বাংলা সিনেমার এখন যে হালচাল তাতে কে বলবে একটা সময়ে কি জ্বলজ্বলে একটা সোনালী দিন ছিল এই রূপালী জগতটার! কি অপরিসীম উৎসাহ নিয়েই না পথ চলা শুরু হয়েছিল ঢাকাই চলচিত্রের!
ঢাকার প্রথম চলচিত্রের নাম ছিল "সুকুমারী' (১৯২৭-২৮)। অনেকটা পরীক্ষা মূলক ভাবে নির্মান করা হয়েছিল সিনেমাটি। ঢাকার নবাব পরিবারের কিছু সদস্য ছিলেন সিনেমাটি উদ্যোক্তা।
নির্বাক এই চলচিত্রটি ঢাকার কোন প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়নি। ঘরোয়া ভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল সুকুমারীর নায়ক-নায়িকা সবাই ছিলেন পুরুষ, মানে নারী চরিত্র গুলোতে সব পুরুষেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করেছিল।
উল্লেখ্য ইতিমধ্য ঢাকায় দুটো প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হয়ে গিয়েছিল!। প্রথম প্রেক্ষাগৃহের নাম ছিল 'পিকাচার হাইজ'! আর্মানিটোলার গির্জার পাশে নবাব ইউসুফ খানের গোরস্তানের জন্য রাখা জমিটি প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ল্যাজারাস নামের এক অর্মেনিয় ব্যাক্তি কিনে এখানে পাটের গুদাম করেছিল। পরবর্তীকালে যুদ্ধ শেষে উদ্ভমী ঠাকুর নামের এক মাড়োয়ারী এটা কিনে নিয়ে সিনামে হলে রূপান্তরিত করেন। ১৯১৯-২০ সালের দিকে এখানে প্রতিদিন দুটো করে আর রবিবারে তিনটা সিনেমা দেখানো হতো! পরে ১৯২৪ সালের দিকে দ্বিতীয় প্রেক্ষাগৃহটি বানানো হয়, নাম ছিল সিনেমা প্যালেস। পরে মুকুল ব্যানার্জি এটা কিনে নিয়ে নাম দিয়েছিলেন "রূপমহল", এখানেই বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচিত্র "মুখ ও মুখোশ' প্রদর্শিত হয়েছিল!
যাই হোক, বলছিলাম নির্বাক চলচিত্রের কথা! 'সুকুমারী' সিনেমাটি নির্মানের সাফল্যের পরে এই উদ্যোক্তার আরও উৎসাহিত হয়ে পরের সিনেমাটি নির্মানে এগিয়ে আসেন! যার নাম ছিল "দ্যা লাস্ট কিস", এটাই ঢাকার প্রথম পূর্নাঙ্গ চলচিত্র।
সিনেমাটির পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে শরীরচর্চার শিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্তু! চিত্রগ্রাহক ছিলেন খাজা জহির!
নায়ক হিসাবে প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলে খাজা নসরুল্লাহ, পরে কাজী জালাল এবং সব শেষ খাজা আজমল! খাজা আজমল সাহেব অবশ্য পরে চিত্র গ্রাহকের কাজটাও করেছিলেন।
দ্যা লাস্ট কিসইপ্রথম সিনেমা যেখানে মেয়েরাই মেয়েদের চরিত্র রুপায়ন করেছিল।
নায়িকা ছিলেন লোলিটা, ডাক নাম 'বুড়ি'! বুড়ি বাদামতলীর পতিতালয়ে থাকতেন! ১৪ বছর বয়সে তাকে নায়িকা করা হয় এবং চলচ্চিত্রে নাম বদল করে রাখা য় লোলিটা! সিনেমার কাজ শেষ হবার পরে ললিটাকে আবার তার পুরানো পেশায় ফিরে যেতে হয় এবং এই ছবিটি ছাড়া তিনি আর অন্য কোন সিনেমায় অভিনয় করেনি! সিনেমার বাকি অভিনেত্রীরা ছিলেন চারুবালা, বেদবালা, হরিমতি। এরাও একই ভাবে পতিতালয় আর বাঈজি পাড়া থেকেই এসছিলেন।
দ্যা লাস্ট কিসে'র দারুন হ্যান্ডসাম হিরো খাজা আজমল
১৯২৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে শুটিং শুরু হয় দ্যা লাস্ট কিসের; দিলকুশা, মতিঝিল, শাহবাগ আর নীলক্ষেতে চলে শুটিং! ছবির প্রক্রিয়া করা হয়েছিল কোলকাতায়, সম্পাদানয় ছিলেন আম্বুজ গুপ্ত আর খাজা আজমল নিজেই। ইংরেজি, বাংলা আর উর্দু সাবটাইটেলের ১২ রিলের এই সিনেমাটি নির্মানে খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা।
নায়িকা লোলিটা! কি দারুন সুন্দরী ছিলেন, তাই না?
সিনামরটির সার সংক্ষেপ অনেকটা এমন ছিল " খাজা আজমল ও খাজা আদেলের দুই পরিবারের মধ্যে সংঘাত! খাজা আদেলের স্ত্রী হয়েছিলেন চারুবালা, শিশুপুত্র খাজা শাহেদ (৩ বছর ছিল তার তখন), অন্যদিকে খাজা আজমলের স্ত্রী লোলিটা ও মেয়ে টুনটুন। দুই পরিবারের দুই শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক নির্মল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, কিন্তু নানা ঘটনার আবর্তে দুই পরিবারের মধ্যে বিচ্ছেদ নেমে আসে। এক রাতে নায়ক খাজা আজমল তার স্ত্রী লোলিটাকে নিয়ে যাত্রা দেখতে যাবার পথে জমিদার খারা নসরুল্লাহর গুন্ডা বাহিনী নায়িকাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। বহু খোজাখুজির পরে তাকে জমিদারের ঘরে পাওয়া যায়। সেখানে উভয় পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং শেষ পর্যন্ত নায়ক নায়িকা মারা যায়। এই বিচ্ছেদ মুহূর্তে আবার সিনেমার দুই শিশুশিল্পী পরস্পরকে চুম্বন করে! ছবিটির নাম রাখা হয় তাই "দ্যা লাস্ট কিস"!
দ্যা লাস্ট কিস' এর ১৯৩১ সালের শেষ দিকে সিনেমাটি রিলিজ হয়েছিল। তৎকালিন মুকুল হলে (বর্তমান আজাদ) ছবির উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশ চন্দ্র মজুমদার!
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলা সিনেমার শেকড়ের এই ছবিটির কোন প্রিন্টের খোঁজ আর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি!
আশাকরি ঢাকাই চলচিত্রের এমন সুদিন আবার ফেরত আসবে কোন একদিন............
যে সব বই থেকে টুকলিফাই করলাম:
অনুপম হায়াৎ "পুরানো ঢাকার চলচিত্র"
মুনতাসির মামুন "স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা"