সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে নাটক নির্মাতা মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র "প্রজাপতি"। ছবিটা ঈদে অনেকেই দেখেছেন এবং হতাশ হবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। আজ ব্লগেও দেখলাম কিছু রিভিউ। আসলে এই ছবিটাকে মূলত রাজ পরিচালিত "জুয়া" নামের একটা নাটককেই টেনে চলচ্চিত্ররূপ দেয়া হয়েছে। ছোটপর্দার নির্মাতারা বড় পর্দায় যেসব ছবি বানান সেগুলো আর যা-ই হোক, নাটক বা টেলিফিল্ম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এর মূল কারণ, ১. চলচ্চিত্র বানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালনা না করা ২. চলচ্চিত্র বানানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নাটক নির্মাণকে বেছে নেয়া, যেটা অবশ্যই ভুল সিদ্ধান্ত। ৩. চলচ্চিত্র পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষ না হওয়া। পৃথিবীর সেরা পরিচালকেরা সরাসরি চলচ্চিত্রই পরিচালনা করেছেন, কখনো নাটক তৈরী করেন নাই। আর স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রগুলোও বাংলাদেশি নির্মাতারা নির্মাণ করতে চান না। তার কারণ, ১. বাংলাদেশে নাটক দর্শকনন্দিত মাধ্যম। স্বল্পদৈর্ঘ্যের হাস্যরসপূর্ণ নাটক দর্শক আজো আগ্রহ নিয়ে দেখে। ২. টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নাটক নির্মাণকে উৎসাহিত এবং নাটক প্রচারে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে, যদিও জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী না থাকলে সেই নাটক তারা প্রচার করবে না, রেখে দিবে প্রিভিউ কমিটিতে মাসের পর মাস! ছোটপর্দার নির্মাতারা দাবি করে আসছেন, বাজেট ও প্রযোজকের অভাবে তারা অনেকেই ছবি নির্মাণ করতে পারেন নাই। তাই নাটক বানিয়েছেন। আসলেই কি তাই? ইমপ্রেস টেলিফিল্ম বা এনটিভি প্রযোজনা করছে তাদের প্রথম অথবা পরবর্তী ছবিগুলো। সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে অবশ্য তারা বরাবরের মতোই উপেক্ষিত। এফডিসির এবং কয়েকজন পোষ্য বিকল্পধারার চলচ্চিত্রনির্মাতা (যারা কেবলমাত্র সরকারি অনুদানের জন্য মুখিয়ে থাকেন এবং সেই টাকায় ছবি বানান) ছাড়া সেই অনুদান একজন ছোটপর্দার প্রতিভাবান নির্মাতার জন্য পাওয়াটা দুষ্করই বটে। যেসব কারণে ছোটপর্দার নির্মাতারা চলচ্চিত্র বানাতে গিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন, স্ক্রিপ্ট মানসম্পন্ন হয়ে ওঠে না বা একই ধরণের অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন করে হাস্যরসাত্মক কমেডি নাটক নির্মাণ করেন ৩৫ মিলিমিটার অ্যারিফেক্স ক্যামেরাতে সেগুলো নিচে পয়েন্ট আকারে দেয়া হলো :
১. অনেক ভালো স্ক্রিপ্টের ভিডিও ফিল্মকে প্রতিভাবান নির্মাতাগণ "টেলিফিল্ম" বানিয়ে টিভিতে জমা দেন। সব থেকে বড় ভুলটা এখানেই হচ্ছে। মেজবাউর রহমান সুমনের "তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে", মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর "ফার্স্ট ডেট", "স্পার্টাকাস '৭১", রেদোয়ান রনির "জননী সাহসিনী ১৯৭১", অনিমেষ আইচের "কুফা", অমিতাভ রেজার "ইজ ইকুয়েল টু" এ ধরণের বহু টেলিভিশন নাটককে তারা সুচারুভাবে চলচ্চিত্রে রূপদান করতে পারতেন। কেন করেন নাই এটা তাদের বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণ। কিভাবে স্বল্প সময়ে টু পাইস কামানো যায় এটা ভেবে তারা মেধা বিক্রি করে দিচ্ছেন! অস্থির প্রতিভাবানরা ভালো স্ক্রিপ্ট পেলেই জগাখিচুরি তৈরী করতে বসে যান, একটু ধীর স্থিরভাবে এগোলেই কিন্তু সেগুলো দিয়েই চলচ্চিত্র তৈরী হতে পারে। মোস্তফা কামাল রাজ "জুয়া" নাটক অনুকরণে "প্রজাপতি" বানিয়েছেন। তিনি যদি "জুয়া" না বানিয়ে একেবারে "প্রজাপতি" বানাতেন, মাল-মসলা জোগাড় করার পর, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তার "প্রজাপতি" অবশ্যই দর্শকনন্দিত হতো।
২. বাজেট সমস্যাকে সবাই এক নম্বরে বলতে পছন্দ করেন। যেন ভাবটা এমন, আমজনতা বাজেট কী বুঝেই না! বাংলাদেশি দর্শকদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ভালো ধারণা আছে, কারণ আমরা সর্বদেশের সেরা ছবিগুলো দেখতে চেষ্টা করি। আমাদের মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার মাত্র দুইটা থাকলেও পাইরেটেড ডিভিডি বা ব্লুরে কিংবা ইন্টারনেট থেকে কষ্টে ডাউনলোড করে ঠিকই বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখি। তবে কম বাজেটে কী ভালো ফিল্ম হতে পারে না? ইরানে স্বল্প বাজেটে কত বিশ্বনন্দিত ছবি হয়। ফারুকী বা ছবিয়াল সংশ্লিষ্ট নির্মাতারা আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে "গুরু" মানেন, সেখানে তাদেরও চিন্তা করে দেখতে হবে যেহেতু ইরানি চলচ্চিত্রের অন্যতম কর্ণধার এই কিয়ারোস্তামি। নাটক তৈরী করতে হয়তো লাখ টাকা খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশের মাটিতে একটা চলচ্চিত্র বানাতে প্রয়োজন পড়বে এক থেকে তিন কোটি টাকা। সরকারি অনুদান পাওয়া যেতে পারে বড়জোর চল্লিশ লক্ষ টাকা। বাকি টাকা আসবে কোত্থেকে? ইমপ্রেস টেলিফিল্ম আছে। আরো টেলিভিশন চ্যানেল বা প্রোডাকশন হাউস আছে যারা সবসময় ভালো চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন শুরু থেকেই। খিজির হায়াত খান পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র "জাগো" প্রযোজনা করেছিলো ইন্টারস্পিড। সেটা সাফল্যের মুখ দেখেছে। খিজির হায়াত খান কিন্তু নাটক দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন নাই, শুরুতেই "অস্তিত্বে আমার দেশ" দিয়ে চলচ্চিত্রজগতে পা রেখেছেন। এভাবে যদি সবাই এগিয়ে আসতো সাহসের সাথে! বাংলাদেশি জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর কী দরকার, ফার্স্ট ডেটের মুসাফিরকে দিয়েই যদি ফারুকী ঐ ফার্স্ট ডেটটাকে চলচ্চিত্র বানাতে পারতেন তাহলে চলচ্চিত্রজগতে বিশাল পরিবর্তন আসতো। পরে তিনি বানিয়েছেন "থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার"। এই ছবি আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত হলেও দেশে অনেকাংশেই নিন্দিত হয়েছে "টেলিফিল্ম" হিসেবে। অভিনবত্ব সেই ছবিতে ছিলো, তবে এর চাইতে অনেক সুন্দর কাহিনীকে ফারুকী নাটক হিসেবে চালিয়েছেন!
৩. শিল্পী সংকট? নাহ্ শিল্পী সংকট নয় আসলে দুটো ধারা তৈরী হয়েছে। একটা নাটক আরেকটা চলচ্চিত্র। নাটকের অনেকেই চলচ্চিত্রে কাজ করছেন সাফল্যের সাথেই। চঞ্চল চৌধুরি, জয়া আহসান, মিলি, মোশাররফ করিম, কচি খন্দকার, তিশা, জাহিদ হাসানসহ অনেক জনপ্রিয় নাট্যঅভিনেতা-অভিনেত্রীকে দর্শক সানন্দেই গ্রহণ করেছে। তবে সমালোচকেরা যেটা আশঙ্কা করেছে যে, তাদের অভিনয় চলচ্চিত্রসম্মত হয়ে ওঠে নাই। নাটকের একটা ছাপ রয়ে গেছে। এই জড়তা কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব। আরো বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রয়োজন। যত বেশি কাজ তারা করতে পারবেন তত বেশি তারা অভিনয়ে দক্ষ হয়ে উঠবেন। এফডিসির রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এবং বাজে পরিবেশের কারণে অনেকেই সেখানকার মূলধারার চলচ্চিত্রে কাজ করতে রাজি হন না, খুবই স্বাভাবিক। নাটকের পরিবেশের চাইতে এফডিসির পরিবেশ অনেক নোংরা।
৪. গিয়াসউদ্দিন সেলিমের "মনপুরা" দর্শকের সেই "নাটক-সিনেমা"র অভাবটা পূরণ করে দিয়েছিলো। তাই সবাই যে নাটক স্টাইলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সেটাও কিন্তু সত্যি না সবক্ষেত্রে! তিনি যত্ন নিয়ে ছবিটা বানিয়েছিলেন। সেটা খুবই সাড়া জাগিয়েছে। আবহ সঙ্গীত, নির্মাণ, বিন্যাস, চরিত্র-চিত্রায়ণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন তিনি। তবে মাঝখানে তার বিরতি। কারণ হিসেবে বলেছেন, সামনে একটা বড় প্রজেক্টে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাই এই স্বেচ্ছা বিরতি!
নাটক ও চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্য : নাটক অনেকটা অযত্নে নির্মিত হয়, সেখানে প্রযুক্তি বা কৌশলগত ব্যাপারগুলা নিয়ে অতটা মাথা ঘামানো হয় না। কারণ এই নাটক মানুষ দেখবে টিভি পর্দায় বা সিডিতে। অন্যদিকে, চলচ্চিত্র দেখানো হবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিশাল হলে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষও সেটা দেখবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। নাটক বানানো হয় শুধুমাত্র টেলিভিশন দর্শকের কথা বিবেচনা করেই। ডিভি ক্যামেরায় সেটা শ্যুট করে তড়িঘড়ি করে এডিটিং প্যানেলে দিয়ে কোনোরকম একটা ভিডিও ফিল্ম দাঁড় করানো হয়। অবশ্য ধারাবাহিক নাটকগুলোও এখন একপেশে হয়ে গেছে। সেখানে চলচ্চিত্র সারা দেশের মানুষ দেখবে, দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখবে। সেখানে আবহসঙ্গীতের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ভিন্ন। নাটক নির্মাণে শট ডিভিশন বা আলো-ছায়ার প্রতি অতটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। লো লাইটে ক্যামেরা চালিয়ে ডিভি ক্যাসেটে ফুটেজ জমা করা হয়। কিন্তু চলচ্চিত্র ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায় কোডাক বা ফুজি ফিল্মে ধারণ করা হয়। কৌশলগত দিক থেকেও চলচ্চিত্রের বেশ কতগুলো ভাগ রয়েছে। ঐতিহাসিক, সমসাময়িক, যুদ্ধ, উগ্রতা, সূচনা, মধ্যাহ্ন, পরিসমাপ্তি বা সমাপ্তি সবদিক মিলিয়ে চলচ্চিত্র নিতান্তই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বানানোর মতো কিছু একটা। নাটক অনেক রিল্যাক্সিং!
সম্প্রতি নাসিরউদ্দীন ইউসূফ বাচ্চু পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি "গেরিলা" কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (২০১১) জিতে নিয়েছে "শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র" পুরষ্কার। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জন্য মাইলফলক।
সামনে আসছে ছোটপর্দার প্রতিভাবান নির্মাতা ইফতেখার আহমেদ ফাহমীর "টু বি কন্টিনিউড" এবং রেদোয়ান রনির "চোরাবালি" নামের দুইটি চলচ্চিত্র। আশা করি তাদের ছবি দর্শকনন্দিত হবে।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি।