সেই রাতটা আর দশটা রাতের মতই তো ছিল। শান্ত, নিস্তব্ধ। আর সব রাতের মতই, আর দশটা সাধারন বাঙালী পরিবারের মতই ঘুমিয়ে ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় একটি বাঙালী পরিবার। ঘুমিয়ে ছিলেন একজন কাজে অসাধারন অথচ চলনে সাধারন একজন মহামানুষ। আর দশদিনের মতই রাতের খাবার খেয়ে, পারিবারিক বৈঠকে হাসি ঠাট্টা করে, ছেলে, বউ, বাবা,মা নাতি মিলে সময় কাটিয়ে শান্তির ঘুমে ঘুমিয়েছিলেন ওই বাড়ির বাসিন্দারা।
সেই রাতে হয়ত ঘুমুবার আগে শিশু রাসেলকে রাক্ষস দানবের গল্প শুনিয়েছিলেন তার মা, ভয়ে হয়ত আতঁকে কেপেঁ কেপেঁ উঠেছিল রাসেল। জানতও না একটু পরেই তার জীবনে দানবেরা হানা দিচ্ছে।
দানবেরা এল।
এই দেশটা দানবেদের দখলেই ছিল। মানুষের দুঃখদুর্দশার সীমাপরিসীমা ছিল না। পরাধীনতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল জনপদটাকে। একটি মানুষ অদম্য সাহসিকতায়, বিপুল মহত্বতায়, পরম মায়ায় দেশের মানুষগুলোকে আগলে রেখে দেশটাকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিলেন। প্রতিদানে কি পেলেন? সেই রাতটা। হায়! এই কষ্ট কোথায় রাখি। কোথায় রাখি।
নিচের তলার ঘরে যখন দানবেদের ক্রুর শব্দ, তখন উপরে ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অস্থির পায়চারি। বঙ্গবন্ধু হয়ত তখন তাকে সান্তনা দিচ্ছেন, 'কিচ্ছু হবে না। এটা আমার দেশ। আমাদের দেশ। এ দেশের মানুষ আমার মানুষ।'
ছেলে গেল নিচে। কুৎসিত দানবেরা তাকে গুলি করল। হতভম্ভ ছেলে বলতে চাইল, আপনারা ভুল করছেন। আমি আপনাদের প্রিয় নেতার ছেলে। দানবেরা তার বুকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করল। উপর থেকে সেই শব্দ শুনে তখন কি ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু? এ দেশটায় তার সাথে এমন হবে! কেন?
একটা সময় উপরে উঠে এল এরা। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরল। তার মনে তখন কি ছিল- এরা কি চায়? কথা বলতে নিচের দিকে যেতেই সিড়ির মাঝে তাকে গুলি করল ঘাতকেরা। ফজিলুতান্নেসাকে আনা হল, তিনি তার স্বামীর লাশ দেখলেন। সেই স্বামী, যার দেখাই তিনি পেতেন না তার স্বামী দেশের জন্য ছুটতেন বলে, দেশের কথা বলে মামলা, জেল হয়রানীতে থাকবেন বলে, দেশটাকে স্বাধীন করতে কত কিছু করেছেন লোকটা আর তার স্ত্রী হিসেবে সেই সব হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন তিনি, আজ নিজ দেশে স্বামীর লাশ।
তাকেও মারল ঘাতকেরা। তারপর একে একে সবাই। শিশু রাসেলের গল্পের দানব বাস্তবে এসে গেল। ভয়ে কাতর শিশুর কম্পমান কন্ঠ' আমায় মারবে না তো!' অবোধ শিশুও নিস্তার পেল না হানাদারের নিষ্ঠুরতা থেকে। সবাই শেষ। একটা দেশের মুক্তিদাতা ও তার পরিবার।
কতটা দুর্ভাগ্য আমাদের। কতটা অভাগা জাতি আমরা যে ১৫ আগষ্ট আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেল। আমরা কিছুই করলাম না। কতটা অকৃতজ্ঞ আমরা, হত্যাকান্ডের ২১ বছর পরে এ হত্যার মামলা দায়ের হয়। একটা গরুকে কেউ মারলেও দেশে মামলা হয়। অথচ জাতির স্থপতির পুরো পরিবারকে হত্যা করে ফেলল কতিপয় জারজ, সেই মামলা হয় না। ২১ বছর পরে হলেও, এখনও হত্যাকারীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। বিদেশেই হোক, বেচে থাকে মানুষের মত। যা তাদের প্রাপ্য নয়।
ওই সব জারজদের। তাদের জারজ ছাড়া কিছু বলব না, এই দেশে এরা জারজই, এদের খুজে বের করে ...
মানুষকে আমি ঘৃনা করতে পারি না। অনেক খুজে দেখেছি, আমি আসলে ঘৃরা করতে জানি না। তবু শুধু একটা রঙের পোষাক পড়া প্রায় সকল মানষের প্রতি আমার জন্মের ঘৃনা। এরা তো মানুষও নয়। জলপাই রঙাদের আমি মানুষও বলি না। জানি সবাই সমান নয়। জলপাইদের মাঝেও সবাই দানব নয়। কিন্তু ওই রাতের জন্য আমার মনে জলপাইদের প্রতি আজন্ম ঘৃনা জন্মে গেছে। এখন তাদের কাউকে দেখলেই থুথু দিতে ইচ্ছে করে।
মাথাটা ভীষন এলোমেলো। কিছু চিন্তা করতে পারছি না। চোখটা বাড়ে বাড়ে ঝাপসা হয়ে আসে। জানি না কি লিখছি। এই লেখাটা শুধুই ঘৃনার আর ক্ষোভের। শোকের না মোটেও। ঘৃনা ওইসব জারজদের জন্য। ঘৃনা। যতটা ঘৃনা একজন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব। যতটা ঘৃনা করলে কেউ ধ্বংশ হয়ে যায়।
এরা ধ্বংশ হোক।
এই লেখাটি গতবছর একই দিনে পোষ্ট করা একটি লেখা। রিপোষ্ট করতে ইচ্ছে হল।