somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"মৃত্যু"- গল্প নয় সত্যি

১১ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেদিন ছিল বুধবার। প্রতিদিনের মতো সূর্য উদয়ের মধ্যদিয়ে দিনের সূচনা হলো। কিন্তু আজ অতো সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয়নি। কখন যে পুবাকাশে সূর্যটা উকি দিয়ে সিনেটা টানটান করে দাড়িয়ে ওঠেছে তা আজ টেরই পায়নি রাহাত। আজকে কোনো টেনশন নেই। পড়া-শোনার ঝামেলা একদম নেই। কারণ, গতকাল শেষ হয়ে গেলো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা । কিন্তু যখন ঘুম থেকে ওঠে রাহাত দেখতে পেলো সূর্যমামা তাকে ঘুমন্ত রেখে অনেক আগেই সে জেগে ওঠেছে তখন বড্ড খারাপ লাগলো তার। কারণ, অনেক কাজ পড়ে আছে যে। রাহাত তাড়াহুড়া করে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এরপর অনেক দিন ধরে জমে থাকা টুকিটাকি কিছু কাজ সেরে নিলো সে। এ ভাবে দুপুর হয়ে এলো। আর মন বসছেনা ঘরে। যে করেই সোজা গিয়ে হাজির হলো সুহিনদের বাড়িতে।
রাহাত-সুহিনের সম্পর্ক মামা-ভাগ্নে, প্লাস পরম বন্ধুত্বের বন্ধন। মামা ভাগ্নে সম্পর্কটার চেয়ে বন্ধুত্ব সম্পর্কটাই গড়ে ওঠেছে চরমভাবে। মামার বয়স যখন চৌদ্দ কী পনেরো আর ভাগ্নের এগারো-বারো তখন থেকে তিল তিল করে গড়ে ওঠেছে এই হৃদ্যতা। ধীরে ধীরে দিন যাচ্ছিলো আর এসম্পর্কটাও যেনো আরো গভীর থেকে গভীরত্বে পৌচ্ছে যাচ্ছিলো। যে কোনো আনন্দ-উৎসবে মামা-ভাগ্নের যুগল আনাটাগোনা ছিলো একটা কম্বলসারি বিষয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছেও তাদের এই সম্পর্কটা মাঝে মাঝে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠতো।
সুহিন আজ দশম শ্রেণীর ছাত্র। আর মামার শেষ হলো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। এতোদিন মামা রাহাত পরীক্ষার পড়ার চাপে সময় পায়নি ভাগ্নের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপের। প্রায় মাসখানিক সময়ের জমানো কথাগুলো স্তূপাকৃতি ধারণ করে আছে মামার হৃদয় হার্ডডিস্কে।
বর্ষা মৌসুম আসন্ন। মাঝখানে ছোট্ট নদীটি বাঁধ সেধেছে। বর্ষার জলে পূর্ণ হয়ে বড়োসড়ো হতে শুরু করেছে নদীটি। ছোট একটি নৌকা বেয়ে রাহাত তার কাঙ্খিত ভাগ্নের সমীপে হাজির হলো। আজ টিফিন আওয়ারে বাড়িতে ফিরেছে সুহিন। তাই অমন সময় ওকে পাওয়া গেলো। বন্ধু-মামাটিকে দূর থেকে দেখেই মুসকি মুসকি হাসিতে স্বাগত জানালো সুহিন। এক পর্যায় কুশলাদি বিনিময়ের পর মামা-ভাগ্নে বেরিয়ে পড়লো।
আজ অন্যসব দিনের মতো সুহিনকে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু রাহাত সেদিকে তেমন একটা ভাবলো না। এতোদিন পেটে জমে থাকা কথার ঝুড়ি খুলতে লাগলো রাহাত। ওদিকে সুহিনের কোনো প্রকার মনোযোগ বা আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা রাহাতের কথার প্রতি। ও শুধু রাহাতের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে কিন্তু তার কোনো উত্তর বা প্রত্যুত্তর করছেনা। শুধু হু,হ্যাঁ করে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। কিন্তু রাহাত কিছুতেই জানতোনা যে, আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঘটতে যাচ্ছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। খোলা আকাশের নীচে মেঠু পখ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ওরা। ডানে-বামে পাকা ধানের ক্ষেত। দু’এক পষলা বৃষ্টি নেমে এলো আকাশ থেকে। বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে নিকটস্থ একটি বাতান ঘরে আশ্রয় নিলো মামা-ভাগ্নে। মামাটা গ্রাম্য গীতিকা তথা লোকজ-সঙ্গীত-প্রিয় কিন্তু তার ভাগ্নেটা কিন্তু উল্টো অর্থাৎ আধুনিক সংস্কার ব্যন্ড সঙ্গীতের ভক্ত। আশ্চর্য বিষয়, আজ ঘটলো এর বিপরীত ঘটনা। সুহিনের কণ্ঠ বেয়ে বেরোচ্ছে লোকজ সঙ্গীতের এক মরমী ব্যতীক্রমধর্মী সুর; যে সুর রাহাত কখনোই সুহিনের কণ্ঠে এর আগে শুনেনি। গানটি ছিলো___ “পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো ভাই ঘরের মালিক নই… ’’ রাহাত হু হু করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো।
: কি রে! তোর মাথা-মুণ্ড ঠিক আছে তো! ওসব গান তোর গলায়…?
রাহাত হাসতে হাসতে কুটি কুটি। কিন্তু সুহিন এতটুকুও বিচলিত হলোনা বরঞ্চ তার সুরের মূর্ছনা আরো ছড়িয়ে গেলো।
ওরা বেরিয়ে এলো বাতান ঘর থেকে আবার খোলা আকাশের নীচে। নদীর তীর ধরে হাটতে হাটতে ভিড়ানো একটি নৌকায় ওঠে বসলো রাহাত আর সুহিন। পড়ন্ত বিকেল। সুহিনের মা নদীর ওধার থেকে ওকে ডাকছে। সে ডাক শুনে সুহিন বলল …
: যাইরে !
সুহিন চলে গেলো। রাহাত কিছুক্ষণ চেযে থেকে এক পর্যায় বাড়ি ফিরে এলো। কিছুই ভালো লাগছিলোনা রাহাতের। মামা রাহাতদের বাড়ি থেকে একটু উকি দিলেই সুহিনদের বাড়ি দেখা যায় পরিস্কারভাবে। বাড়ি ফিরে রাহাত কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিলোনা। হঠাত চোখ পড়লো সুহিনদের বাড়ির দিকে। কী ব্যাপার! এতো লোকের ছোটাছুটি কেনো সুহিনদের বাড়ির দিকে? আচমকা অস্থিরতা শুরু হলো রাহাতের মনে। সে তাড়াতাড়ি করে ছুটতে লাগলো ওদিকে। দূর থেকে শুধু দলে দলে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি দেখা যাচ্ছে। রাহাতে ওপারে পৌছতে না পৌতেই কে যেনো বলে ওঠলো__
: সুহিন নেই !
: না… !!! বলে চিতকার করে আকাশ বাতাস কাপিয়ে শত মানুষের ভীড় ঠেলে রাহাত সুহিনের পাশে গিয়ে দাড়ালো। এ কি দৃশ্য ! এ কি দৃশ্য সে চেয়ে দেখছে! না, অসম্ভব! এ- হতে পারে না…!
:তোমরা মিথ্যে বলছো, কে বলেছে সুহিন নেই, সুহিন মরে গেছে? তোমরা দেখো ও ঘুমিয়ে পড়েছে… ঘুমিয়ে…।
রাহাতের এই আবোলতাবোল কথাবার্তা কেউ শুনতে পায়না।
তার নৈঃশব্দ, বাকশূণ্য-অশ্রুহীন কান্না কেউ দেখতে পায়না। কীভাবে সে বিশ্বাস করে সুহিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। খানিকক্ষণ পূর্বেও যে ওরা খুব কাছাকাছি ছিলো।
: তাহলে কী সুহিন রাহাতেকে ধোকা দিয়ে চলে গেলো, নাকি ও বলে কয়েই বিদায় নিয়েছিলো? রাহাতের মনে পড়ে যায় বাতান ঘরে বসে সুহিন যে গানটি তাকে শুনিয়েছিলো।
: তাহলে কী সুহিন মৃত্যুর আগে পূর্বাভাস পেয়েছিলো যে, এ পৃথিবী নশ্বর, অহেতুক, অযথা-নীরর্থক, সে চলে যাচ্ছে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে?
রাহাতের এই দগ্ধ প্রশ্নগুলো বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে তারই কানের কাছে বাজতে থাকে বিকট আওয়াজে। তিল তিল করে গড়ে ওঠা হৃদ্যতা ঝড়ের বেগে ম্লান হয়ে গেলো নিমিষে। বিদ্যুত স্পৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো সুহিন। এতো গভীর ভালোবাসা, এতো নিবিড় অন্তরঙ্গতা, এতো হৃদয়স্পর্শী মায়ার বাঁধন;সব, সব শেষ হয়ে গেলো! অবোঝ, হতভাগা মামা কিছুই বুঝতে পারলোনা। এতকাছে থেকেও বুঝতে পারলোনা ওই গানের মর্মার্থ কী ছিলো। এ যেনো তারই ব্যর্থতা, এ যেনো তার গ্লানী। রাহাতের এলোমেলো বিক্ষিপ্ত আহাজারি। কেউ শুনেনা তার আকুলাতা, তার আকুতি। কেউ দেখেনা তার হৃদয়ের উত্তপ্ত বহ্নিশিখা, অগ্নিকাণ্ডা।
সমস্ত সুখ-বারতা বিধ্বস্ত হয়ে গেলো বিধির লীলায়,নিষ্ঠুরভাবে। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্য,সকল উৎকৃষ্টতা রাহাতের দু’চোখে অহেতুক। এই পৃথিবীর সকল বন্ধন তার কাছে ছলনা আর প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। কেউ যদি তাকে খুব করে ধরে জিজ্ঞেস করে…. পৃথিবীর সকল কথার সত্য কথাটি কি বা কোনটি। সে অকপটে উত্তর দেয়__ “মৃত্যৃ’’। তাকে যদি বলা হয়__ মায়াময় ছায়াঘেরা এ ধরিত্রীর কোন সৌন্দর্যটি তাকে সব চেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তার উত্তর__ “কেনো মৃত্যু’’। তাকে ফের প্রশ্ন করা হয়, একটি শেষ উচ্চারণ করতে,তার কণ্ঠ নিঃসৃত হয়ে যে উচ্চারণটি বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করে সেটি হলো__ মৃত্যু!মৃত্যু!মৃত্যু!মৃত্যু!মৃত্যু!......!!!!

মো. ফারুক হোসেন
দুবাই ইনভেস্টম্যান্ট পার্ক,সংযুক্ত আরব আমিরাত
১১/০৬/২০২০ ইং

কিছু কথাঃ আজ থেকে ২৩টি বছর পূর্বে ১৯৯৭ সাল, ১১ জুন; ঠিক আজকের দিনে ঘটে ছিলো এই মর্মান্তিক ঘটনা। মূলত এটি কোনো গল্প নয় একটি বাস্তব ঘটনা। গল্পে রাহাতের ভূমিকায় ছিলাম আমি ফারুক হোসেন। জানি না সুহিন কেমন আছিস, আমি তোর সেই হতভাগা মামা আজো বেঁচে আছি সেদিনের শোকার্থ হৃদয় নিয়ে। সুহিন,তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্ব বাটপারের খপ্পরে বাংলাদেশ ‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১:০৯



একমাত্র ব্যক্তি শেখ হাসিনা সঠিক ভাবে চিনেছেন এই বাটপার’কে। তার নিজের জবানবন্দিতে আছে । তিনি কিশোর বয়সে কিভাবে অন‍্যের পুরস্কার চতুরতার সাথে আত্মসাৎ করেছেন ‼️ তার নাটকের নতুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ তার সাথে দেখা হবে কবে (২য় পর্ব)

লিখেছেন সামিয়া, ২৪ শে মে, ২০২৫ দুপুর ২:০৪




এই শপিংমলটা অনেক বড়, এইখানে সাধারণ মানুষের তুলনায় শহরের সবচেয়ে অভিজাত পরিবারের লোকজন আর বিদেশী কাস্টমার নিয়মিত আসেন কেনাকাটা করতে। আউটলেটগুলো একটা থেকে আরেকটা আলাদা কোনটায় পারফিউম, কোনটা ক্লথ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহাম্মদ ইউনূসকে একঘরে করে দিন

লিখেছেন sabbir2cool, ২৪ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৭


জুলাই ষড়যন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। গত বছরের জুলাইয়ের মেটিকুলাস ডিজাইনড প্ল্যানে দেশবিরোধী যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সেটার অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। দখলদার ইউনূস সরকার প্রবল চাপে পড়েছে। এখন তাদের সব কূল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না : ড. ইউনূসের মনে কেন এমন আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৯


দৈনিক সমকাল থেকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর বরাতে আমরা জানতে পারি —প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই—নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এক গভীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার নাই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৪ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৩

একটা পোস্ট দেখে লেখার সাধ জাগলো। যা নিয়ে লিখবো তা আমার নেই।
আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি কেউ নেই। বাবা মা যখন ছোট ছিলেন তখনই তারা পরপারে উড়াল দিয়েছেন। বাবার বয়স যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×