আমার আর সঞ্জুর ভালোবাসার সম্পর্কটা একেবারে ধর-ফরিয়ে মরে গেলো।তাও ভালো ধুঁকেধুঁকেতো মরতে হয়নি ! বেঁচে উঠার একটা আশা তখন কী বিশ্রী রকম দলা বেঁধে থাকত। সে ভোগান্তি ছাড়া আর অন্য কি ! অবশ্য এর চেয়ে ভালো শুনায় “আমার ভালোবাসা একদিন দুপুরে টুক করে মরে গেল”। টুক করে শব্দটাতে কোন ভয়াবহতা নেই। সহজাত একটা নমনীয়তা থাকুক মেনে নেয়ার শব্দগুলোতে ।
এমন ছুটির হলুদ বিকেলগুলোতে বারান্দায় সঞ্জু আমার পা তার কোলে তুলে নিত । কখনো আমি ওর চুলে বিলি কেটে দিতাম । স্নিগ্ধ কিছু খুনসুটিতে আমাদের বিকেলটা কখন সন্ধ্যা হয়ে যেত টেরই পেতাম না। রাতের খাবার খেয়ে সে যখন যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতো আমার মনের সমস্ত মমতা দিয়ে আমি তাকে একটা ছোট চুমু খেতাম । সেও নিজের ফ্লাটে যেতে না যেতেই আবার ফোন করে বলতো আমার জন্য তার খারাপ লাগছে ।
ভালোবাসা অনেকটাই কৃতজ্ঞতা ।আমার প্রতি সঞ্জুর এমন উচাটন টান আর নির্ভরতাই আমাকে তার প্রতি অনুরক্ত রেখেছিল। বাড়িয়েছিল প্রেম । এছাড়া অন্য কোন কারণ আমি দেখিনি । দশ-বছরে এই প্রেম গেঁথে গিয়েছিল আমার মজ্জায় ।সঞ্জু ! সঞ্জু আমার পোষ্য, আমার প্রেমিক ,আমার পায়েপায়ে ঘুরা অবোধ শিশু। বাজে শোনালেও আমাদের বয়সের ব্যবধান আর সঞ্জুর প্রতি আমার স্নেহ হয়তো আমাকে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । কিন্তু নির্ভরতা কেন এলো ?না সেটাতো আজন্ম শিখিনি ।
দশ বছরের ধর্মও সমাজের বাইরে একটা অলিখিত সম্পর্কে আমার দীক্ষাই আমি সঞ্জুকে দিয়েছিলাম । তাইতো আপাদমস্তক সে হয়ে উঠেছে একটি সৎমূর্তি । যতটুকু সৎ তা নিয়ে সে আমাকে দশ বছর আগের এক সন্ধ্যায় বলেছিল, আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি -রোজারিও। আবার ঠিক ততটুকু সততা নিয়েই কিছুদিন আগের এক-ক্লান্ত দুপুরে সে বলল, আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না-রোজ । ভালোবাসি একজন আত্মীয়ের মতো বন্ধুর মতো। প্রেমিকার মতো নয়।
এখন নাকি রুনাকে ওর বেশ ভালোলাগতে শুরু করেছে। রুনার চোখের রঙ নাকি আমার মতোই বাদামী। পঁয়ত্রিশে আমি যেমন দেখতে ছিলাম সে নাকি তারই প্রতিচ্ছবি, আমার মতোই রুনাও নাকি কবিতা লেখে। আর সব চেয়ে বড় মিল হচ্ছে সঞ্জুকে বেশ সজীবতা দিতে জানে।
একটু আসছি বলে আমি পাশের ঘরের আয়নায় দাঁড়িয়েছিলাম । ওর দোষ নেই। এখন আমি পঁয়তাল্লিশ আর সে ত্রিশ। আমাদের দুজনের বর্তমানটুকু আসলে শেষ। আমি অই ঘরে ফিরে গিয়ে সঞ্জুর সততার সমান অসততা নিয়ে উৎফুল্লে ফেটে পড়েছিলাম । বলেছিলাম, “তুমি বরাবর ভাগ্যবান। আশা করছি রুনার সাথে তোমার সময় খুব ভালো যাবে”। যাবার সময় সে আমাকে একটা অপরাধ বোধহীণ স্বচ্ছ ও সাবলীল চুমু খেয়েছিল । আমি আগের মতো মমতা আনতে পারিনি । নিজের ভেতরের স্বার্থপর, ক্ষুদ্র ও প্রাগৈতিহাসিক মানুষটাকে আমি সেদিনই দেখলাম। কি-আশ্চর্য ! যাকে কিনা আমি ধরেধরে আধুনিকতার মন্ত্রগুলো শিখিয়েছিলাম তার কাছেই কিনা আমি গোপনে হেরে গেছি!
এরপর গাজীপুর ফরেস্ট অফিসে আমি বদলী হয়ে আসার পর থেকে আরো নিষঙ্গ হয়ে পড়ি । রুটিন কাজের চাপ নেই । রাত হতে নাহতেই ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাকে স্মৃতি উস্কে উঠে। ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে বহুকাল আগের আমার ক্ষণস্থায়ী সংসার আর ডেভিডের কথা। যাকে আমি ছেড়ে এসেছিলাম । কিন্তু বিগত দশ বছরই যেন আমার সমগ্র জীবনের স্মৃতি দখল করে থাকে। কখনো প্রেমে ,কখনো স্নেহে ,কখনো ভালোবাসায় মনটা সঞ্জুর জন্য কেঁদে মরে ।
আমি সঞ্জুকে রুনাকে সহই এখানে আসার নিমন্ত্রণ পাঠাই। আবার তার এখানে আসা যাওয়া নিয়মিত হয়।খুশি হই ,তাকে দেখতেতো পাচ্ছি । মাঝেমাঝে সে রুনাকে নিয়ে আসে। মাঝেমাঝে একা ।আমরা তখন হাত ধরে হেঁটেহেঁটে ইউক্যালিপটাস বনের শেষ মাথায় চলে যাই। সে অনর্গল রুনার কথা বলতে থাকে।
আর সবকিছুর মতো ভালোবাসার মৃত্যুও তার পরবর্তী রূপান্তর মেনে নেয়াই সভ্যতা। আমিও একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে শেষ দীক্ষাটা নিয়ে নিয়েছি। মেনে নেয়ার ভান করা।
ডিসকভারী চ্যানেল এর একটা অনুষ্ঠানে দেখানো একটি বাস্তব জবানবন্দি থেকে অনুপ্রাণিত
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০১