ইতিহাসের পাতায় টাংগাঈলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর রাজবাড়ির নাম উল্লেখযোগ্য। হেমনগরের রাজা ছিলেন রাজা হেমচন্দ্র চৌধুরী। বিখ্যাত আম্বাবীয়ার জমিদার বংশের কালীচন্দ্র চৌধুরীর পুত্র হেমচন্দ্র চৌধুরী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮৩৩ সালে, তার নামেই এলাকাটির নাম হয়েছে হেমনগর। হেমনগরের পাশাপাশি তিনি পুখুরিয়া পরগণার একআনি অংশেরও জমিদার ছিলেন।
হেমনগরের এই রাজবাড়িটির পোষাকি নাম ছিল 'এঞ্জেল হাউজ'। ১৮৯০ সালে নির্মিত এই এঞ্জেল হাউজ এর ভেতরে মোট তিনটি আলাদা বিল্ডিং আছে। এই উপনিবেশিক স্থাপনাটির সবচেয়ে আকর্যনীয় দিক হলো, এর চিনি টিকরী অলংকরণ। বাংলাদেশের উপনিবেশিক যুগের প্রত্নত্বাত্বিক স্থাপনার মধ্যে আবাসিক কাজে ব্যবহৃত যত বিল্ডিং আছে, আমার দৃষ্টিতে চিনি টিকরীর অলংকরণের দিকে থেকে এই এঞ্জেল হাউসটি সব চাইতে সেরা। বর্তমানে একে হেমনগর কলেজ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সামনের অংশটাতে রয়েছে ইসলামিক আর্চ আর গ্রিক কোরানথিয়ান পিলালের চমৎকার ফিউশন।
স্থাপত্য কমপ্লেক্সের একেবারে প্রথম বিল্ডিংটা দ্বোতালা, এর পরের গুলো সব এক তলা। নীচ তলাটা এখন হেমনগর কলেজের প্রশাসনিক ভবন হিসাবে ব্যবহার করা হয়, দ্বোতালায় কলেজের অধ্যক্ষ সাহেব থাকেন। যেকারণ এক কালের এই পশ এঞ্জেল হাউসের দ্বোতালায় এখন আমরা লুংগি ঝুলতে দেখছি।
তবে কলেজ প্রশাসন বেশ স্বজ্জন, দ্বোতালায় উঠে দেখতে চাইলে তারা তালা খুলে দেখার ব্যবস্থা করে দেয়।
চিনি টিকরীর মুল ঝলকানী এই প্রথম অংশটাতেই দেখা যায়।
প্রতিটা আর্চের উপরই এমন অলংকরণ আছে।
পিলারের উপরের অংশ।
অনেকক্ষণ ধরেই চিনি টিকরী, চিনি টিকরী করে যাচ্ছি, এই ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করা দরকার। এটা হলো এক ধরণের বিল্ডিং ডেকোরেশন পদ্ধতি, অনেকটা মোজাইকের মতো। এই পদ্ধতিতে স্থাপত্যের গায়ে চিনামাটির বাসন কোসনের ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।
এঞ্জেল হাউজে চিনি টিকরী অলংকরেণর কাজে প্রধাণত রঙিন কাঁচরের টুকরো বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।
সামনের দিকের পিলার থেকে শুরু করে, দেয়াল, দরজা জানালার প্যানেল, প্রতিটা জায়গার এই অলংকরণ ছিল। নকশার গুলো মুলত: ফ্লোরাল আর জ্যামিতিক।
কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় হলো, অনেক জায়গাতে সংস্কার বা অন্য কোন কাজে এই অপূর্ব অলংকরণ গুলো ঘষে উঠিয়ে ফেলে প্লাস্টার করে ফেলা হয়েছে।
এই অংশের উপরে বিল্ডিং এর চুড়োয় আছে একটা পরীর মূর্তি, যার কারণে একে এঞ্জেল হাউজ নাম দেয়া হয়েছে। এটাতেও রয়েছে চিনি টিকরীর কাজ।
সবাই অবশ্য বলে পরী, তবে আমি অনকে কষ্ট করেও পরীর কোন আদল ঐ অংশে আবিষ্কার করতে পারিনি।
এই অংশ পার হলে অন্দর মহল। অন্দর মহলের দুটো অংশ, দুটোই এক তলা।
এখানেও হালকা অলংকরণ আছে, তবে সেটা স্টাকো ডেকোরেশন (বালু, সিমেন্ট মিশিয়ে করা ভারী ও পুরু অলংকরণ)।
এই অংশটা তুলনামূলক ভাবে ছোট।
এটা অন্দরমহলের দ্বিতীয় অংশ। চমৎকার পিলারড বারান্দা আর স্টাকো ডেকোরেশনের দেখা মিলবে এখানে।
পিলারের উপর আর সারা বিল্ডিংর প্যানেলে এমন ফ্লোরাল মোটিভে স্টাকো ডেকোরেশন চোখে পড়বে।
ভেতরের এই অংশ দুটো একেবারেই পরিত্যাক্ত, তবে স্থাপত্যিক দিকে থেকে এখনও বেশ ভাল আছে। এক কালের প্রতাপশালী জমিদারদের ঘরগুলো এখন ইদুঁর বাদুরের আস্তানা।
খা খা করা টানা বারান্দা, চকমেলানো উঠোন, আর ফাঁকা ফাঁকা ঘর গুলো দেখলে কে বলবে, এককালে এখানে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল! মনে হয় সেই আদ্যি কাল থেকেই এরা একা, নিসঙ্গ, আরও অনেক কাল এমনই রইবে।
এঞ্জেল হাউসের আশেপাশে আরো ৭টি সুরম্য ভবন আছে যেগুলো জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোন ও চার ছেলেমেয়ে বাড়ি। আর এই এঞ্জেল হাউজের ভেতরে রয়েছে বিশাল বড় একটা শানবাধানো পুকুর আর দশটি কুয়ো আছে।
জমিদারী পুকুরে সূর্যাস্ত...........
ওহ, আরেকটা ব্যপারতো বলা হয়নি, অন্দরমহলের দ্বিতীয় অংশে উঠোনে নামার সামনের সিড়ির দিকে একটা মজার বিষয় খেলায় করলাম, লম্বা সিড়িতে কিছু দূর পরপর এমন গোলাকার গর্তের মতো। কি ছিল এগুলোতে?
গাছের টব না কি অন্য কিছু?
অবশ্য এই জমিদার বেশ শৈখিন আর শিল্পমনস্ক ছিলেন। কবি ও গীতিকার হিসেবে হেমবাবুর সেই সময়ে বেশ সুনাম ছিলো, তাঁর কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিলো। এছাড়া পারিবারিকমন্ডলে 'হেমনগর হিতৈষী' নামে পত্রিকা বের করেছিলনে এবং তার বাড়িতে একটা নাট্যশালাও ছিলো।
অবশ্য হেম বাবুর প্রজাপীড়নেরও অনেক উপাখ্যান শোনা যায়, সেটা একটা আলাদা ইতিহাস!
দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে কিছু টিপস :
** মহাখালি থেকে সরাসরি গোপালপুরের বাস ছাড়ে ওগুলোতে করে যেতে পারেন। আর একটু সময় হাতে নিয়ে গেলে কাছেই রয়েছে অন্যতম প্রাচীন বন্দর নলীন, সেটাও দেখে আসতে পারবেন।
**যেহেতু এটা কলেজ, তাই ছুটির দিন গুলোতে যাওয়াই ভাল। কলেজের কেয়াটেকার থাকেন একজন, ওনাকে বললে দ্বোতালায় যাবার ব্যবস্থা করে দেবে।
** এই এঞ্জেল হাউসের আশে পাশে আর বেশ কয়েকটি সুলতানী আমলের মসজিদ আছে, চোখকান খোলা রাখলে সহজেই নজরে পরবে।
আমি ছবি তুলতে পারিনি, রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই এখানে দিতে পারলাম না।
** আর এঞ্জেল হাউস নামের এই গাল ভরা নামটা বললে স্থানীয়রা চিনবে না, বলতে হবে পরীর দালান অথবা হেমনগর কলেজ
রেজোওয়ানার অনাণ্য প্রসাদিয় পোস্ট
তাজহাট প্যালেস, নয়নাভিরাম এক মিউজিয়াম.......
ছুটির ফাঁকে দিঘাপতিয়ায়.........
শ্বেত পাথরের রাজপ্রাসাদে একদিন......
দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া..............
..........শূন্য গর্ভ হাইকোর্টের মাযার.........
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর ভৌতিক ক্যাসেল, সিউল রায়হানের একটি পোস্টের লেজ
বাংলাদেশের মেগালিথিক সৌধ গুলো কি আসলেই কি সমাধি বা স্মারক সৌধ?
প্রাসাদ রহ্স্য..............
বাংলাদেশের জলদূর্গ.....মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর
মুন্সিগঞ্জ ভাগ্যকুল ঘুরে এসে.......
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি........
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৫০