------------------
"আপনি পারুল নামের কাউকে চেনেন? ঐ যে মালিবাগ থাকতো যে......"
আমি চট করে ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর পেছনে চলে গেলাম। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলাম- এলাকার বন্ধুদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছি। পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। বিকালের ঐ সময়টাতে পারুল বেশিরভাগ সময় ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখতো চোখ বড় বড় করে...... এমন না যে- মাঠে মেয়েদের কোন দল ছিলো না। শরিফা, স্বাতী,মাফরুহা আপুরা ছোঁয়াছুঁয়ি অথবা ফুলটোকা খেলতো প্রায়ই। পারুলের মা মারা যাবার আগ পর্যন্ত ওকেও অন্য সব মেয়েদের সাথে এগুলো খেলতে দেখেছি । তবে হঠাতই একদিন পারুল খেলতে আসা বন্ধ করে দিলো। মাসখানেক পর আবার যখন ওর সাথে দেখা, ততদিনে পারুলের বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। মূলত সেই থেকেই মেয়েটা চুপচাপ হয়ে গেলো হঠাৎঃ মাঠে আসে ঠিকই, কিন্তু এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে। অন্য সবার খেলা দেখে।
......আজ সেই পারুলের মেয়েই দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কৌতূহলী গলায় জানতে চাইছে- আমি পারুলকে চিনি কি না ! জিজ্ঞেস করে জানলাম- মেয়েটার নাম মিতুল। এবার ইউনিভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারে উঠেছে। সন্তান হয়ে নিজের মায়ের পুরাতন প্রেমিককে খুঁজে বেড়াচ্ছে কেন মেয়েটা- এটা ভাবতে ভাবতেই আবার অতীতের বায়োস্কোপে চোখ রাখি আমি। সেখানে আলোর গতিতে একের পর এক ঘটনা অতিক্রম করে চলেছে......
বয়স তখন কতই বা হবে আমাদের। বড়জোড় থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি। এই বয়সটায় অত কিছু খেয়াল করার কথা না, স্রেফ শৈশবের আনন্দ-স্ফুর্তিতেই মজে থাকার কথা, তারপরো আমি দেখলাম- পারুল অন্য সব মেয়েদের মত না আসলে। অন্য মেয়েগুলো মাঠে আসতো খুব পরিপাটি হয়ে- চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো; মাথায় বাহারী বেণী অথবা রঙ বেরঙের ক্লিপ, রাবার ব্যান্ড বাঁধা। টানটান পরিষ্কার ভাঁজভাঙা ফ্রকে মেয়েগুলোকে লাগতো পলিশড মুক্তার মত। সেই তুলনায় পারুল ছিলো উষ্কখুষ্ক। তখন অত উপমা কিছুই মাথায় আসতো না আমাদের, কিন্তু আজ বুঝি- পারুলকে তখন অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাছার মতই দেখাতো। আমাদের মধ্যে জাহিদ ছিলো একটু দুষ্টু টাইপের। সে প্রায়ই দাঁত কেলিয়ে আমাদেরকে মনে করিয়ে দিতে লাগলো- পারুলের আব্বা আরেকটা বিয়ে করেছে ইত্যাদি। ফেসবুক, ইন্টারনেটবিহীন নিস্তরঙ্গ জীবনে তখন সেটাই ছিলো বিশাল কোন খবর ! তাছাড়া আমাদের ছোটদের জন্য এ ধরণের আলাপ তখন নিষিদ্ধ ছিলো। যেহেতু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি চিরকালই মানুষের আকর্ষণ থাকে বেশি, তাই আমরাও এ কথাগুলো শোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী হয়ে উঠতাম। পারুল কি মনে করছে না করছে- অত কিছু ভাবার মতন মানসিক পরিপক্বতা তখনো আসে নি আমাদের কারোই......
একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার পা মচকালো। সেটাই পারুলের সাথে আমার বন্ধুত্বের শুরু। মচকানো পা নিয়ে আমি মাঠ পর্যন্ত যেতে পারতাম ঠিক, কিন্তু খেলায় আর যুক্ত হতে পারতাম না। অবধারিতভাবে আমারো জায়গা হতো পারুলের পাশে, সে-ই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে। খুব কমিকস পড়তো পারুল তখন- চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকী...... আমাকেও পড়ে শোনাতো মাঝে মাঝে। আমি চাচা চৌধুরী আর সাবুর এডভেঞ্চারের গল্প শুনতে শুনতে আমার ফুটবল খেলতে না পারার দুঃখটুকু ভুলতাম। পারুলও আমার সাথে দু' একটা কথা বলতে আরম্ভ করলো টুকটাক। বেশিরভাগই অবশ্য কমিকস সম্পর্কিত......
ধীরে ধীরে পারুলকে দেখছিলাম গুছিয়ে উঠছে অনেকটাই। সত্যিকারের মায়ের অভাব যে সন্তানের জীবনে, তাকে একা একাই বড় হতে হয় আসলে। পারুলও একা একাই বড় হয়ে উঠছিলো, তারপরো মেট্রিকে খুব ভালো রেজাল্ট করলো। যদিও এর দু'এক মাস পরই পারুলের বাবা আর তার সৎ মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। লোকটা তৃতীয় বিয়ে করে পারুল যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছিলো- তখন !
কৈশোরের ঐ সময়টুকু খুব নির্দয় হয়। এলাকাবাসী থেকে শুরু করে পারুলের কলেজের বান্ধবীরা সবাই ফিসফাস করে পারুলের জীবন নিয়ে আলোচনা করা আরম্ভ করলো। যদিও প্রকাশ্যে না, কিন্তু পারুলের জ্ঞাতসারেই। আমি ততদিনে পারুলের একমাত্র বন্ধু এবং সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছি। তাই অন্যদের কাছে ভাবলেশহীন, আনমনা পাথরের মত মেয়েটা আমার সামনে এসে ঝর্ণা হয়ে যেতো। প্রায়ই কলেজ থেকে ফেরত আসার সময় সেন্ট্রাল গভমেন্টের মাঠ হয়ে আসতাম আমরা। ওখানেই নারকেল গাছের সারির নীচে দাঁড়িয়ে পারুল ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতো। কার্যকর সান্ত্বনা দিতে না পেরে আমার খুব অস্বস্তি লাগতো তখন। কি আর করা ! যদিও পারুল বারবারই আমাকে বলেছিলো- সান্ত্বনার দরকার নেই তার। একজন মানুষের সামনে নির্ভার হয়ে কাঁদতে পারছে- এটাই নাকি তার মত মেয়ের জন্য অনেক !
যাই হোক- ইউনিভার্সিটি ভর্তি হয়ে পারুল হলে উঠে গেলো। আমিও পড়াশোনার জন্য চলে গেলাম চট্টগ্রামে। দূরত্ব আমার আর পারুলের মধ্যকার ঘনিষ্টতা কমাতে পারে নি। ছুটিতে ঢাকায় এলেই পারুলের হলে গিয়ে দেখা করতাম ।কত বিকেল যে পার করেছি আমি আর সে ফুলার রোডে ! সেখানকার কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোকে মনে হতো আমাদের শৈশবের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেনো। পারুলের বড় বড় চোখদু'টো দেখলে আমি মাঝে মাঝেই শৈশবে হারিয়ে যেতাম তখন। মনে হতো- আমি আর বালিকা মেয়েটি গাছের নীচে বসে আছি। সে আমাকে একের পর এক কমিকস পড়ে শোনাচ্ছে নীচু গলায়......
এমনি এক নিভু নিভু শীতের বিকেলে আমি পারুলকে প্রপোজ করেছিলাম......
এতোক্ষণে নিশ্চই এটুকু বুঝতে পারার কথা- পারুলের সাথে আমার বিয়েটা হয় নি। সামাজিকভাবে পারুলকে আমি পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য করাতে পারি নি তখন। আব্বা-আম্মার একটাই কথা- ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়েকে ঘরে আনাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া টাকা-পয়সা, স্ট্যাটাস কিংবা পড়াশোনা- কোনটাতেই আমার গ্রহণযোগ্যতা কম ছিলো না একেবারে। শুধু শুধু পারুলের মত এক 'বাপে-খেদানো-মায়ে-তাড়ানো' মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নেয়ার কি দরকার ইত্যাদি......
চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না আমার দিক থেকে- এ আমি হলফ করে বলতে পারি। শেষমেষ অবশ্য না করে দিয়েছিলো পারুলই ! অনার্স শেষ করে কোন এক এনজিওর চাকরি নিয়ে কোথায় চলে গেলো- আর পেলাম না ওকে ! হারিয়ে ফেলা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু যে নিজে থেকে হারাতে চায়- তাকে খুঁজে বের করাটা কষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তাই পারুলের সাথে আমার শেষ দেখা। এরপর আর অনেক খুঁজেও ওকে কোথাও পেলাম না। পাঁচ-পাঁচটা বছর অপেক্ষা করে একরকম অভিমান থেকেই গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। মনে হলো- পারুল আমার ভালোবাসার মূল্য বোঝে নি আসলে। যদি বুঝতো- তাহলে কথা নেই বার্তা নেই আমাকে এভাবে একা ফেলে পালিয়ে যেতো না......
আমার ঘোর ভাঙ্গলো মিতুলের কথা শুনে। সে নীচু গলায় বলছে- "আপনি আমার মায়ের উপর কোন রাগ রাখবেন না প্লিজ ! মা যেটা করেছে- সেটা আপনার ভালোর জন্য, আপনাকে একটু স্বস্তি দেয়ার জন্যই করেছিলো......"
নিজের মায়ের পুরাতন প্রেমিকের সাথে এমন সাবলীলভাবে কোন সন্তান কথা বলতে পারে- সেটা দেখে একটু অবাক হচ্ছিলাম। বিব্রতও। মেয়েটা সম্ভবত সেটা বুঝতে পারলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁপা গলায় বললোঃ "পারুল মা আমার আসল মা নন, সৎ মা। আমার নিজের আম্মু মারা যাবার পর বাবা আবার বিয়ে করলেন। এরপর থেকেই উনি ছিলেন আমাদের দুই বোনের সঙ্গী......"
"তোমার পারুল মা কেমন আছে?"
মেয়েটা একটু শুকনো হাসি দিলো এবার। চোখভর্তি পানি নিয়ে বললো- "তিনি মারা গেছেন গত বছর। ক্যান্সার হয়েছিলো। আমার বাবাও মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে, যদিও বাবার চেয়ে পারুল মায়ের সাথে আমাদের ঘনিষ্টতা ছিলো বেশি। জানেন- উনার সাথে আমাদের দুই বোনেরই সম্পর্ক ছিলো বান্ধবীর মত! মৃত্যুর আগে মা প্রায়ই আপনার কথা বলতেন আর আফসোস করতেন ! আপনার মত একজন ভালোমানুষ বোধহয় এখনো উনার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছে- এটা ভেবে প্রায়ই খুব অস্থিরতায় ভুগতেন তিনি...... আমি তাই অনেক কষ্ট করে আপনাকে খুঁজে বের করেছি- পারুল মায়ের হয়ে তাঁর মেসেজটুকু পৌছে দেয়ার জন্য ! আপনি প্লিজ উনার ওপর কোন রাগ রাখবেন না।"-- একসাথে অনেকগুলো কথা বলে মেয়েটা যেনো একটু হাঁপাতে লাগলো......
আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পারুল মারা গেছে- এই তথ্য আমি তখনো মেনে নিতে পারি নি। কেমন ঘোর ঘোর লাগছিলো যেনো আমার ! এরই মধ্যে শুনলাম মেয়েটা আবার বলছে- "আপনি নাকি আপনার ফ্যামিলিকে কোনভাবেই রাজি করাতে পারছিলেন না, এদিকে ছাড়তেও পারছিলেন না মা'কে। দিন দিন নাকি মুষড়ে পরছিলেন খুব। পারুল মা আপনার সেই টানাপোড়েন মেনে নিতে পারলেন না। তাই অনেক ভেবে চিন্তে আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আসলে...... "
এম্নিতেও মৃত মানুষদের প্রতি কোন ক্ষোভ রাখতে নেই। তার ওপর মাঝখানে এতোগুলো বছর পার হয়ে গেছে; অসন্তুষ্টির অনুভূতির দেয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে আরো কতকাল আগে ! আমি আর পারুলের মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক গল্প করি।
"উনি আমাদের সৎ মা হলেও কখনো জন্মদাত্রীর অভাব বুঝতে দেন নি। রাতে গল্প বলে ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে যত্ন নিয়ে চুল আচড়ে দেয়া, জ্বর হলে সারারত জেগে সেবা...... জানেন, কখনো কখনো আমাদের কাছে মনে হতো- নিশ্চই আমরা দুই বোন বড় ধরণের কোন পূণ্য করেছিলাম- যার জন্য আল্লাহ আমাদের দু'জনকে এমন একটা মা দিয়েছিলো জীবনে !"
আমরা কথা বলতে বলতে ফুলার রোডে এসে বসলাম। কার্তিকের বিকেল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এদিকে গাছপালা বেশি হওয়াতে অন্ধকারও নামে দ্রুত। আমি মিতুলের মাথার ওপর দিয়ে ওদিককার কৃষ্ণচূড়া সারির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্রায় সতেরো বছর আগে, এমনই এক সন্ধ্যায় পারুলের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো এখানেই। মনে হয় যেনো এই তো সেদিন ! আহা ! জীবন সেই হতভাগিনীকে বঞ্চিত করেছে নানাদিক থেকে নানাভাবে, কিন্তু অন্যদেরকে সে বঞ্চিত হতে দেয় নি ! মায়ের আদর না পাওয়া সেই উষ্কখুষ্ক, এলোমেলো চেহারার বালিকাটি জন্মদাত্রী না হয়েও মিতুলের প্রতি নিজের স্নেহ কেমন ঢেলে গেছে অকাতরে। কত বড়, কত উদার মনের একজন মানুষ হলে এরকম হওয়াটা সম্ভব ! ভালোবাসার মানুষ কষ্ট পাচ্ছে দেখে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলো একদিন, আর আমি কি না এতদিন ভেবে এসেছি-পারুল আমার ভালোবাসার মূল্য বোঝে নি !! আমার পুরাতন হৃদয় গভীর হাহাকারে পূর্ণ হলো। নিজের অজান্তেই দু'চোখ ভর্তি হয়ে গেলো পানিতে......
"আপনি আমার পারুল মা'কে ক্ষমা করেছেন তো, না !"- মিতুল কাঁদো কাঁদো গলায় আমার কাছে জানতে চাইলো।
আমি চোখ মুছে প্রগাঢ় স্নেহে মেয়েটার মাথায় হাত রাখি। তারপর আবৃত্তির মত করে বলি - "তোমার পারুল মা তাঁর ব্যথা দিয়ে, ব্যর্থতা দিয়ে জয় করে নিয়েছে আমাকে। এসব মানুষদেরকে ক্ষমা করা যায় না রে মা, এদের কাছে সমর্পণ করতে হয় !"
মিতুল চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পারুল তাঁর বায়োলজিক্যাল মাদার নয়, তাই মা-মেয়ের চেহারায় কোন মিল থাকার কথা না। তারপরো শেষ বিকেলের মৃদু আলো, হেমন্তের হিম হিম অন্ধকার আর ফুলার রোডের ঘোরলাগা চিরন্তন ঘ্রাণ মিলিয়ে আমার কাছে স্পষ্ট মনে হলো- দুঃখিনী পারুল আজ বেঁচে থাকলে বুঝি আমার দিকে ঠিক এভাবে, এমন করেই চাইতো। দু'চোখ ভর্তি হয়ে যেতো তাঁর জলে, আর মুখে চিরন্তন দুঃখের হাসি !
".....I could not bring
My passions from a common spring—
From the same source I have not taken
My sorrow—I could not awaken
My heart to joy at the same tone—
And all I loved—I loved alone...."
ইশ পারুল, একা একাই ভালোবেসে যাওয়া পারুল- তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো- আমি ফিসফিস করে বললাম ! এর চেয়ে বেশি আর কি ই বা বলার ছিলো আমার !
***
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:০৯