চে গুয়েভারার বাবা আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ছিলেন আইরিশ বংশদ্ভুত। তার পূর্বপুরুষেরা বাস করতেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে গোল্ড রাশ করা ছিলো তাদের পেশা; কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থ গোল্ড রাশ তাদের পরিবারকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল করে দেয়। কারন তার পূর্বপুরুষ অর্থাৎ গুয়েভারা লিঞ্চের বাবা ফ্রান্সিসকো লিঞ্চ সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বেঁচে এই গোল্ড রাশের পেছনে ব্যায় করেছিলেন। প্লেজার্স অব ক্যালিফোর্নিয়া সম্পর্কে বলা যায় ক্যালিফোর্নিয়ার এই বিশাল গোল্ড ফিল্ড আবিষ্কার হয়েছিলো। এই জায়গাটি যুক্তরাষ্ট্র দখল করার আগে জায়গাটি ছিলো মেক্সিকানদের। যুক্তরাষ্ট্র এক নিষ্ঠুর এবং অন্যায় যুদ্ধ করে এই অঞ্চল দখল করে নেয়। এই জায়গাটি সারা বিশ্বের অনেক প্রান্তের মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো। লোকজন ওখানে যেতে থাকে ভাগ্যের সন্ধানে। যারা যেতো তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা ছিলো এখানে এসে তারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবে। ইতিহাসে এর নাম দেওয়া হয়েছিলো Gold Rush। এখানে এসে মূলত হতে গোনা কয়েকজন বাদে আর কেউই খুব একটা লাভবান হতে পারেনি।
আর্নেস্তো লিঞ্চের স্ত্রী সেলিয়া ডি লা সেরেনা (১৯০৭-১৯৬৪) তার পরিবারের সঙ্গে বুয়েন্স আয়ার্সে থাকতো। ইচাগুয়ে পরিবারের সঙ্গে ওদের প্রত্যেকেরই ভালো সম্পর্ক ছিলো। আর ইচাগুয়ে ছিলেন মি. লিঞ্চের ভাইয়ের মতো। এই ইচাগুয়ের মাধ্যমেই মি. লিঞ্চের সাথে সেরেনা সেলিয়ার দেখা।
না প্রথম দেখাতে তাদের প্রেম হয়নি। দুজনের মুক্ত মন মানসিকতা তাদের দুজনকে বেশ ভালো বন্ধু হতে সহায়তা করে। সেই সাথে সেলিয়ার পরিবারে সাথে লিঞ্চেরও বেশ খাতির হয়ে যায়। এছাড়া ইচাগুয়েদের বাড়িতে তারা নিয়মিত দেখা করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে তারা একে অন্যের প্রেমে পরে যান।
সেলিয়ার পরিবারের বাবা-মা দুজনই ছিলো মৃত। তার ভাইবোনদের সঙ্গে জুনিন স্ট্রীটের একটি বিশাল বাড়িতে তারা থাকতো, ওরা ছিলো চার ভাই আর তিন বোন, কারমেন ছিলো ভাইবোনদের ভেতরে সবচেয়ে বড় এবং সাংসারিক সব দ্বায়িত্ব এই বড় বোনটির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। যেহেতু আর্জেন্টিনার এক ধনী পরিবার ছিলো সেলিয়া-কারমেনদের পরিবার সেহেতু আর্জেন্টিনার মত তখনকার অনুন্নত অঞ্চলে তাদের টিকে থাকতে আসুবিধা হয়নি। কারমেন অবশ্য পরবর্তি কালে কবি সায়েতানো কার্ডোভা ইতুরবুরুকে বিয়ে করেছিলো। ইতুরবুরু ছিলেন একজন আর্জেন্টাইন কমিউনিস্ট কবি, প্রায় বছরখানেক স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সাংবাদিক ছিলেন। বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, এবং লেখকদের এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট (১৯৬৫-১৯৬৭) ছিলেন। তার কবিতা ও গদ্যের জন্য তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ্কার পেয়েছিলেন।
সেলিয়া তার পরিবারে সবচেয়ে ছোট ছিলো এবং তার বাবার কোন কথা তার মনে ছিলো না; তার যখন কয়েক মাস বয়স তখন তার বাবা মারা যায়, সেলিয়ার মা ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে তাই তার ছেলেমেয়েদেরও তিনি রোমান ক্যাথলিক স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। সেলিয়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পায় সেক্রিড হার্ট স্কুলে, সে সময় ছিলো একজন ধর্ম বিশ্বাসী, লিঞ্চের সাথে বিয়ের পর তিনি নাস্তিক হয়ে যান। এবং সে সময় সে এতটাই ধর্ম বিশ্বাসী ছিলো যে সে তার জুতার মধ্যে কাচের টুকরো রেখে দিতো যেনো তার পায়ের মাংসে খোচা লেগে যন্ত্রণা করে, সে কখনই লাস্ট সাপারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা ভুলে যেতো না। চার্চের নানরা চাইতো সেলিয়া যেন চার্চে স্থায়ী ভাবে থেকে যায়; এর কারণটা হচ্ছে সেলিয়া সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। এতে চার্চের অর্থনৈতিক নিরপত্তা বাড়তো।
সেলিয়া ও লিঞ্চের সম্পর্ক যতক্ষণ পর্যন্ত বন্ধুত্বের পর্যায়ে ছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক নিয়ে কোরো কোন সমস্যা ছিলো না। যখন তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের সীমা পার ছাড়িয়ে যায় তখনই তার ভায়েরা আর্নেস্তো লিঞ্চ ও সেলিয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানালো।
ধর্মের ধজ্বাধারী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই তাদের বিয়ে ঠেকাতে চেয়েছিলো। সেলিয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হয় তার এক খালার বাড়িতে, কিন্তু তারা যখন সিন্ধান্ত নিলেন তারা দুজন বিয়ে করবেন তখন চিরাচারিত নিয়ম অনুযায়ী সব কিছু তার ভালোবাসা থেকে পিছনে পড়ে রইলো।
১৯২৭ সালে তারা বিয়ে করে ফেলেন। লিঞ্চ তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু টাকা পেয়েছিলেন, সে টাকা দিয়ে তিনি নিসিওনেস অঞ্চলে পুর্তো ক্যারাগুয়াতায় ২০০ হেক্টর জমি কিনেছিলেন। সেলিয়া আর লিঞ্চ দুজনেই ওই স্টেটে গিয়ে উঠলেন।
শৈশব থেকেই লিঞ্চ ছিলেন সোসালিস্ট, কিন্তু তিনি সেলিয়ার উপরে কোন তার সোসালিস্ট চিন্তাচেতনার কোন জোর খাটান নাই। তিনি চেয়েছিলেন সেলিয়া যেন তার পরিবারের রীতিনীতি ভালো ভাবে মেনে চলেন। কিন্তু সেলিয়া খুব শিঘ্রই স্বামিকে ছাড়িয়ে গেলেন। এবং তাদেরকে এজন্য ‘কমিউনিস্টের লাল শয়তান’ বলে একটা গালি শুনতে হতো। এতে দুজনেই ক্ষেপে যেতেন এবং দুজন মিলেই এর গালির মুখোমুখি হতেন। এবং সবসময়ই সেলিয়াকে ক্যাথলিক চার্চের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে দুরাচার সোশ্যালিস্ট বানানোর জন্য লিঞ্চকে দোষারোপ করা হতো। সে সময় লাতিন আমেরিকায় অন্যান্য দেশগুলোর মতো আর্জেন্টিনাতেও ক্যাথলিক চার্চ পুঁজিবাদের হাত ধরে চলতো এবং তাদের সমর্থন দিয়ে যেতো সরকারী মিলিশিয়া বাহীনি।
আর্জেন্টাইন রিপাবলিকের ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদিরা, ব্রিটিশ এবং আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া গোঁড়ামি থেকে যারা দূরে সরে যেত তাদের সহ্য করতে পারতো না। এবং লিঞ্চ এই দলে প্রথম থেকেই চিহ্নিত হয়েছিলেন। সেলিয়া চিহ্নিত হয়েছিলেন আরো অনেক পরে।
সেলিয়া ছিলো বেশ চটপটে ধরনের এবং সারা জীবনই তিনি দারুন সাহস দেখিয়ে গেছেন। আর মায়ের এই গুনটিই ‘ছোট্ট কালো ভেড়াটি’ পেয়েছিলো যে পরবর্তিতে সারা দুনিয়ার কাছে চে গুয়েভারা বলে পরিচিতি লাভ করে।
এটা ছিলো তাদের জীবনের এক্কেবারে শুরুর দিকের কথা। কিন্তু আর্নেস্তো যখন সারা বিশের সংবাদপত্র গুলোতে শিরোনাম হতে লাগলো, আমেরিকা যখন তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দেয় তখন পুঁজিপতিদের আয়ত্তে থাকা সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, রেডিও এবং টেলিভিশনে তারা তাদের সম্পর্কে নানান মিথ্যে গুজব ছড়াতে থাকে। কোনো কোনো পত্রিকা এমন মন্তব্য করলো যে, লিঞ্চ এভাবে বলেছেন ‘আমরা সবাই যখন খেতে বসি তখন সবার হাতে একটি করে বন্ধুক থাকে, যেন যেকোন আলোচনার সমাধান গোলাগুলির মাধ্যমে করা যায়।’
[হাসতা সিয়ম্প্রে বিভাগে চে’গুয়েভারার সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় যা সাধারনত চে’র বিদ্রোহী হয়ে ওঠার আগের সময় কেমন ছিলেন। এটি এই বিভাগের দ্বিতীয় লেখা।]
তথ্য সূত্রঃ Mi hijo el Che
Young Che: Memories of Che Guevara by his Father