১.
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের একটা বড় অংশ থাকে ইংরেজি বিষয়ক পরীক্ষা নিয়ে। ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্র শিরোনামের এই দুটি পরীক্ষায় এ+ পেতে হলে দরকার ১৬০ নম্বর আর পাস করতে হলে ৬৬ নম্বর, সেক্ষেত্রে প্রতিটিতে আলাদা আলাদাভাবে ৩৩ বা তার বেশি পেতে হবে। ৩৩ এর নীচে পেলে এফ গ্রেড! ইংরেজি নিয়ে ভয়ের কারণ একটাই, ইংরেজিতে দুর্বলতা। বাংলাদেশে ইংরেজি প্রাইভেট পড়ায়ে একজন শিক্ষক যত টাকা উপার্জন করেন, অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষকেরা (গণিত ছাড়া) সেভাবে প্রাইভেট বা ব্যাচে পড়িয়ে টাকা উপার্জন করতে পারেন কি না সন্দেহ আছে! এমনকি ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে আসেন নাই, এমন মানুষও হাইস্কুলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ক্লাস নিয়ে থাকেন! যে কারণে শিক্ষার্থীরা একের অধিক ইংরেজি শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয় সেটা হলো :
১. বেশিরভাগ শিক্ষকই স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরী করে থাকেন। তারা ১০-১২ টা প্যারাগ্রাফ, এসে, কম্পোজিশন, রিঅ্যারাঞ্জ এবং সবচাইতে জটিল জিনিস (শিক্ষার্থীদের কাছে) ভোকাবুলারি (আনসিন এবং সিন) পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে দাগিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোবাসনা পূরণ করেন। অনেকেই পুরো প্রশ্নের অংশগুলোই বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের এ+ পাইয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে চান, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়েই তারা তাদের ইংরেজির স্কিল ডেভেলপ করাতে পেরেছে!
২. বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার্থীরা ইংরেজির ওপর সেরকম জোর দেয় না। তারা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান, গণিত এসব বিষয়ে যেভাবে অধ্যায়ন করে, অনুশীলন করে, ইংরেজির অনুশীলন সেভাবে করে না। এ কারণেই ব্যাচে স্যারের বাসায় পড়ার সময়টুকুই তাদের একমাত্র অধ্যায়ন ও অনুশীলন কর্মসূচি হিসেবে ধরা হয়।
৩. ভালো ইংরেজি শিক্ষকের অভাবও এর একটা যথার্থ কারণ। আমাদের দেশে বাংলা মিডিয়ামগুলোতে ভালো মানের ইংরেজি শিক্ষকদের সংখ্যা নগণ্য। আর ইংরেজি শিক্ষার জন্য ক্লাসে যে ইংরেজিতে কথা বলার টেন্ডেন্সিটা চালু করা দরকার, সেটা নিয়ে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও কোনো নির্দেশ দেওয়া নাই! সবচাইতে জরুরি প্রয়োজন স্পিকিং স্কিলটাও ডেভেলপ করা। যদি কেউ একজন ইংরেজিতে শুদ্ধভাবে (তার মানে আমি ব্রিটিশ একসেন্ট এর কথা বলছি না, গ্রামারের কথা বলছি!) কথা বলতে পারে, তাহলে সে পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ক সমস্যার সমাধানগুলোও সঠিকভাবেই দিতে পারবে।
৪. আমাদের বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষার কাঠামো খুবই চমৎকার বলে মনে হয় আমার কাছে। সিন বা আনসিন কম্পোজিশন এবং তার সংশ্লিষ্ট মাল্টিপল চয়েজ, ট্রু-ফলস, ফিল ইন দ্য গ্যাপস, ভোকাবুলারি, সামারি, প্যারাগ্রাফ, রিঅ্যারেঞ্জ সবকটা আইটেমই আমার কাছে আন্তর্জাতিক মানেরই মনে হয়। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষকদের ধৃষ্টতা এবং শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালনা করাটাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের দেশে এখনো অনেক শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে পড়া ঠিক মতো না পড়িয়ে ব্যাচে বা প্রাইভেটে পড়িয়ে থাকেন। তারা যে অপরাধী, সেটার সন্দেহ নাই।
এখন ইংরেজিতে সফট্ওয়্যার ব্যবহারের সুফল সম্পর্কে বলা যাক :
যেহেতু ইংরেজিতে আমাদের শিক্ষার্থী এবং জনসংখ্যার বড় একটা অংশ এখনো দুর্বল, কাজেই তাদের ইংরেজির ভিত গড়ে তুলতে ইংরেজিতে কম্পিউটার ব্যবহারও যে একটা বড় ভূমিকা রাখে, এটা কী ভেবে দেখেছেন? অনেকেই কম্পিউটার ব্যবহার করে ইংরেজি শিখতে পারে। বাংলাদেশে এমন মানুষও আছেন, যিনি নিরক্ষর, লিখতে পারেন না, স্কুলে যান নাই কিন্তু কম্পিউটারে লেখায় তিনি মাস্টার অব অল বসেস! এমএস ওয়ার্ডে টাইপিং শিখেই তিনি ইংরেজি এবং বাংলা শিখেছেন! ইত্যাদিতে এই ব্যক্তিকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম বছরখানেক আগে। কম্পিউটারে টাইপিং সফটওয়্যার এবং কি-বোর্ডে যে পদ্ধতিতে ইংরেজিতে অক্ষরগুলো বিন্যস্ত আছে, এর থেকে ইংরেজি শেখাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লেখায় কিন্তু কারো কোনো সমস্যা নাই। সমস্যাটা ইংরেজি নিয়েই। কাজেই অনেকে ইংরেজিতে সফটওয়্যার ব্যবহারে কাঠিন্য অবলম্বন করলেও ব্যাপারটা সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখুন। উত্তরটা নিজেই পেয়ে যাবেন, ইংরেজিতে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ব্যবহার করে একজন শিক্ষার্থী যেমন টাইপিং শিখতে পারে, তেমনি কোনো ইংরেজি কোনো শব্দের সিনোনিয়াম, অ্যান্টোনিয়ামও শিখতে পারে। এটা একটা পজেটিভ দিক। এখন বাংলায় সফটওয়্যার ব্যবহার করা হলে, ধরা যাক এমএস ওয়ার্ডের মেনুগুলোও বাংলায় বদলে ফেলা হলো, তখন দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজিতে কম্পিউটার ব্যবহার করে আসা মানুষের সেটা বুঝতেও অসুবিধা হবে! বাংলাতে সফটওয়্যার নির্মাণ হতে পারে। তবে কম্পিউটারের পুরোটাই যেন হুট করে বাংলাতে বদলে ফেলা না হয়। জাপান, চীন, রাশিয়া, কোরিয়া, জার্মানি, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ কম্পিউটারের সবকিছু তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় ব্যবহার করে থাকে। জাপান, চীন বা রাশিয়ার একজন শিক্ষার্থী জাপানিজ, চায়নিজ বা রুশ ভাষাতে কম্পিউটারের সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে, এমনকি আমেরিকা থেকে নির্মিত কম্পিউটার গেমসগুলোকেও রাশিয়ানরা ট্রান্সলেশন করে রুশ ভাষায় বদলে ফেলে। এটা তাদের সফটওয়্যার শিল্পের উন্নতির প্রমাণ, যে তারা ইতোমধ্যেই ইংরেজিতে নির্মিত সফটওয়্যার রাশিয়ান, চায়নিজ বা জাপানি ভাষায় বদলে ফেলেছে এবং নিজেদের সফটওয়্যার শিল্পকে মাতৃভাষায় নির্মাণে উন্নীত করেছে। কিন্তু তাদের ইংরেজি শিক্ষার লেভেল বাংলাদেশের চাইতেও অনেক নিম্নমানের। তারা ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব ভাষায়! সেখানে বাংলাদেশের জনগণ ইংরেজিতেই পারদর্শিতার সাথে ফেসবুক ব্যবহার করে। পাঠক কী বুঝতে পারছেন বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা খুবই চমৎকার, ইংরেজিতে আমাদের দেশের মানুষও আগ্রহী কিন্তু শিক্ষক বা শেখার মাধ্যম নগণ্য। সেখানে কম্পিউটারের এই সফটওয়্যারগুলোও ইংরেজি শিক্ষায় বড় নিয়ামক।
বাংলাতে কম্পিউটার ব্যবহৃত হলে এর আরো প্রসার হবে এই ধারণাটাকে সম্মান করি কিন্তু সমর্থন করি না। এখনো ইংরেজিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাই বলে কম্পিউটারের চাহিদা কি কমে গেছে? না, দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। ইন্টারনেটে বাংলা ওয়েবসাইট বা ব্লগসাইটের দরকার আছে। সেই সাথে সেই ব্লগগুলোর ইংরেজি ভার্সনেরও দরকার আছে। তা না হলে আপনি যা লিখছেন, তারা বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণ বুঝতে পারছে, কিন্তু একজন বিদেশি মানুষ যে আপনার লেখা বুঝতে পারছে না! তার দরকার সেই ইংরেজি ভাষাটুকুই।
আমি বাংলাতে সফটওয়্যার ব্যবহারের বিরোধী নই। তবে ইংরেজিতে সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করলে আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজির ভিত শক্ত হয়ে উঠবে এই বিশ্বাস আমার আছে। ইংরেজি শেখার পিডিএফ বই, সিডি-ডিভিডিগুলোও এক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করতে পারে। আফসোস! দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে এ ধরণের প্রোজেকশনের কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত হলো না। ভবিষ্যতে হবার আশা রাখি।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষাকে আমরা সবচাইতে ভালোবাসি। কিন্তু যুগের প্রয়োজনে, উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার বিকল্প নাই। ইংরেজিতে কথা বলতে শিখা, লিখতে শিখা তাই ভীষণ সহায়ক। ঘৃণা করতে হলে আমরা উর্দু ভাষাকে ঘৃণা করবো, ইংরেজিকে নয়। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষায় উৎসাহিত করবো কম্পিউটার ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:২১