিজ্যিক নৌকা না, এটা ছিল জমিদার আর ধনিক শ্রেণীর হাউজ বোট!
এই নৌকায় করে তারা প্রমোদ ভ্রমন করতেন!
ময়মনসিংহে তৈরি হতো ময়ূরপঙ্খি, ১৯৫০ থেকে একেবারেই বিলুপ্ত!
১৮। পিনাশ:
ময়মনসিংহের আরেকটি নৌকা পিনাশ! এই ধরনের নৌকায় করে সেই সময়ের ট্যাক্স কালেক্টরগন কর আদায়ে বের হতেন! এক সাথে ৫/৭ জন লোক উঠতে পারে পিনাশে!
১৯৭৫ থেকে পিনাশ আর দেখা যায় না!
১৯। কোসা:
ছোট খাট নৌকা কোসা তৈরি হয় নারায়নগঞ্জে! যাত্রীবাহী নৌকা কোসায় পাল একটা এবং এখনই কোসার প্রচলন আছে!
২০। কোসা (বেদের নৌকা):
সাভারে তৈরি এই ধরনের কোসাই বেদে সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি!
২১। পালোয়ারি:
মালবাহী নৌকা পালোয়ারি তৈরি হতো সাভারে! বিলুপ্তির খাতা নাম উঠে গেছে এটারও!
২২! বালাম:
বালাম নৌকা তৈরি হয় কুতুবদিয়ায়! এটা সামুদ্রিক মাছ ধরার নৌকা, ভার বহন করতে পারে ৭/৮ টন। বালাম গত দু'বছর ধরে আর ব্যবহার করা হচ্ছে না!
২৩।সাম্পান:
সাম্পান শুনলেই সাথে সাথে চিটাগং এর নাম মনে চলে আসে আপনাআপনি! এই নৌকা মাল বহন আর যাত্রী পরিবহন, দুই কাজের ব্যবহার করা হয়! এখানে যে ছবিটা দেয়া হয়েছে এটা মালবাহী সাম্পান!
তবে মালবাহী সাম্পান ১৯৮০ এর পর থেকে আর দেখা যায় না!
সব শেষে সেই সব কারুশিল্পীদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের হাজার বছরের নৌকা তৈরির ঐতিহ্যমন্ডিত সম্পদকে লালন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন!
পরিশিষ্ট
ছবি: সব ছবি গুলো রেপ্লিকা! নেয়া হয়েছে "Voiles anciennes du Bangladesh" নামের এক্সিবিশন ক্যাটালগ থেকে!
সময়: নৌকা সংক্রান্ত তথ্য গুলো সন্নিবেশের সময় কাল ২০০৮ এর আগ পর্যন্ত!
অন্যান্য তথ্য: সুফি মুস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য
পোস্টখানি ব্লগের সকল জাহাজী ভাইদের উৎসর্গ করলাম!