জমীর উদ্দীন তার সাধের নৌকাটা বেচে দিয়েছেন আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো।
সবার আগে নৌকা বিক্রি করে দিয়েছিলো সেলিম, তাও সেটা মাসখানেকের কাছাকাছি হবে। তারিখটা জমীর উদ্দীনের মনে আছে- আশ্বিন মাসের তিন, কারণ সেদিনই ব্রীজ উদ্বোধন করতে এম.পি সাহেব এসেছিলেন। বসিরের হাটে নৌকা বেচে দিয়ে এসে সেলিম হেলতে দুলতে ব্রীজের উদ্বোধন দেখতে গেলো। বয়স কম হলে যেটা হয় আর কি, সব কিছুতেই উতসাহ!
ব্রীজ নদীর ওপর যে জায়গাটাতে করা হয়েছে, খেয়াঘাট থেকে তার দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। তাই মাঝিরাও যার যার যার যার নৌকা থেকেই উদ্বোধনের ব্যাপার স্যাপারগুলো মোটামুটি ভালোই দেখতে পাচ্ছিলো। জমীর উদ্দীন নিজেও আগ্রহ নিয়েই দেখলেন- ব্রীজের দু'প্রান্তে কিছু মানুষের জটলা, দক্ষিণ পাশটায় এম.পি সাহেবের গাড়ি দাঁড়িয়ে। অল্প সময়ের মাঝেই উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে এম.পি সাহেবের চকচকে গাড়িবহর ব্রীজের এক পাশ থেকে অন্য প্রান্তে পার হয়ে গেলো। দু'পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো সেটা দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
আশ্চর্যের ব্যাপারটা হোল- এম.পি সাহেব চলে যাবার ঘন্টাখানেকের মাঝেই ব্রীজের উপর দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে একটা দু'টো রিকশা, কখনো সাইকেল এমনকি মোটর সাইকেলও পার হয়ে যেতে দেখা যায়- যেনো বহু আগে থেকেই ব্রীজটা এই নদীর ওপর আছে, যেনো কোন কালেই এ গ্রামের মানুষ কখনো নদী পার হবার উদ্দেশ্য নিয়ে খেয়াঘাটে এসে দাঁড়ায় নি! খেয়ানৌকার মাঝিদেরও দুর্দিনের শুরুটা মূলতঃ সেখান থেকেই।
অবশ্য এমন যে ঘটবে সেটা আগেই অনুমান করা গিয়েছিলো। খেয়াপারাপারের অবসরে মাঝিরা সবাই নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনাও করতো। তলে তলে কাজ সব থেকে এগিয়ে রেখেছিলো সেলিম। ছোকরার বয়স কম, মাথাটাও হয়তো সে কারণেই পরিষ্কার। একদিন হঠাতই কথায় কথায় সে অন্য মাঝিদেরকে বলে-
"আল্লার নামে দোকান একটা দেওনের ব্যবস্থা মোটামুটি কইরা লাইলাম।"
রতন মিয়া অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে "দোকান দিবি! কস কি? এতো টেহা পাইবি কইত্থিকা?"
"আগের কিছু জমছিলো, তাছাড়া সমিতি থেইকাও কিছু ঋণ লওনের ব্যবস্থা করছি.."
ঋণ এর কথা শুনে হোসেন মিয়া চোখ কপালে তোলে; জিজ্ঞেস করেঃ "কস কি, সমিতি থেইক্যা ঋণও দেয়? আমি তো মনে করছি তারা খালি বাচ্চা না হওনের ওষুদ বিলায়।"
হোসেন মিয়ার কথা শুনে সেলিম কাধ ঝাকিয়ে হাসে, বলেঃ "না কাকা, এইডা ঐ সমিতি না, অন্য সমিতি। তাছাড়া অত বড় কোন দোকান তো আর দিমু না, ছোটখাট একটা ব্যবসা.. নৌকাডা বেইচা দেওনের পরে সেইখান থেইক্যাও হাতে কিছু টেহাপয়সা আইবো- সব মিলায়া...."
সেলিমের মুখে নৌকা বিক্রি করে দেবার কথা শুনে চমকে উঠেছিলো জমীর উদ্দীন। সম্ভবত মাত্র সাত-আট বছর খেয়াপারের কাজ করে দেখে বলেই ছোকরা নৌকা বিক্রি করে দেবার মতন অমন ভয়ঙ্কর একটা কথা অবলীলায় বলে ফেলতে পারলো। তার মতন কিংবা হোসেন মিয়ার মতন মাঝিরা- যারা যুগের পর যুগ ধরে- বাপ দাদার এই পেশাকে রক্তের মাঝে বয়ে নিয়ে চলেছে- তাদের কাছে যে কাঠের একটা সামান্য নৌকার মূল্য কতখানি- সেটা সেলিমের মতন চ্যাংড়া ছেলেপিলেরা কেমন করে বুঝবে?
ধীরে ধীরে ব্রীজের কাজ শেষ হওয়ার ক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, ততই সময়ে-অসময়ে মাঝিদের আলাপ আলোচনারও প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে সেই একই রুজি রোজগারের চিন্তা। জমীর উদ্দিন সাধারণত এ ধরণের আলোচনা এড়িয়ে চলতেন কয়েকটা কারণে, প্রথমতঃ তিনি একা মানুষ; স্ত্রী পারুল গত হয়েছেন বছর দুই আগেই। এক ছেলে, দুই মেয়ের সবাই যার যার পরিবার নিয়ে শহরে থাকে। সুতরাং বিরাট সংসার টেনে নেবার যে দায়িত্বটা এখনো অন্য মাঝিদের মাথার উপর চেপে বসে আছে, তিনি সে ভার থেকে অনেকটাই মুক্ত। আর সে কারণেই মাঝিরাও যখন তাকে এ বিষয় নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতো, তিনি হাসিমুখেই উত্তর করতেনঃ "আমি এল্যা (একলা) মানুষ, আমার দিন একরকম কাইট্যা যাইবো মিয়ারা"।
শলা-পরামর্শ যেটা দিয়েই শুরু হোক না কেন- আলোচনা অবধারিতভাবে এসে শেষ হোত নৌকা বিক্রি করে খেয়াপারের কাজ ছেড়ে দেবার মতন মন ভার-করা একটা মীমাংসায় পৌছে। জমীর উদ্দিনের মতন প্রবীণ মাঝি যারা আছেন, তাদের কারোরই এ চিন্তাটা ভালো লাগতো না। জমীর উদ্দীন স্পষ্ট বুঝতে পারতেন যে হোসেন মিয়া, রতন ভাই, সুরুয ভাই- এরা প্রত্যেকেই এই একটা জায়গায় এসে নিজেদের দীর্ঘশ্বাস গোপন করছেন।
অবশ্য রুজির চিন্তা যে জমীর উদ্দীন একেবারেই করতেন না, সেটাও ঠিক নয়। ব্রীজটা খুলে দেয়া হলে যে মাঝিদের টাকা-পয়সার টানাটানি শুরু হবে- এতে তো আর কোন দ্বিমত নেই। তাহলে আসলেই তখন তিনি চলবেন কেমন করে? প্রায় রাতেই শুয়ে শুয়ে উপায় নিয়ে ভাবতেন তিনি। সঞ্চয় যেটা আছে- সেটা দিয়ে কয়েক মাস নাহয় চললো, কিন্তু তারপর? তবে কি ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে.... জমীর উদ্দীন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলেন।
ছেলে-মেয়েদের কথা মনে হওয়াতেই জমীর উদ্দীনের দুঃশ্চিন্তা অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই সুখ-কল্পনায় পালটে যায়। মেয়েদের খুব একটা খারাপ বিয়ে দেন নি তিনি আর পারুল মিলে, স্বামী সন্তান নিয়ে মোটামুটি ভালোই আছে তারা। ছেলেটাও ঢাকায় নিজের সংসার চালিয়ে নেবার মতন চাকরি একটা জুটিয়ে নিয়েছে; তেমন আহামরি কিছু নয়- কিন্তু স্বামী, স্ত্রী আর এক মেয়ে- এ তিনজনের ছোট্ট পরিবারটা বেশ সুন্দরভাবেই চলে যায়। ছেলের চাকরির সমস্যা একটাই- সহজে ছুটি পায় না। মেয়েরা তো এমনিতেই বড় কোন উতসব-উপলক্ষ্য ছাড়া এখন আর বাপের বাড়ির দিকে আসতে-টাসতে পারে না, ছেলেটাও ব্যস্ততার কারণে দেখা যায় গ্রামে আসে বছরে সর্বোচ্চ পাচ কি ছয় বার!
জমীর উদ্দীনের ছেলে ইকরাম সর্বশেষ দেশে এসেছিলো গত ঈদে। মা মারা যাবার পর থেকে সে বারবারই বাবাকে বলে আসছে তার সাথে শহরে চলে যাওয়ার জন্য। ঐবার এসেও সে একই প্রসংগ তুললো।
"আপনের যে বয়স তাতে সব সময় আপনেরে চোখে চোখে রাখা দরকার। কখন কি না কি হয়... এই জন্যেই আপনেরে কই, আমার লগে চলেন। ঢাহায়(ঢাকায়) থাকলে আর কিছু না হোক, কাছাকাছি তো থাকা অইলো। বাড়িত আপনের একটা দুর্ঘটনা গটলে গ্রামে আইতেই লাগে ধরেন কমপক্ষে তিন ঘন্টা। তার উপ্রে থাকেন আবার এল্যা (একলা) কইরা"
ছেলের কথা শুনে একই সাথে মনে মনে খুশি এবং বিরক্ত হন জমীর উদ্দীন। খুশি এই কারণে যে, নিজের সংসার কষ্টে-সৃষ্টে চললেও বাপের দায়িত্ব নিতে ছেলে ভয় পায় না- এটা ভেবে; আর বিরক্ত হন বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যাবার ইকরামের ছেলেমানুষি প্রস্তাব শুনে। এমন কথা তো জমীর উদ্দীন কখনো চিন্তাও করতে পারেন না! বাপ-দাদার ভিটা ফেলে রেখে আরেক জায়গায় এভাবে কেউ যায়? ঐ তো শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়েই তাদের পারিবারিক গোরস্থান; সেখানে তার বাবা-চাচার কবর। মা, দাদী, চাচী, ফুফুরাও সবাই তো এখানেই আছে! তাদের সবাইকে ছেড়ে তিনি শহরে চলে যাবেন? এতো সহজ? পূব পাশের সব থেকে নতুন কবরটা পারুলের- সেটার কথাও কি ইকরামের একবারো মনে হোল না! নাহ, ছেলেটা জোয়ান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিটা এখনো ঠিকমতো পাকে নি।
সেবার যাওয়ার আগে দিয়ে ইকরাম বাবার হাতে একটা কালো মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে নীচু গলায় বললো- "আব্বা, এইডা রাহেন। সব সময় তো বাড়িত আওয়ার ছুটি পাই না। আপ্নেরেও ঢাহায় নিতে পারলাম না। এইডাতেই সময় সুযোগ মত আপ্নের লগে কথা কমু। হাতে টাহা-পয়সা থাকলেও এই মোবাইলই পাঠামু। তাছাড়া বুবুরাও কইতেছিলো আপ্নেরে একটা মোবাইল কিনা দিবার লেইগ্যা; এহন মাইয়াগো লগেও ঘন ঘন কতা কইতারবেন..."
ইকরাম গতবার যখন বাড়ি এসেছিলো, তখনো সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হয় নি- তবে পুরোদমে কাজ চলছে। বাজারে জোর গুজব- যেমন করেই হোক ইলেকশানের আগেই সেতুর কাজ শেষ করে ফেলা হবে, পারলে বর্ষার আগেই! শেষমেষ অবশ্য বর্ষায় সেতু খুলে দেওয়া সম্ভব হোল না, উদ্বোধন হোল সেই আশ্বিন মাসের প্রথম দিকে এসে।
সেতু উদ্বোধনের দিন রাতেও জমীর উদ্দীনের ফোনে ছেলের সাথে কথা হয়েছিলো। পুরো গ্রামে এমন আলোচিত একটা ঘটনা- অথচ ছেলেকে সেটা বলবার মত খুব একটা উতসাহ জমীর উদ্দীন পাচ্ছিলেন না। ব্রীজের প্রসংগ তুললেই ইকরাম অবধারিতভাবে আবার ঢাকা চলে যাবার জন্য তাগাদা দেয় শুরু করবে। এতোদিন জমীর উদ্দীন যে যুক্তিতে নিজের অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন- এখন আর সে সুযোগ নেই। সামনের দিন বড় কঠিন! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাবার্তার এক পর্যায়ে জমীর উদ্দীন ক্লান্ত গলায় ছেলেকে ব্রীজ উদ্বোধনের খবরটা জানালেন।
ইকরাম সেটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর জমীর উদ্দীনকে অবাক করে দিয়ে বললো- "আব্বা, অনেক রাইত হইছে; আজকে আপনে ঘুমায়া যান। আমি আগামী সপ্তায় ছুটি নিয়া বাড়িত আসার চেষ্টা করমু। এর মইদ্যে আপনে নিজেও চিন্তা-ভাবনা করেন, হোসেন কাকা, সুরুয কাকাগোর লগেও শলা-পরামর্শ কইরা দেখেন তারা কি কয়। আপনেরা খেয়া পারের কাম যারা করতেন, সবারই তো একই সমস্যা হওনের কতা।"
ইকরাম সেই সপ্তাহে ছুটি পেলো না, এলো তার পরের সপ্তাহে। সে এসেই ছোটাছুটি করে নিজেদের নৌকাটাকে বিক্রি করে দেওয়ার সব ব্যবস্থা করলো। ততদিনে অন্য সবাই অবশ্য যার যার নৌকা বিক্রি করে দিয়ে একেকজন একেক কাজে জড়িয়ে পড়েছে- কেউ গেরস্থের কাজ, কেউবা আবার সেলিম মিয়ার মত দোকানদারীর কাজ। কি আর করা- পেটের দাবী বলে কথা! এই দাবী কোন উচিত-অনুচিত মানে না। তা না হলে কেউ কি আর বাপ-দাদার পেশা সাধে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে? নাকি এই বয়সে এসেও হোসেন মিয়াকে বাইল্যার বাজারের আশেপাশের রাস্তায় দিন-রাত রিকশা চালিয়ে যেতে হয়?
ইকরাম সেবারই জমীর উদ্দীনকে সাথে করে ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু রতন কাকা, সুরুয কাকারা সবাই মানা করলেন। তাদের যুক্তি হোল- জমীর উদ্দীনের নিজেরও তো মানসিক কিছুটা প্রস্তুতির দরকার আছে, নাকি! একজন মানুষ তার চিরচেনা বাপ দাদার ভিটে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন আরেক জায়গায় চলে যাবেন, আবার কবে আসতে পারবেন, আদৌ আসতে পারবেন কি না- তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই... সহজ কথা তো না! তাছাড়া ঢাকায় ইকরামের নিজের সংসারটাও এক্ষেত্রে কিছুটা গুছিয়ে নেয়ার একটা ব্যাপার আছে; শত হলেও একেবারে নতুন একজন মানুষ তাদের পরিবারের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হতে যাচ্ছে। সব মিলে ইকরাম নিজেও চিন্তা করে দেখলো- হাতে সপ্তাহখানেক সময় পেলে তার জন্য সুবিধাই হয়। সুতরাং শেষমেষ জমীর উদ্দীনের শহরে যাওয়া স্থির হোল পরের সপ্তাহে- ইকরাম আগামী সপ্তাহের শুক্রবার বাড়ি এসে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঢাকা ফেরত যাবে।
রতন মিয়া-সুরুয মিয়াদের উপদেশ শুনেই হোক আর যে কারণেই হোক, জমীর উদ্দীন তার পরদিন থেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে- ছেলের কাছে চলে যাবার জন্য মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিতে শুরু করলেন। এমনিতে তিনি যথেষ্ঠ শক্ত মানসিকতার একজন মানুষ, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেল না। সমস্যা শুধু একটাই- আর সেটা হোল শীতলক্ষ্যা নদী! নদীর পাড়ে গেলেই আশ্বিনের শান্ত, কোমল শীতলক্ষ্যার আদুরে স্রোতের মতনই মমতামাখা স্মৃতিরা সব ভীড় করতে শুরু করে, জমীর উদ্দীনের ভালো লাগে না। মনটা বড় ভার হয়ে আসে। সে কারণেই দরকার না পরলে তিনি নদীর ওদিকটায় খুব একটা যান না। সময় কাটানোর জন্য বাইল্যার বাজারে সেলিমের দোকানে গিয়ে বসে থাকেন; ছোকরার আয়-উন্নতি দেখেন। সেটাই বরং ভালো লাগে তার।
খুব স্বাভাবিক নিয়মেই আগের মাঝিদের সাথে এখন আর অত ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাত হয় না, তারপরো ঢাকায় চলে যাবার আগে জমীর উদ্দীন সবার কাছে গিয়ে গিয়ে বিদায় নিয়ে এলেন। হোসেনের কাছ থেকে শুধু বিদায় নেওয়া বাকি ছিলো, কাকতালীয়ভাবে সেদিন সেটাও হয়ে গেলো। দুপুরের দিকে সেলিমের দোকানে বসে জমীর উদ্দীন টিভি দেখছিলেন- এমন সময় দেখলেন হোসেন তার রিকশা নিয়ে দোকানের সামনে এসে টুন টুন বেল বাজাতে লাগলো। জমীর উদ্দীন সে দিকে তাকাতেই তিনি রিকশায় উঠে আসবার জন্য ইশারা করলেন।
হোসেনকে সালাম দিয়ে সেলিম উচু গলায় বললো- "কাকা, এক কাপ চা খাইয়া যান"
"দুপুর বেলা চা খাইতাম কি রে ভাইস্তা? সইন্দ্যাকালে আমু নে"
জমীর উদ্দীনকে রিকশায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যার ঘাটে পৌছুনোর আগ পর্যন্ত তাদের দু'জনের মধ্যে কোন কথাবার্তা হোল না। ঘাটে পৌছে সুবিধামত জায়গায় রিকশাটা রেখে যখন তারা দু'জন পাড়ের বিশাল অশ্বত্থ গাছটার শিকড়ের ওপর গিয়ে বসলো, সূর্যও সে মুহূর্তে পশ্চিমে অনেকটা হেলে পড়েছে।
"বিড়ি খাইবা নি জমীর?"
জমীর উদ্দীন নিঃশব্দে বন্ধুর হাত থেকে বিড়ি নিয়ে আগুন ধরালেন।
"কবে যাইতেছ তাইলে?"
"ইকরামে আইবো পরশু, হেয় একদিন বাড়িত থাইকা পরের দিন আমারে লগে কইরা নিয়া যাইবো।"
"তার মানে"- হোসেন মিয়া মনে মনে কিছু একটা হিসাব করে- "শুক্কুরবার পরে, নাকি!"
জমীর উদ্দীন কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
"মন খারাপ কইরো না মিয়া। ঢাহা থেইকা নরসিনদী আর কতই দূর! যহনই মনে চাইবো- বাসে উইঠ্যা আইয়া পড়বা, আমরা ত আছি ই"
জমীর উদ্দীন কিছু না বলে বিড়ি টানতে লাগলেন। হোসেন মিয়া যেরকমটা বলছে, আসলেই ব্যাপার সেরকম হলে কত ভালোই না হোত! কিন্তু জমীর উদ্দীন তো জানেন যে বাস্তবতা আসলে কতটা ভিন্ন! কে বলবে- হোসেন মিয়াও হয়তো সেটা বুঝতে পারে! প্রকৃত সত্য জেনেও তো অনেক সময়েই আমরা নানা কারণে সেটাকে অস্বীকার করে বসি। ঐ অস্বীকারটুকু না করলে বেচে থাকাটা মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে আরো কঠিন হয়ে যেতো।
জমীর উদ্দীনকে মন খারাপ করতে মানা করে হোসেন মিয়া নিজেই অবশ্য মন খারাপ করেঃ "বালাই তো ছিলাম, শালা সব নষ্টের মূলে এই হারামজাদা ব্রীজ..."
জমীর উদ্দীন নরম গলায় বললেনঃ "বাদ দাও, যেইডা হওনের ছিলো- হেইডাই হইছে। আর তাছাড়া আমাগো কয়েকটা মাঝিরই না হয় সমস্যা, কত মানুষের ত কত উপকারও তো হইলো। মনে নাই, হেইদিন যে মেম্বার সাব কইতেছিলো- আমাগো নাতি নাতনিরাই এই ব্রীজের আসল উপকার টের পাইবো"
বংশধরদের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই হয়তো হোসেন মিয়ার পুরো ব্যাপারটা মেনে নিতে কিছুটা সুবিধা হয়। একসময় সে বিড়বিড় করে বলে- "বুঝলা জমির, হেইদিন এক প্যাসিঞ্জার লইয়া ব্রীজের উপ্রে উঠছিলাম। তহন মনডা এমুন খারাপ হইলো- আর কি কমু! মনে হইলো- নৌকা দিয়া যহন এপার-ঐপার করতাম, তহন যেমুন চাইলেই নদীর পানিডার নাগাল পাইতাম, ব্রীজে উঠার পর হেই একই নদী জানি কত দূরে সইরা গেলো! এরপর থিকা আমি আর না পারতে ঐপারের প্যাসিঞ্জার রিকশায় লই না"
"যাউকগা" অপ্রিয় প্রসঙ্গ পালটে হোসেন মিয়া উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললোঃ "চল উডি। তোমারে বাড়িত নামায়া দিয়া আমি বাজারের দিকে যামু; বেশি দেরি করলে আবার আন্ধার নাইমা যাইবো।"
জমীর উদ্দিন হালকা গলায় বললেনঃ "আমি পার ধইরা হাটতে হাটতেই বাড়ির দিকে যামু গিয়া, তুমি তোমার মতন চইল্যা যাও; সমিস্যা নাই।"
"ঢাহা যাওনের আগে দিয়া কইলাম দেহা কইরা যাইও মিয়া"- বলেই হোসেন মিয়া আর দেরি না করে নিজের রিকশাটাকে সচল করেন।
প্রিয় বন্ধু চোখের আড়াল হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত জমীর উদ্দীন পাকা রাস্তার দিকে চেয়ে রইলেন। হোসেন মিয়ার লাল-হুডের রিকশা যখন আবছা হতে হতে ধুসর পথের প্রান্তে পুরোপুরি মিলিয়ে গেলো, তখন জমীর উদ্দীন নিজেও ধীরপায়ে হেটে বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন।
ভালোই লাগছিলো হাল্কা বাতাসে নদীর তীর ধরে ধরে হাটতে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে; তাতে তেজ নেই, শুধু গাঢ় হলুদ আলোর ঔজ্জ্বল্যটুকু রয়ে গেছে। শীতলক্ষ্যার রুপালি ঢেউ সে সোনারং রোদ নিয়ে বালিকার উচ্ছ্বাসে আপনমনে খেলা করে যেতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে জমীর উদ্দীনের মনের গহীনেও স্মৃতিরা সব একে একে বয়ে চলা শুরু করে- তিনি টেরও পান না। স্মৃতি আসে ঠিক শীতলক্ষ্যার ক্লান্তিহীন, গাঢ় স্রোতের মত করেই- প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার এক ঝিকিমিকি নদীর কথা মনে পড়ে তার- যে অদ্ভূত, অপার্থিব নদী তার সৌন্দর্য দিয়ে অভিভূত করেছিলো পারুল নামের এক লাজুক, গ্রাম্য নববধুর অবাক দু'নয়ন! বিয়ের পর প্রথম প্রথম সুযোগ পেলেই দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে জমীর উদ্দীন স্ত্রীকে নৌকায় করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। ভাটির টানে লোকালয় ছাড়িয়ে নৌকা ভেসে যেতো বহুদূর। নতুন বৌ এর মনোরঞ্জনের জন্য নারায়ণ কাকার মত তিনিও গান ধরতে চাইতেন-
"আশা ছিলো মনে মনে
প্রেম করিমু তোমার সনে
তোমায় নিয়া ঘর বান্ধিমু, গহীন বালুর চরে গো..."
বেসুরো গলায় তার সে গান শুনে পারুল মুখে আচল চাপা দিয়ে হাসতো শুধু। তিনি বড়ই বিব্রত বোধ করতেন।
ভাটির দিকে সে-ই জমিদার বাড়ির আমবাগান পর্যন্ত গিয়ে নৌকা তীরে ভেড়াতেন জমীর উদ্দীন। তারপর কত গল্প আর অর্থহীন হাসাহাসিতে নদীর যুবতী স্রোতের মতই সময় গড়িয়ে যেতো, রোদের সোনালী রঙ পালটে তাতে মিশে যেতো কমলার স্বপ্নময় আভা! শেষবেলার সে রঙ মাথায় জড়িয়ে জমিদার বাড়ির নিবিড় আমবাগান একসময় তাদের দু'জনকে বিদায় জানাতো মন-প্রাণ উজাড় করা আশীর্বাদে। এমনই এক মধুর যাত্রা শেষে ফিরে আসবার পথে নদীর পানিতে পড়ন্ত সূর্যের রৌদ্র-ঝিকিমিকি দেখে পারুলের একদিন কি মনে হয়েছিলো কে জানে, তিনি ব্যাকুল স্বরে তার স্বামীকে বলেছিলেনঃ "আমারে একদিন ঐ আলোর কাছে নিবা গো মাঝি?"
এই নদী শুধু যে পারুলের কথাই মনে করায় এমন তো না! জমীর উদ্দীনের বাবার কথাও মনে পড়ে- যিনি হাতে ধরে জমীর উদ্দীনকে নৌকা বাওয়া শিখিয়েছিলেন। আবছাভাবে মনে পড়ে মমতাময়ী মায়ের স্মৃতি- ছোটবেলায় গায়ে সাবান ডলে যিনি এই নদীর জলেই সন্তানের শরীর ধুয়ে দিতেন। ভাই-বোন, বন্ধু বান্ধব- সবাই মিলে এই নদীতেই কত দাপাদাপি- এপার-ওপার কত সাতার... জমীর উদ্দীন আপন মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, গাঢ় গলায় ফিসফিস করে বললেনঃ "আহারে! আহারে!!"
শেষ কথাঃ
ঢাকায় আসার সারাটা রাস্তা জমীর উদ্দীন মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিলেন, শুধু বাস কাচপুর ব্রীজে ওঠার পর নীচের শীতলক্ষ্যা নদীটাকে দেখে তিনি ব্যাকুল হয়ে কাদতে শুরু করলেন। বৃদ্ধ পিতাকে এমন অসহায়ের মতন কাদতে দেখে ইকরামের নিজেরো মন কিছুটা ভারী হয়ে এলো। সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাবার পিঠে হাত রাখলো, সাদা পাঞ্জাবীর ওপর মমতার কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললোঃ "কাইন্দেন না আব্বা, আমি আগামী দুই মাসের মইদ্যেই পারলে ছুটির ব্যবস্থা কইরা আপ্নেরে একবার বাড়ি নিয়া যামু।"
ছেলের কথা শুনে জমীর উদ্দীন নিজের কান্না সামলানোর চেষ্টা করেন, ভেজা চোখেই আবার চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে বাইরে ফিরে তাকান; দেখতে পান অপরাহ্নের সূর্যের গাঢ় হলুদ আলো কি অপূর্ব সব নকশাই না তৈরি করছে চিরপরিচিত, চিরআপন শীতলক্ষ্যার উদার, মুক্ত জলে! জমীর উদ্দীনের অশ্রু টলমল চোখে নদীবক্ষের সে রোদ প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক-চিকচিক করে; প্রাচীন দু'নয়নে হীরন্ময় দ্যুতিতে মায়াবী হয়ে ধরা দেয় আরো প্রাচীন, ভালোবাসার এক চিরন্তন নদী।
জমীর উদ্দীন প্রকৃতির সে অপার ঐশ্বর্য মন ভরে দেখে নেন। ফিসফিস করে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেনঃ "বাবারে, আমার একদিন নিবা ঐ আলোর কাছে?"
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৭