বোয়িংয়ের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির জেট- বোয়িং 787 ড্রিমলাইনার অবশেষে বিমান বাংলাদেশে এয়ালাইন্সের জন্য ঢাকা এসে পৌঁছেছে। গত ৫ই সেপ্টেম্বর "অাকাশবীণা" নামের উড়োজাহাজটি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন।
যখন আপনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন এই উড়োজাহাজে উঠবেন, তখন আপনি উপভোগ করতে পারবেন এক আরামদায়ক ও স্বস্তির আকাশযাত্রা। তখন আপনি বুঝতে পারবেন কেন উড়োজাহাজটির নাম রাখা হয়েছে 'ড্রীমলাইনার'।
জেট ল্যাগ, ওভারহেড লকারে স্থান নিয়ে যুদ্ধ, ভ্রমণে অস্বস্তি ও ত্বক শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা যখন উড়োজাহাজে ভ্রমনের আনন্দটাকে ম্রীয়মান করে দেয় তখন আপনি যদি ভ্রমণের বাহন হিসাবে ড্রীমলাইনারকে বেছে নেন তখন বাস্তবিকই আপনি এই সমস্যাগুলো থেকে অনেকাংশেই নিস্তার পাবেন।
এখন আমারা জেনে নেই, কেন বোয়িং 787 ড্রিমলাইনার অন্য উড়োজাহাজ থেকে আলাদা?
১। এটি প্লাষ্টিকের তৈরী:
শুনতে কথাটা একটু অস্বাভাবিক মনে হলেও অাসলে কথাটি সত্য। এই উড়োজাহাজের ওজন অনুপাতে ৫০শতাংশ এবং আয়তন অনুপাতে ৮০শতাংশই তৈরী হয়েছে কম্পোজিট উপাদান রি-ইনফোর্সড কার্বন পলিমার দ্বারা তৈরী, যা কিনা প্রচলিত এ্যালুমিনিয়াম ধাতু থেকে হালকা ও টেকসই। । অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে ২০% এ্যালুমিনিয়াম, ১৫% টাইটেনিয়াম, ১০%ষ্টীল ও ৫%অন্যান্য উপাদান । তুলনামূলকভাবে বোয়িং ৭৭৭ -এ ব্যবহৃত হয়েছে ১২% কম্পোজিট উপাদান ও ৫০% এ্যালুমিনিয়াম।
২। অভিনব ফ্লাইট ডেক(ককপিট):
ড্রীমলাইনারের ফ্লাইট ডেকটিকে ছোটখাট একটা স্পেসশীপের ডেক হিসাবেও কল্পনা করা যেতে পারে। কারণ এতে রয়েছে স্বচ্ছ ডুয়েল হেড-আপ-ডিসপ্লে(HUD), প্রশস্ত প্রাইমারী ফ্লাইট ডিসপ্লে ও মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে। একজন পাইলট বাইরের যাত্রা পথের উপর লক্ষ্য রাখার সাথে সাথে দৃষ্টি না সরিয়ে সহজেই হেড-আপ-ডিসপ্লের স্বচ্ছ কাঁচে প্রদর্শিত প্রাথমিক তথ্য সমূহ দেখতে পারবে। আর এর ফ্লাইট ডেক এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন একজন পাইলট খুব সহজেই তার সিট থেকে অল্প আয়াসে ফ্লাইট পরিচালনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।
৩। জ্বালানী স্বাশ্রয়ী:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনার সমান আকৃতির অন্য যে কোন উড়োজাহাজ থেকে ২০% জ্বালানী স্বাশ্রয়ী। কারণ অন্যান্য উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের ব্লিড এয়ার ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন সিস্টেমের শক্তি যোগানে। কিন্তু বোয়িং 787-এ সম্পূর্ণ জ্বালানী ইঞ্জিনের থ্রাস্ট তৈরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। জ্বালানী সাশ্রয়ের কারণে এটি দূর পাল্লায় ৮৫০০ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম।
৪। বিশাল বিদ্যুৎ শক্তি:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনার সম্পূর্ণ উড়োজাহাজের মোট বিদ্যুত শক্তির পরিমান ১.৪৫মেগাওয়াট। এই শক্তি প্রচলিত উড়োজাহাজের শক্তির ৫গুণ। ইঞ্জিন স্টার্ট, প্রেশারাইজেশন, হরিজন্টাল স্ট্যাবিলাইজার ট্রিম এবং চাকার ব্রেক গুলি বিদ্যুত চালিত। অন্যান্য উড়োজাহাজে উক্ত সিস্টেম গুলি চালানোর জন্য নিওমেটিক বা হাইড্রোলিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে।
৫।প্রশস্ত কেবিন ও লাইটিং:
আপনি যখন বোয়িং 787 ড্রীমলাইনারের কেবিনে প্রবেশ করবেন তখন এর লাইটিং ও দৃষ্টি নন্দন পরিবেশের কারণে মনে হবে একটি প্রশস্ত কেবিনে প্রবেশ করেছেন। আপনার কখনই মনে হবে না যে, আপনি একটি টিউবের মধ্যে আছেন। উঁচু সিলিং ও বড় ওভারহেড লকার দেখে আপনি তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এর জানালা গুলোও অন্যান্য উড়োজাহাজের তুলনায় ৩০% বড়। বাইরের পর্যাপ্ত আলো ভিতরের পরিবেশটাকে অনেকটাই স্বাভাবিক রাখবে। এর জানালা গুলি বড় হওয়ার কারনে আাপনি স্বাচ্ছন্দে বাইরের দৃশ্য দেখতে পারবেন এবং আপনার উড়ান ক্লান্তি অনেকাংশে কমে যাবে। কেবিনে লাইটিংয়েও ব্যবহৃত হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। কেবিন-ক্রু এই মুড লাইটিংয়ের সাহায্যে চাইলেই কেবিনে রোদ্রজ্জল দিনের আলো বা শান্ত রাতের আকাশের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করতে পারবেন।
৬। স্বস্তির পরিবেশ:
আপনার স্বচ্ছন্দ ভ্রমন নিশ্চিত করার জন্য এই উড়োজাহাজে কেবিনের চাপ ৬০০০ফুটে রাখা হয়েছে। যেমন ধরুন আপনি ৩৫০০০ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন, আপনার মনে হবে আপনি ৬০০০ফুট উচ্চতায় ভ্রমন করছেন। অন্যান্য উড়োজাহাজে এই চাপ ৮০০০ফুটে রাখা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন মানুষ ৬৫০০ফুট উচচতার বেশি চাপে অস্বস্তি বোধ করে, ত্বক শুকিয়ে যায়, ঝিমুনি আসে ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই উড়োজাহাজের কেবিনে আর্দ্রতাও অন্য উড়োজাহাজের চাইতে দ্বিগুণ বজায় থাকে। সুতরাং ড্রীমলাইনারে আপনার ভ্রমন হবে স্বস্তিদায়ক।
৭। স্বচ্ছন্দ যাত্রা:
বোয়িং 787 ড্রিমলাইনারে ব্যবহৃত হয়েছে Smooth Ride Technology। যখনই কোন বাতাসের ঘূর্নিপাক(Turbulence) এই উড়োজাহাজ টের পাবে তখনই এর সেন্সরগুলি কার্যকর হয়ে যাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডানার নিয়ন্ত্রক অংশগুলো বিন্যাস্ত হয়ে যাবে। ভিতর থেকে একজন যাত্রী কোন ঝাকুনি অনুভব করবেন না। উড়োজাহাজের বিভিন্ন অংশে থাকা সেন্সর গুলি প্রতি নিয়ত কৌনিক বেগ এবং চাপের পরিবর্তন পরিমাপ করতে থাকে। এই পরিবর্তিত তথ্য/ডাটা সফ্টওয়্যার এলগরিদমে রূপান্তরিত হয়ে উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রক কন্ট্রোলারে পাঠানো হয় এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তাও নির্ধারন করা হয়। ৮৮ভাগ যাত্রী এই উড়োজাহাজে গতি জণিত অসুস্থতা থেকে রক্ষা পাবেন।
৮। ডানার বরফ প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
প্রচলিত উড়োজাহাজে ডানায় যাতে বরফ জমতে না পারে তার জন্য ইঞ্জিন থেকে গরম বাতাস ডানার উপর প্রবাহিত করা হয়। বোয়িং 787 ড্রীমলাইনারে ডানার প্রান্ত গুলিতে ইলেক্ট্রো থার্মাল হিটার ব্যবহার করা হয়েছে।
৯। স্মার্ট গ্লাসের জানালা:
ড্রীমলাইনারের কেবিনের জানালায় প্লাস্টিক শাটারের বদলে ব্যবহৃত হয়েছে ইলেক্ট্রোক্রমিসম-ভিত্তিক স্মার্ট গ্লাস। যাত্রাকালীন সময়ে তন্দ্রা এলে আলো ডিম করার জন্য ইলেকট্রনিক ডিমার সুইচে একটি চাপই যথেষ্ট।
১০। নিরব যাত্রা:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনারে কেবিনের ভিতর ও বাহিরে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার সাহায্যে ৬০% শব্দ হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। এর ইঞ্জিন প্রচলিত ইঞ্জিনের চাইতে ৩৫% কম শক্তি ব্যবহার করে, তাই এটি কম শব্দ উৎপন্ন করে এবং শব্দ কমানোর জন্য বিশেষ ডিজাইনের ইঞ্জিন কাউল(কভার) ব্যবহার করা হয়েছে। এই উড়োজাহাজের এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমও প্রায় শব্দহীন। যাত্রা পথে আপনার মনে হতে পারে যে, আসলে ইঞ্জিনগুলি চলছে তো?
১১। পরিবেশ বান্ধব:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনারে ২০% কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানো হয়েছে। এটি কম শব্দ দূষণ করে এবং কম জ্বালানী তেল ব্যবহার করে। এতে ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহার কমানো হয়েছে এবং এর নির্মানকালীন বর্জ্যের পরিমানও কম।
১২। উন্নত ডানা ও সিঙ্গেল ব্যারেল ফিউজলেজ প্রযু্ক্তির ব্যবহার:
এই উড়োজাহাজের ডানা প্রয়োজন অনুসারে পাখির ডানার মত ২৬ফুট পর্যন্ত বাঁকানো সম্ভব। যার ফলে সুবিধাজনকভাবে্ প্রয়োজন অনুসারে উড়োজাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ড্রীমলাইনার উড়োজাহাজের ফিউজলেজ(বডি)একটি একক ব্যারেলের ডিজাইনে তৈরী করা হয়েছে যাতে কোন জোড়া লাগানোর প্রয়োজন হয়নি। অথচ প্রচলিত উড়োজাহাজে অসংখ্য রিভেটের মাধ্যমে এ্যালুমিনিয়াম সীট জোড়া দিয়ে দিয়ে ফিউজলেজ তৈরী করা হয়।
১৩। স্বাস্থ্যকর পরিষ্কার বাতাস:
এই উড়োজাহাজে ব্যবহৃত হয়েছে উন্নত এয়ার-কন্ডিশনিং সিস্টেমের সাথে HEPA-High-Efficiency Particulate Absorber ফিল্টার, যার সাহায্যে কেবিনের বাতাস থাকবে পরিষ্কার এবং ব্যাককেটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকমুক্ত। ড্রীমলাইনার উড়োজাহাজে আরো আছে গ্যাসীয় ফিল্টার ব্যবস্থা যা যাত্রীদের ত্বক শুকিয়ে যাওয়ার মত অস্বস্তি দূর করবে।
১৪। প্রথম ই-এনাবল বানিজ্যিক উড়োজাহাজ:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনার বিশ্বের প্রথম ই-এনাবল বানিজ্যিক উড়োজাহাজ। এর কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট সহ প্রায় সব গুলি সিস্টেম ই-এনাবল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। উড়োজাহাজের ভিতরে এবং উড়োজাহাজ থেকে গ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের সাথে অপারেশনাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং রক্ষনাবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য আদান প্রদান করা সম্ভব।এতে করে সময় ও লোকবল সাশ্রয় হবে। সিস্টেম মনিটরিং ও সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
আশার খবর:
বোয়িং 787 ড্রীমলাইনারে ২০% জ্বালানী সাশ্রয় হবে এবং প্রচলিত সমান আকৃতির উড়োজাহাজের চাইতে রক্ষনাবেক্ষণ ব্যয় ৩০% কম হবে, তাই আমরা আশা করব বিমান ভাড়াও সেই হারে কম হবে। আমরা সবাই ভাল খবরের আশায় থাকলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:২৬