somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্লেসিজম : বাংলাদেশিদের ভয়াবহ মানসিক অসুখ!

২৪ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

রেসিজম বলে একটা শব্দ ইংরেজিতে প্রচলিত। এর বাংলা অর্থ "বর্ণ" বা "জাতবৈষম্য"। কে সাদা, কে কালো, কে ধনী, কে গরিব, কে আমেরিকান আবার কে আফ্রিকান এ সব কিছুই রেসিজম এর অন্তর্গত। যে বা যারা বর্ণবাদি বা জাতভেদ বিবেচনা করে পথ চলে, তাদের "রেসিস্ট" বলা হয়। এই রেসিজম বা জাতবৈষম্যের কারণে পৃথিবীতে ঝরেছে মানুষের রক্ত, যুদ্ধ-সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, অপরাধ সবকিছুর অন্যতম কারণ হিসেবে একে চিহ্নিত করা যেতে পারে। গরিবের ওপর ধনীর অত্যাচার, কালোর ওপর সাদার অত্যাচার, নির্যাতনে পৃথিবী বারবার দগ্ধ হয়েছে। এখনো বর্ণবাদ থেমে নেই। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে "ধর্মবাদ" বা "রিলিজিওনিজম"। হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ ভারতে ভয়াবহ। বর্তমানে মুসলমানদের ওপর খ্রিস্টান বা ইহুদিদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯/১১ এর পর আমেরিকা হামলা চালায় আফগানিস্তান ও ইরাকে। মূল টার্গেট ছিলো মুসলমানদের হত্যা করা। এখন আমেরিকা প্রস্তুত হচ্ছে ইরানে হামলা করবার উদ্দেশ্যে। এখানেও মুসলমানেরাই আমেরিকার জাতশত্রু!

আমাদের ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কি এ ধরণের বৈষম্য আছে? হয়তো-বা। তবে বাংলাদেশে সাদা-কালোর ভেদাভেদ সেরকম নেই, যেটা আমেরিকা, ডেনমার্ক এর মতো সাদা চামড়াদের দেশগুলোতে আছে। বিয়ের সময় কালো মেয়েদের চাইতে ফরসা মেয়েদেরই প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি। অবশ্য এটাও বর্ণবাদের পর্যায়ে পড়ে। ধনীর দাপট, গরিবের ওপর নির্যাতন, কাজের মেয়ে, কাজের মহিলা নির্যাতন এখনো বিদ্যমান বাংলাদেশি সমাজে। হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বাংলাদেশে সেভাবে নেই। কারণ বাংলাদেশি ধর্মান্ধ, উগ্রবাদি না। এ কারণেই জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে সুবিধা করে উঠতে পারে নাই। একজন বাংলাদেশি যথেষ্ট বাস্তবিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে। শুধু দারিদ্র্যের কারণে সে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। হাইস্পিড ক্যাবল ট্রেন, হাইস্পিড ইন্টারনেটের দেশে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে যে সুযোগ সুবিধা পায়, বাংলাদেশের কোনো শিশু সেই সুবিধা পায় না। তাকে পথ চলতে হয় যুদ্ধ করে। বাস্তবতার সাথে এই যুদ্ধ সহজ যুদ্ধ না, কঠিন যুদ্ধ।

২.

আমি আমাদের (বাংলাদেশিদের) একটা অসুখ সম্পর্কে কয়েকদিন ধরে চিন্তা করছি। জীবনের একটা সময়ে এই অসুখে আক্রান্ত মানুষদের বঞ্চনার শিকার আমাকে হতে হয়েছে, যদিও সেটা স্বল্প পরিমাণে। এই অসুখটার নাম আমি দিয়েছি "প্লেসিজম"। বর্ণবৈষম্য, জাতবৈষম্যের মতো এর বাংলা হলো স্থানবৈষম্য! প্লেসিজমের উদাহরণ দিচ্ছি, ধরা যাক টাঙ্গাইল বা ফরিদপুর জেলার কোনো ছেলে হাইস্কুল পাস করে ঢাকা শহরের নামী কলেজে ভর্তি হলো, তাহলে সে সেখানে প্লেসিজম এর শিকার হবে।

তুমি কোন জায়গা থেকে এসেছো?

ফরিদপুর।

এটা কোথায়? (বাংলাদেশে না বাংলাদেশের বাইরে? ভাবটা এরকম!)

উত্তরদাতা উত্তর দেবার পর...

ও আচ্ছা! আমি তো আসলে ঢাকাতে বড় হয়েছি, ঢাকার বাইরে সেরকম যাওয়াও হয় নাই...


অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেলো প্রশ্নকর্তা ছাত্রটির বাড়ি ফেনী বা নোয়াখালী!

অনেককেই বলতে শোনা যায়, বরিশালের মানুষ ভালো না, নোয়াখালী বা ফেনীর মানুষ ভালো না... অমুক জায়গার মেয়েরা ভালো না, মানুষ চোর... এই সেই... আচ্ছা কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যে জায়গাটার কথা আপনি বলছেন, সেটা কি বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরের কোনো জায়গা? এতে করে নিজের আত্মসম্মানবোধ নিজের পায়ের নিচে ফেলে মাড়াচ্ছেন আপনি! মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি সব জেলার মানুষকে শ্রদ্ধা করতে, সমান চোখে দেখতে পারি না? ঢাকা শহরে যারা বসবাস করে সবাই কি ঢাকাতেই জন্মগ্রহণ করেছে? মোটেই না। এসবই আমাদের প্লেসিজম এর নমুনা। বিশ্ব এগিয়ে চলেছে আর আমরা পড়ে আছি সিলেট-বরিশাল-নোয়াখালী-ফেনী নিয়ে!

আমরা এই বাজে অসুখে আক্রান্ত। কে কোন জায়গা থেকে ঢাকা শহরে আসলো, এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা। যেন ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী না, ঢাকা হলো নিউইয়র্ক। এটা একটা বিচ্ছিন্ন জায়গা, উঁচু মানুষ, ধনী মানুষদের বসবাস এখানে। দারিদ্র্য নেই। সব ভালো স্কুল-কলেজ এখানে। সব ভালো মানুষ, সবাই অনেক বিখ্যাত, রেডিও-টিভিতে গান করে। নাটকে অভিনয় করে, মডেলিং করে। তাই ঢাকা সেরা। ঢাকার ওপরে নিচে কেউই নাই, কোনো জায়গা নাই। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে যারা এখানে পড়তে আসে বা থাকতে আসে, তারা হলো উচ্ছিষ্ট। বেশিরভাগ ঢাকা শহরের হাই সোসাইটির মানুষের ধারণা এরকমই। ছোটবেলায় ঢাকা শিশু একাডেমি বা শিল্পকলাতে কোনো জাতীয় চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলে এ ধরণের প্লেসিজম এর শিকার আমাদের হতে হয়েছে। ঢাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাধান্য বিচারকেরা সবসময়ই দিয়েছেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা ফরিদপুর, যশোর, দিনাজপুর বা রাজশাহী থেকে কোনো প্রতিভা আসতে পারে, সেটা তারা মানতে রাজি নন। এই অন্ধ গোঁড়ামি আমাদের কখনোই কোনো সুফল বয়ে আনে নাই, আনতে পারবে না। এটা বুর্জোয়ানীতি, বুর্জোয়া মনোভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঢাকার মানুষ দ্রুত নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাগুলোর সংযোগ, সংস্পর্শ থেকে। চার দেয়ালের বন্দী জীবন, অফিসের ব্যস্ত জীবনই মানুষের প্রধান উপজীব্য। তরুণ প্রজন্ম ব্যস্ত ডেটিং, সেক্স, ইয়াবা, শিশা, ডিস্কো, ডিজে পার্টি এসব অবক্ষয়ী জিনিসের নেশায়। সিঁড়ির উঁচু ধাপে উঠতে হলে এ ধরণের উত্তরাধুনিক বিনাশি কার্যক্রমে নিজেকে জড়াতেই হবে, এ ধারণা সর্বোচ্চ। তরুণ প্রজন্ম কেবল ফ্যাশন, নেশা করা শিখছে, ঢাকার বাইরে যে বিশাল বাংলাদেশ রয়েছে সেটা নিয়ে ভেবে দেখছে না। তারা ক্ষুদ্র ঢাকা শহরের নোংরা গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ। ঢাকার বাইরে, এমনকি নিজেদের গ্রামের বাড়ির প্রতিও কারো কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এতে করে যৌথ পরিবারপ্রথা অনেক আগেই শিথিল হয়ে পড়েছে, এখন গ্রামের বাড়ির সাথে মানুষের যে আত্মীয়তা সেটাও ধসে যাচ্ছে। সম্পর্ক হলো দালানকোঠার মতো। সেটাকে গড়ে তোলা যায় আবার ধ্বংস করেও ফেলা যায়। আমাদের প্লেসিজম তৈরী করছে নোংরা বৈষম্য। মানুষে মানুষে তীব্র ভেদাভেদ। সবারই মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এবং নিতান্তই দরিদ্র একটি রাষ্ট্র। এখানে প্লেসিজম আমাদের দরিদ্রতা দূর করবে না, জীবনের মানোন্নয়ন করবে না, দূরে সরিয়ে দিবে প্রগতির পথ থেকে। শুধু ঢাকা শহরকে ঘিরে বা ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে প্রগতির স্থাপনাগুলো। অথচ খুলনার মতো বিভাগীয় শহরে প্রচুর ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে গ্যাসের সংযোগ নেই। কষ্ট করে মানুষকে রান্না করতে হয় উনুনে। খুলনা যথেষ্ট চমৎকার, বসবাসের জন্য। সেরকম জ্যাম নাই, পড়াশোনার জন্য রয়েছে ভালো প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে কুয়েট অন্যতম। সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বেশিরভাগই ঢাকা কেন্দ্রিক। অথচ খুলনা বা এধরণের শহরগুলোকে সংস্কার করে যদি ঢাকার কাছাকাছিও নিয়ে যাওয়া হয়, ঢাকার ওপর থেকে মানুষের চাপটা কমে যেত। ঢাকা হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ট্রাফিক জ্যাম, খুন-ছিনতাই, নেশা সবকিছু মিলিয়ে নরকের পরিবেশ। ঢাকাবাসিদের ভোগান্তির শেষ নেই। তবুও প্রিয় শহর, প্রাণের শহর ঢাকা, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই।

৩.

প্লেসিজম এর দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা জরুরী। সবাইকে অনুরোধ আপনার ছোট ভাই-বোন বা পরিবারের সদস্যদের এই অসুখ থেকে দূরে রাখুন। আমরা সবাই বাংলাদেশি। দেশকে ভালোবাসতে হলে আগে মানুষকে, জায়গাকে ভালোবাসতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতা নেই। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। তবে এই প্লেসিজমের অবসান চাই। ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু ঢাকা নিয়ে নয়, সমগ্র বাংলাদেশ নিয়ে। ঢাকা দেশের রাজধানী। তার মানে এই না, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গা। দেশ ও জাতির উন্নয়নের স্বার্থে প্লেসিজম পরিত্যাগ করা দরকার সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:১১
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×