যখন আমার ঘুম ভাঙ্গলো ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম – পূর্ব দিকে সোনালী রঙের ছটায় মেঘের দল রাগান্বিত ভঙ্গিতে রয়েছে। আমার কানে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের মত লাগল, কপালে কালো চুলের মত কিছু একটা ছুঁয়ে গেছে টের পেলাম।
শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা উপেক্ষা করেই উঠলাম আমি। দ্রুতই মনে পড়লো আমি একটি উঁচু পর্বতের উপর প্রায় উঠতে বসতে চেয়েছিলাম। আমার স্বল্প স্মৃতিতে মনে আছে আমি ওখানে কিভাবে পৌঁছেছিলাম, কিন্তু ওটা এখন কোন ব্যাপার না। আমি যদি একটু সরে গিয়ে কাজটা করতাম তাহলে সেটা কাজে লাগতো।
****
আমি আবার সামনে এগুনো শুরু করলাম, কিন্তু বুকের ব্যথা আমাকে বারবার নুয়ে পড়তে বাধ্য করছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বাম হাঁটুর উপর ভর করে বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলাম এবং সামনের দিকে এ-গুলাম। দূরবর্তী পাহাড়ের পাশ থেকে গোলাপি আভাসটা ঘোষণা করছে একটি নতুন দিনের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। আমি পার্বত্য ঢাল বেয়ে বেদনাদায়ক ভাবেই আস্তে ধীরে নামা শুরু করলাম। পিছিয়ে পড়া কিছু পাইন গাছের দল রাস্তাটা জুড়েই আমাকে সঙ্গ দিল, এমনভাবে সঙ্গ দিল যেন আমি হঠাৎ কোন বিপদে না পড়ে যাই।
গভীরভাবে ডুবে যাওয়ার মত আমার মনে একটা কণ্ঠই বাজছে, তার স্মৃতি মনে না করতে চাইলেও অনাহূত ভাবেই এসে যাচ্ছে।
এলেনা – তরুণী, সুন্দরী, নিষ্পাপ একটা মেয়ে। তের বছর আগে আমি যখন তাকে দেখেছি, তখন থেকেই তার মুখাবয়বটি আমার চোখের সামনে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি জানি আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি যদিও তখন আমরা নিজেদের মাঝে ‘হাই’ও বলিনি। মনে আশংকা ও ভীতি নিয়েই তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম; কিন্তু সে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত ছিল কারণ সকল সহকর্মীই তার সাথে কথা বলতে চায় – যে জায়গায় সে ঐদিনই প্রথম জয়েন করেছে। যখন তার ঠোঁটগুলো কথা বলতে শুরু করলো, তার কণ্ঠস্বরটা ছিল একদম নরম, তার কণ্ঠস্বরটা এতই সুমধুর ছিল যে আমি সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর আর পিছে তাকানো লাগেনি।
এভাবেই আমাদের গল্পটির শুরু হয়। এটা ছিল অসম্ভব রকমের সুন্দর, যেটাকে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এটা ছিল বন্য, কামুক এবং ভালবাসায় এতটাই পূর্ণ ছিল যে, যতবারই আমি তাকে দেখতাম আমি রুদ্ধশ্বাস হয়ে যেতাম।
*****
দিনের আলো দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের গতি এত বেড়ে গেছে যে বনের পাইন গাছগুলো বাতাসের তোপে নাচছে এবং আমার লম্বা ওভারকোটটা পিছনের দিকে এতই দুলছে যে আমার হাঁটার গতিকে আরও কঠিন ও ধীর বানিয়ে দিল। পাখিরা আগুয়ান ঝড় থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছে।
আমার পিছনে থাকা ট্রেইলটা বড়ই হচ্ছে, যেটা এখন সবুজ কার্পেটের মত পানিযুক্ত মস দিয়ে ঢেকে গেছে। আমি আমার মোকাসিনের জুতা পড়ে পাথরের তৈরি রাস্তার উপর একটা ফিস ফিস পদচারণের আওয়াজ পেলাম। দূর থেকে ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনলাম, যেটায় মনে হল একটি নতুন দিনের সূচনা হতে যাচ্ছে।
দূর থেকে নীল-টালিকৃত ছাদটা দেখে একটা পরিচিত গভীর দুঃখের কথা মনে পড়ে গেল। আর কিছুক্ষণের মাঝেই, আমি বাসায় চলে যাব! কল্পনা করছি, এলেনা বিছানায় শুয়ে আছে, সূর্যের প্রথম রশ্মিটা তার গালকে স্পর্শ করছে, ঘুমের মাঝেই সে মৃদু হাসছে। আমি প্রায় দেখতে পাচ্ছি ঘুম থেকে উঠার পরের আবেগটা, তার হাই তোলাটা। বিছানা থেকে নেমে নাইট গাউনের ফিতেটা কোমরের কাছে আরও শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরে যাচ্ছে, যেখানে রান্নাঘরটা তার মনোযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। আমার মনের চোখে, এখনো কল্পনাতীত সুন্দর। বিয়ের দশ বছর পেরিয়ে গেলেও, সে এখনো তরুণীই। সে এখনও এতোটা রূপবতী যে, তার দিকে একবার মাত্র তাকালেই আমার হৃদয় পাখির ডানার মত ঝটপটানি শুরু করে।
আমি আমার এবং আমার ভালবাসার অবশিষ্ট দূরত্বটা বন্ধ করে দিয়েছি। কাঠের পরিচিত দুইস্তর বিশিষ্ট দরজাটা আটকানো। আমি নক করতে দ্বিধা করিনা। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আমি আমার নিজের বাসায় প্রবেশ করলাম।
*****
যখন আমি আসলাম, থালা-বাসনের একত্রিত শব্দ আমাকে স্বাগত জানালো। যেমনটা আমি ভেবেছিলাম, এলেনা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। আমি দরজার দিকে এগিয়ে উড়তে থাকা পর্দার আড়ালে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা আমার স্ত্রীর দিকে তাকালাম, যে এখনো জানেই না তার জন্য আমি চমকে দেওয়ার কী পরিকল্পনা এঁটেছি।
তার ঘন কালো চুল মাথার পিছনে কয়েল আকৃতির মত শক্ত করে বাঁধা ছিল এবং তার শরীরের বেশির ভাগটাই লাল জ্যামিতিক আকারের ছাপের মাড় দেওয়া এপ্রনে আবৃত ছিল। সিল্কের গাউনটা তার শরীরের সাথে এমন ভাবে এঁটেছিলো যে তার শুকনো দেহটাকে আরো আকৃষ্ট দেখাচ্ছিল। তার ঠোঁটগুলো একত্রে লেগে আছে, নরমস্বরে শিস দিচ্ছে। বেদনাদায়ক-ভাবে আমার মনে পড়লো যে, এই গানটিই আমাদের বিয়ের বাজানো হয়েছিল। গানটির পরিচিত জায়গাগুলো আমাকে এতটা গভীরভাবে সম্মোহিত করে ফেলল যে, বাস্তবতায় ফিরে আসতে আমাকে বেশ ভালোই কষ্ট করতে হয়েছে। আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলাম।
‘এহেম! এহেম!’
এলেনা ভীত হয়ে শব্দের উৎসটার দিকে ঘুরলো, বাতাসের মাঝেও বিন্দু বিন্দু ঘামছিলো। তার চোখের সাথে আমার চোখের মিলন হল। প্রাথমিক অবস্থায় তারা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, ধীরে ধীরে সেটি চমকে বদলালো, এবং কিছুক্ষণ পর পুরোপুরি আতঙ্কিত হল। তার হাতে ধরা কফি মগটা মেঝেতে পড়ে গেল, পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার মুখ হাঁ হয়ে গেল। শ্বাস নিতে নিতে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না।
‘হ্যালো! প্রিয়তমা!’ হেসে বললাম আমি। সে আমাকে স্বাগতম জানালো না, শুধু তোঁতলিয়ে একটা বাক্যই বলল। হঠাৎ করেই গরম রান্নাঘরটা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগলো।
সে তার মাথায় হাত দিল এবং অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে মৃদু ধুপ শব্দ করে পড়ে গেল। আমি আমার লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসলাম। আমার স্ত্রীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, অসহায় অবস্থায় অবস্থায় মোচড়াচ্ছে। রান্নাঘরের ওপাশে এভাবেই সে পড়ে রইলো।
আমি এগুলাম। ভাঙা মগের টুকরোগুলো আমার পায়ে শক্ত ও তীর্যকভাবে গেঁথে যাচ্ছে, যেটা আমার মাংসকে অল্প কেটে ফেলেছে। আমি সেটা নিয়ে ভাবলাম না; আমার চোখ এখন শুধু স্থির রয়েছে এলেনার উপর। সে এখন তার মাথাকে একটু উপরে উঠানোর জন্য সংগ্রাম করছে এবং আমার ধীর গতির এগিয়ে আসা দেখছে।
সে দুর্বল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, তারপরও মরিয়া এক চেষ্টা চালালো উঠার। তার মুখের সামনে কাঁপাকাঁপা হাতটা আনলো। আমার দিকে তাকালো। ‘থমাস -?’
‘এটাই আমার নাম, এলেনা।’ বললাম আমি। ‘এখন তুমি কি উঠতে পারবে না আমাকে তোমার কাছে আসতে হবে?’
সে অসংলগ্ন-ভাবে উত্তর দিল। গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে, সে যেখানে পড়েছিল সেখানে হেঁটে গেলাম। আমি আমার দাঁতগুলো বের করলাম এবং আমার সুন্দরী স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এবং দ্রুতই অন্য কোন শব্দ করার আগে সে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।
*****
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার ঘাড় ও ধড় বেয়ে আমার স্ত্রীর রক্তের ধারা ছোট স্রোতের মত বইছিল। শশব্যস্ত শহরের রাস্তায় উঠার আগে ঘামযুক্ত জামার হাতা দিয়ে রক্তের দাগটা মুছে নিলাম। এলেনা ছিল প্রেমময়ী, ছিল সুন্দরী ও দরদী। এবং এখন সে মৃত।
বুক ভরে সকালের বাতাসটা নিয়ে আমি স্বছন্দ গতিতে হাঁটা শুরু করলাম।
আমার কোন সুস্পষ্ট গন্তব্য নেই, কিন্তু বিস্ময়কর-ভাবে আমি খেয়াল করলাম যে আমার পা গুলো পাহাড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। যেখান থেকে আমি মাত্রই নেমে আসলাম। ‘এটার অবশ্যই কোন মানে আছে’ আমি ভাবলাম। ‘আমার যাত্রাটা সেখানেই শেষ করতে হবে, যেখান থেকে এটা শুরু হয়েছিল।’ শরীরের ব্যথা উপেক্ষা করে পকেটে হাতগুলো ঢুকিয়ে আমার এলাকার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। ‘আমি আবার পাথরের চূড়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিব’ নিজেকে এটা বলতে বলতেই এগুচ্ছি, যেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমার শক্তিটা সঞ্চিত থাকে।
এলেনা রক্তাক্ত মুখের ছবিটা কল্পনা করলাম। এবং এটাই আমাকে হেঁটে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চার করলো।
******
আমার স্ত্রীর সাথে কাটানো গত তেরোটা বছর ছিল একদম নিখুঁত। সে ছিল অসাধারণ এক সঙ্গী, নিগূড় প্রেমিকা। সে আমাকে কখনো কোন কিছু নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কোন কারণও দেয় নি। সে আমার জীবনটাকে রঙিন করে তুলেছিল যেটা অন্য কোন নারী কখনোই পারেনি। জীবনটা আমার কাছে একটা সঙ্গীতের মত ছিল...
... গতরাতের ঘটনাগুলোর ঘটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
ভবিষ্যতে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করার জায়গা পরিদর্শনের জন্য আমাকে অফিসিয়াল ট্রিপে বাইরে যেতে হয়েছিল। ঝড়ের কারণে যাত্রাটা তাইওয়ান পর্যন্ত ছোট হয়ে গিয়েছিল। আমি নির্ধারিত সময়ের দুইদিন আগেই বাড়ি ফিরে আসব, এটা আমাদের দুজনের কেউই ভাবিনি। এলেনাকে দ্রুতই আবার দেখতে পারবো ভেবে মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। আমার সুন্দরী স্ত্রীর জন্য কিছু দামী চকলেট ও ফুল নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে আসলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাবে চড়ে এসে বাসায় যখন নামলাম তখন প্রায় সাড়ে সাতটার মত বাজে। কল্পনা করছিলাম, এলেনা এখন রান্নাঘরে তার জন্য রাতের খাবার তৈরি করছে। আমি ডোরবেলটা চাপতে যাচ্ছিলাম, তখন খেয়াল করলাম সামনের দরজাটা কিছুটা আধখোলা হয়ে আছে। বিভ্রান্ত হয়ে থুঁতনিতে হাত দিয়ে ভাবছিলাম, এতটা অসাবধান তো তার পক্ষে হওয়া সম্ভবই না। তাহলে কি এটা সম্ভব যে, সে কারো আসার আশা করছিলো?
আমি ঢুকে দরজাটা লাগালাম। ভিতরে কোন উত্তেজনাকর বা তাড়াহুড়োর কিছু ছিল না, ছিল শুধু ফাঁকা দেয়ালগুলোর পাথুরে নীরবতা। একটা ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে গেলাম, যখন উপর থেকে এলেনার ছন্দময় হাসির শব্দ শুনলাম। বেডরুম! নিশ্চিতই, কিছু একটা ঠিক নেই।
আমি দৌড়ে সিঁড়ির কাছে গেলাম, একসাথে দুটো করে ধাপ অতিক্রম করছি। বেডরুমের দরজার সামনে গিয়ে থামলাম। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো ছিলো। আমি শুনছি। একটা পুরুষের গলার শব্দ – ‘ওহ সুইট এলেনা! তুমি সব সময়ের মতই প্রেমময়ী। যে বুড়ো হাবড়াটার সাথে থাকছো, আর কতবার বলব তাকে তালাক দিতে? আমাদের টাকার দরকার নেই, আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি। এটাই যথেষ্ট!’
আমি জমে গেলাম। গলার স্বরটা আমার পরিচিত। স্বরটার মালিক আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু রুপার্ট। তার উপহাসটা আমাকে ভয়ংকর-ভাবে রাগিয়ে দিল।
এলেনা আবারো হাসলো। বললো, ‘আমি জানি সোনা! কিন্তু আমি থমাসের সাথে অনেকদিন ধরেই এমনভাবে বাস করছি যে আমি এখন এই ব্যয়বহুল জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার স্বাদটাও ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তুমি কি চাও আমার বাকি জীবনটা আমি মুক্তা আর পশম ছাড়াই কাঁটাই?’
অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আমি কল্পনা করছি, আমার স্ত্রী দুঃখী মুখ করে উপহাস করছে আর পাশের মানুষটা তার রুক্ষ আঙ্গুলগুলো দিয়ে তার মুখটাকে স্পর্শ করছে। পেটের অ্যাসিডিটি বাড়ার মতই রাগে ফেটে পড়লাম আমি।
একটা সন্তুষ্টময় শব্দ করলো রুপার্ট। সাথে বললো, ‘সেটা আমি তোমার থেকে কিভাবে চাইতে পারি, মাই ডিয়ার? কিন্তু তোমার সাজেস্টে তাকে খুন করাটা বেশি রিস্কি হয়ে যায়। যদি কোন গোলমাল বেঁধে যায় এবং আমরা ধরা পড়ে যাই? আমি এইটাও চাইনা যে, তোমার সৌন্দর্যটা নোংরা অন্ধকারাচ্ছন্ন কারাগারে থেকে নষ্ট হোক।’
আমার স্ত্রীর ব্যয় করার সময় সকল হাসি ও আমাকে খুশি করার মানে বুঝতে পারলাম আমি। পাগুলে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলাম আমি। ভিতর থেকে আমাকে খুন করার প্ল্যানটা বন্ধ দরজার বাইরে থেকে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম – ‘তুমি দেখে যাও সোনা! এর জন্য আমি নিখুঁত প্ল্যান করে রেখেছি। তালা দেওয়া ক্লজেটে থাকা তার উইলে এটা বলা আছে তার যদি ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু’ হয় তাহলে তার সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমাকেই ঘোষণা করা হবে। আমি পুরোটাই পড়েছি, এবং জানি ঠিক কোন ‘দুর্ঘটনা’টার কথা এখানে বলা হয়েছে। আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা ধনী হব এবং সুখী ভাবেই পরের মাসে বা তারপর বিয়ে করবো।’
এলেনার কথার ভয়াবহতায় আমি চমকে উঠলাম। আমার মাথার ভিতর একটা ক্রুদ্ধ কণ্ঠের লম্বা বক্তৃতা তৈরি হল। এবং হঠাৎই আমি নিজেকে একটি হ্রদের মাঝে ভাসমান অবস্থায় পেলাম। যেটার শব্দটা জোয়ারের মত শোনাচ্ছিল। আমি হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। আমি মনে হয় কিছু শব্দ করে ফেলেছি, কারণ ভিতরের আওয়াজগুলো হঠাৎই থেমে গেল। বিছানা থেকে নেমে মেঝে ধরে হেঁটে আসার মৃদু পদশব্দ পেলাম।
আমার সামনেই দরজাটা খুলে গেল। আমার মনে হচ্ছে আমি দুটো অচেনা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। রুপার্টের মুখে শোচনীয় ভয়াবহতা ও অস্বীকারের একটা অভিব্যক্তি ছিল। আমি তাকে এড়িয়ে গেলাম। এলেনার দিকে নজর দিলাম। তার সুন্দর মুখটায় অস্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল। রেগেও ছিল। যদিও পুরোটা সময়ই এলেনা তার ডান হাতটা তার পিঠের পিছে রেখেছিল, এবং খুবই দ্রুত ও সচল গতিতে এটা বের করে আনলো।
তাৎক্ষণিক-ভাবে তড়িৎ গতিতে ধারালো ধাতব কিছু আমাকে আক্রমণ করলো। এবং আমার দুনিয়াটা পুরোটাই ব্যথা ও অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
*****
আমি প্রায় পর্বতের শীর্ষে চলে এসেছি। বড় পাথরের চাই টা আস্তে আস্তে নজরে আসছে। একটু আগে যে জায়গাটা থেকে জেগেছিলাম সেখানেই পৌছুলাম আবার। শুয়ে পড়লাম। জানিনা এরপর আর কী করতে হবে!
আমার জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত গুলো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এলেনা – তার নির্দোষ সৌন্দর্য, তার ছন্দময়ী হাসি, তার ভরসা-জনক ভালবাসা এবং তার অমার্জনীয় বিশ্বাসঘাতকতা। আমার দৃষ্টিসীমা ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছিল, এলেনার মৃত্যুর আগের শেষ কথাটা শুধু মনে পড়ছে – ‘কিন্তু! আমি তোমাকে মেরে ফেলেছিলাম।’
মৃত্যুটা সহজ ছিল; মৃত থাকাটা এতটা সহজ না।
মূল লিখা - ANANGSHA
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:১৫