ধূসর সাদা রঙ্গের বড় বড় ক্রেইন পাখি গুলো শীতের প্রথমদিকে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এসে এই লেকে ঘুরে বেড়ায় ।ওরা চলে যায় অস্ট্রেলিয়া ,মাঝপথে থেমে যাত্রাবিরতি নেয় এই লেকে ।মনের আনন্দে দলবেধে ঠান্ডা কনকনে পানিতে সাতরে বেড়ায় তারা।মাঝে মাঝে মাথা ডুবিয়ে পানির নীচে খাবার খোঁজে,কখনো বা উড়ে গিয়ে গাছে বসে।পাখিদের এই খেলা দেখতে খুব ভালো লাগে জনের।তাই তো ভোর হলেই কাঠের দোতলা বাড়ীর কোনের দিকের এই ঘরটায় এক কাপ কফি নিয়ে এসে জানালা খুলে তাকি্য়ে থাকে সে। আকাশটা ধীরে ধীরে সাদা হতে থাকে, ঠান্ডা ভেজা বাতাস , পাখির কলকাকলি , পানির উপর ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তির তির করে পালিয়ে যা্য় । পুরোটা সকাল মোটামুটি এভাবেই কাটে আজকাল জনের,গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে শুকনো ডাল পালার ফাঁক দিয়ে দেখা সামনের লেক,লেকের মাঝে পড়ে থাকা শুকনো মরা গাছ, ক্রেইন পাখি,ঘাটে বাধা নৌকাটা , দুরের ঘন জঙ্গল আর ঘোলা আকাশটাকে নিয়ে ।কখনোবা মাঝরাত ৩ টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায় জনের কাঠের ছাদের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ভাবে সে কি মরে গেছে না এখনো জীবিত ? আজকে এমন একটা দিন, মন বিষন্ন, দৃষ্টি উদাস, কিছুক্ষন পর পর মনে পড়ছে সেই ২৫ বছর আগের কর্নফুলি নদীর পাড়ে ফেলে আসা গ্রামটার কথা।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার কানধুরখিল ইউনিয়নের দূর্গাবাড়ি গ্রাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলা কর্নফুলি নদী। আজকাল জেলা উপজেলা কত কিছু হয়েছে। গ্রামের খুব সাধারন পরিবারের বড় ছেলে জয়নাল হাজারি, বাবা কসিম হাজারি বেপারির জমিতে বর্গা কাজ করত। ২ ভাই আর ২ বোনের মোঢে জয়নাল সবার বড়,এর পর শেফালি, রোশনি শেষে ময়নাল। কথা নাই বার্তা নাই হুট করে ২ দিনের জ্বরে বাবা মারা গেলেন। বিধবা মা আর ১৪ বছরের জয়নালের সে কি বাচার লড়াই। আবছা আবছা মনে পড়ে কাক ডাকা ভোরে মাদ্রাসা্য় যেয়ে আরবি পড়া , টিলার মধ্য দিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে গ্রামের স্কুলে যাওয়া , ১২ টার দিকে ফিরে বেপারির খেতে কাজ করতে যাওয়া, সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে ঢুলু ঢুলু চোখে কেরোসিনের কুপি জালিয়ে পড়তে বসতে না বসতেই ঘুমে চোখ বুঝে আসত। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে মাদ্রাসার মাঠে ডাগুলি খেলা , কখনো বা কর্নফুলি নদীতে ঝাপাঝাপি করে বাড়ী ফিরা দূরন্ত কিশোরের ঝকমকা জীবন। সাদা সিদা হেংলা পাতলা কাল যে ছেলেটা জীবনে কোনোদিন কালুর ঘাট ব্রীজ পার হয়ে চট্টগ্রাম শহর দেখেনি সেই কিনা জীবিকার তাগিদে নাবিকের কাজে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়।এমনি ভাবে একদিন সব নিয়ম ভেঙ্গে জয়নাল গ্রীসে জাহাজ ভিড়ার সাথে সাথে নেমে পরলো ,আজও ভেবে পায়না সে সেদিন এত সাহস পেল কোথা থেকে ?ভাবলে আজো গা শিউরে উঠে জয়নালের। ৮০ র দশকে বাংলাদেশী মালবাহী জাহাজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দুর দেশগুলোতে যেত আর এমনি এক জাহাজ " বাংলার খেয়া " তে নাবিকের কাজ করত জয়নাল। ২৫ টা বছর কত কষ্ট ,কত বেদনা,ক্ষুধা,তৃষনা আর কনকনে ঠান্ডায় পাতলা একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে রাস্তার কোনায় পড়ে থেকেছে সে ।পদে পদে পুলিশের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে আজ এখানে তো কাল অন্যখানে রাত কাটিয়েছে । গ্রীস দিয়ে ঢুকে এদেশ ওদেশ করতে করতে অবশেষে লুক্সেমবার্গের এই ছোট্ট শহর ভিয়ানডেন এ থিতু হয়েছে আজকের জন মানে আমাদের জয়নাল, মাঝে গরিয়ে গেছে ২৫ টা বছর।
কদিন ধরেই ভাবছে নিজ জীবনের গল্প লিখবে সে,নাম দিবে " My Shadow"। নামটা অনেকটা বাংলা সিনেমার ইংরেজী নামকরনের মত শোনায় , হোক জনের জীবন তো বাংলা সিনেমার গল্পের মতোই । জন মনে করে এই গল্পটা একজনও যদি পড়ে তাহলেও ওর কষ্ট
কিছুটা কমবে।কিন্তু এই গল্পের সাথে তো অনেক অবৈধ বাংলাদেশীর জীবন মিলে যাবে যারা সর্বস্ব দিয়ে বেচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে
প্রতিনিয়ত হাজার প্রতিকুলতার মাঝেও। তবে লোকে কেন জনের গল্প পড়বে । এর পিছনে বেশ শক্ত পক্ত যুক্তি খাড়া করে ফেলেছে জন- এ গল্প একজন বিজয়ীর গল্প, হার না মানার গল্প, সংগ্রামী মানুষের সফলতার উপাক্ষান ।
শহরের শেষ মাথার কাঠের আড়াই তলা বাড়ীটা জন আর তার স্ত্রী উরসুলার। আর দশটা ইউরোপীয়ান বাড়ীগুলোর মতই বেইসমেন্টে পড়ে আছে কিছু পুরোনো আধভাঙ্গা আসবাব, পুরোনো টিউব Tv ,কিছু থালা বাসন , চলতা উঠা নন স্টিক প্যান, ভাঙ্গা সাইকেল, পুরোনো বিছানার ম্যাট্রেস। প্রথম তলায় আছে রান্নাঘর, খাবার ঘর ,লিভিং, বাথরুম, ২য়তলায় আছে ৩ টা বেডরুম আর একটা বাথরুম। বাড়ীটার প্রাচীর ঘিরে এই লেকটা ,লেকের ওপাশে ঘন জঙ্গল । কোনার এই ঘরের জানালা দিয়ে খুব মনোরোম সকাল দেখা যায়, শীতের অলস সকাল সাদা ম্যাটমেটে আলো ছড়িয়ে জানান দেয় সে এসেছিল তোমার আঙ্গিনায়। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবে কি আরামের জীবন এখন,অথচ এই তো সেদিন না খেয়ে কিংবা একবেলা খেয়ে কতদিন কত রাত কাটিয়েছে , কলের ঊষ্ন পানিতে শুকনো পাউরুটি ভিজিয়ে নাস্তা করেছে , ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চোখের পানি ফেলেছে , মাঝরাতে উঠে কখনো চাপা কান্নায় ফেলে আসা মা কে ডেকেছে ।বৈরী পরিবেশ,বৈরী পরিস্থিতি, ভিন্ন ভাষা,আর্থিক অনিশ্চয়তা ,অবৈধভাবে বসবাস প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে জীবন কাটানো।কোনদিন হয়তো রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করেছে,কোনদিন হয়তো টার্কিশ রেস্তরায় রান্নাঘরের কাজ করেছে,মালপত্র উঠানো নামানো,অন্ধকার থাকতেই বরফের মাঝে হেটে হেটে পেপার পাড়ায় পাড়ায় বিলি করেছে।পা দুটো ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে থাকতে ফুলে ঢোল হয়ে যেত কোনো কোনো দিন , রাতে ব্যথায় কুকড়ে যেত সে। সেসময় দুটো কাজ করতো জন না হলে বলা তো যায় না কখন কোন কাজ চলে যায় , বলা নেই কওয়া নেই ছাটাই, বেতন কখনো মিলেছে অর্ধেক কিন্ত প্রতিবাদ করবার উপায় নেই নিজেরই তো বৈধতা নেই তার আবার বেতন । কাজ শেষে নিজের ঘরে মানে বেইজমেন্টের এক কোনায় মেঝেতে পেতে রাখা চাদোরবিহীন পুরোনো ম্যাট্রেসে যখন গা এলি্যে দিত কোথা থেকে রাজ্যের ঘুম জাকিয়ে বসত ঐ চোখে। জীবন একটু থিতু হয় বিস্কুটের ফ্যাক্টরিতে কাজটা পাবার পর আর সেখানেই নীল নয়না বাদামী চুলের উরসুলার সাথে পরিচয়। বছরের পর বছর বন্ধুত্ব অবশেষে বিয়ে। আজ উরসুলা নেই আছে তার সাজানো এ বাড়ীর প্রতিটা কোণ। ওদের কোনো সন্তান নেই ।ওভারীর ক্যান্সারে ওটা ফেলে দিতে হয়েছিল উরসুলাকে তাই ও বিয়ে করতে চায়নি জয়নাল কে। বোকা মেয়েটা জয়নাল কে এত ভালবাসা দিয়েছিল যে মাঝে মাঝে জয়নাল ভয় পেত এসব কি সপ্ন না সত্যি। আর ফিরে যায়নি দেশে জয়নাল।নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছে দেশে, বোন দুটোকে বিয়ে দিয়েছে, দূর্গাবাড়ি গ্রামে পাকা দালান বানিয়ে দিয়েছে মা কে, ছোটো ভাইটাকে সদরে দোকান করে দিয়েছে ,মোটামুটি জমির ফসলে বছর চলে যায়,ভাল আচে সবাই। খুব ইচ্ছে ছিল মা কে একবার হোলেও দেখবার বৈধ কাগজ পাবার সাথে সাথেই তাই টিকেট কেটে রেখেছিল । নিয়তি সেটাও হতে দেয়নি, মা মারা গেলেন যাবার ৩দিন আগে। রাগে অভিমানে দুংখে যায়নি আর, চিৎকার করে কেঁদেছে জয়নাল কেন ? এত কস্টের বিনিময়ে এ সচ্ছলতা পেতে হল কেন? কেন টের পেলনা কখন যৌবন পেড়িয়ে গেছে ? বুকটা হাহাকার করে কর্নফুলি নদীর সোঁদা গন্ধের জন্য। সকাল বেলায় জানালাটা খুললে কোথা থেকে যেন এই গন্ধ নাকে আসে,বুক ভড়ে নিস্বাশ নেয় জন, ফিরে যেতে চায় এ মন,তবু যে হয়না ফিরা । পায়ে পায়ে ছড়ায় পিছুটান...................।