সাকিব আল হাসান।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নবতম এক বিষ্ময় এর নাম।
বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমে প্রায়ই ক্রিকেট প্রতিভার দেখা পাই আমরা। তাদের প্রতিভার ঝলকানীতে স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে দলের সমর্থকরা, পড়ে সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বড় তেতো লাগে। কোন কোন সময় সেই তেতো স্বাদের তোপটা যায় খেলোয়ারের উপর কোন সময় কোচের উপর আবার কোন সময় ম্যানেজমেন্ট বা বোর্ডের উপর কিবা বলা যেতে পারে নির্বাচকের উপর।
চিহ্ণিত প্রতিভাধর খেলোয়ার মাঝে মাঝে পারফর্ম করতে পারেন না লাগাতার। কখনও বা নির্বাচকদের উদাসীনতায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুযোগই পান না। এই চক্রে দেশে প্রতিভার ঝলকানীর সরুপ দেশবাসীর ভাগ্যে খুব বেশী সময় জোটে নি।
সেই বুলবুল আকরামদের যুগে প্রতিভাধর ছিলেন আতহার আলী খান। তার ঝলাকানী বয়সের ভাড়ে ক্রিকেট মাঠে অনুদিত হবার সময় পায়নি। পরবর্তী দেশের ক্রিকেট জাগরন যুগে আল শাহরিয়ার রোকনকে ধরা হত ততকালীন সবচাইতে প্রতিভাধর ক্রিকেটার। তার ব্যাটিং এর স্ট্রোক এর বাহারী রুপ দেশের বাকী ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে খুব বেশী পাওয়া যেত না। সেই রোকন খুব বেশী দুর যেতে পারলেন না। জাতীয় দলের হয়ে তার পারফরমেন্স প্রতিভার যোগ্য সাক্ষর রাখল না। নির্বাচকরাও তাকে ডানা মেলার তেমন সুযোগ দিলেন না। দেশের নির্বাচকদের উপর সবসময়ই অভিযোগ, তারা খামখেয়ালী, দলের প্লেয়ারদের নিয়ে তাদের পরিক্ল্পনা অস্থিরতায় ভুগে সবসময়।
পরবর্তী সময়ে আরও কিছু প্রতিভাধর খেলোয়ার নামে পরিচিত খেলোয়ার আমরা পেয়েছি। মেহরাব হোসেন অপি স্ট্রোক মাঠে দর্শক টেনে আনত, সেই অপি ব্যাক্তিগত জীবনে এতই মশগুল হলেন যে ক্রিকেট দর্শক তাকে পেলেন না। এরপর অলক কাপালী, তার কথা তো আমাদের মনে এখনও আছে, দলে থাকার দৌড়ে তিনি এখনও আছেন। কিন্তু প্রতিভার যোগ্য পারফরমেন্স আমরা দেখলাম কই। তার প্রতি সহানুভুতি দেখানো যায় যে তিনি ওত সুযোগ পান নি। দলে তার জায়গা নিয়ে নির্বাচকরা রীতিমত ছেলেখেলা করেছেন।
বোলার হিসেবে দেশের সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান মাশরাফি মাঠেও তার সাক্ষর নিয়মিতই রাখেন, কিন্তু ইনজুরি তাকে প্রায়ই বাইরে রাখে। প্রতিভাধরদের মধ্যে তিনিই পারফর্ম করেন নিয়মিত এবং নির্বাচকদের খামখেয়ালীতে পড়েননি।
হালের আশরাফুলকে দেখেন। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম ইনিংস খেলার পরই অতি অপরিচীত আশরাফুল হয়ে গেলেন সবার আশা আকাংখার প্রতীক। এবং সবার মতে দেশের ইতিহাসের সব চাইতে প্রতিভাধর ব্যাটসম্যানদের অন্যতম। কিন্তু তার কাহিনীটাও হতাশার। তার উপর ভরসা করার ভুল এখন দর্শকরা আর করতে যান না। তবে নিতি নির্বাচকদের থেকে ভালই সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তবুও তার এই পরিনতি কেন?
অনেকেই ধারনা করেন, খুবই অল্প বয়সে আশরাফুলের উপর বেশী আশা করে তাকে প্রচন্ড চাপে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এরপর তাকে হুট করে অধিনায়ক করে করা হয়েছে তার সর্বশেষ চুড়ান্ত সর্বনাস।
তার পারফর্মেন্স এর গ্রাফ দেখলেই এটা পরিস্কার। তাকে অধিনায়ক করার পর তার স্বাভাবিক ব্যাটিং কোথায় যে হারিয়েছিল। অধিনায়কত্ব হারানোর পর গত দুই সিরিজে অসাধারন ব্যাটিং করে যাচ্ছেন তিনি।
শুধু দেশের আশরাফুল কেন, বিদেশেও যদি চোখ দেয়া যায়, দলের প্রতিভাধর আর সেরা ব্যাটসম্যানদের অধিনায়ক করার পর পরিনতির দিকে তাকালে আমাদের সামনে সহজ উদাহরন আসে টেন্ডুলকার এর। বর্তমান বিশ্বের সন্দেহাতীতভাবে সেরা এই ব্যাটসম্যানকে অধিনায়ক করে তার ব্যাটিং এর চুড়ান্ত সর্বনাস প্রায় করেই ফেলা হয়েছিল। শেষে তিনি নিজেই এই চাপের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবার পর তার ব্যাটিং আবার ঝলসিয়ে উঠে।
বাংলাদেশ দলে আমরা এখন পেয়েছি সাকিব আল হাসান কে। যাকে প্রথম দেখায় কেউ রোকন, অলক বা আশরাফুলদের দলে ফেলেনি। কিন্তু মাঠে পারফর্মমেন্স করে তিনি তার জাত চিনিয়েছেন। এখন তার ব্যাটিং দেখলে তাকে দেশের অন্যতম প্রতিভাধর ব্যাটসম্যান মনে হতেই পারে। তার পরিমিত কিন্তু বিধ্বংসী ব্যাটিং দেখে মনে হয় তিনি যেন অনেক বছর ধরে আন্তর্জতিক ক্রিকেট খেলছেন। বাংলাদেশ দলে এক্সট্রা অর্ডিনারী ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে যা হয়, নিয়মিত পারফর্মেন্স করতে না পারা, সাকিব এর ক্ষেত্রে সেটির কোন দেখাই নেই। নিয়মিতই তিনি ভাল খেলে যাচ্ছেন। ক্রিকেট র্যাংকিং এ বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার তো আগেই হয়েছেন, এখন তার পয়েন্টকে এতদুর নিয়ে যাচ্ছেন যে তাকে ধরা তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দির পক্ষে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। কি টেষ্ট কি ওয়ানডে বড় বড় ইনিংস খেলছেন সাবলীল ভাবে। আর তার বোলিং দলের আশার প্রতীক। একই সাথে একটি দলের প্রধান ভরসার ব্যাটসম্যান আর প্রধান ভরসার বোলার হয়ে গেছেন সাকিব আল হাসান। এমন জেনুইন অলরাউন্ডার বিশ্বে বিরল। বিশ্বের আর কোন দলে কাউকে একই সাথে দলের সেরা ব্যাটসম্যান আর অন্যতম সেরা বোলার বলা যায় কিনা খুজলে পাওয়া যাবে না সাকিব ছাড়া। আমরা মনে করতে পারি অনেককাল আগে নেইল জনসন নামে জিম্বাবুয়ের একজন খেলোয়ার এরকম ছিলেন।
আশরাফুলকে পদচ্যুত করার পরে মাশরাফি দলের ক্যাপ্টেন। কিন্তু তার দীর্ঘমেয়াদী ইনজুরির কারনে দলের সেরা প্রতিভাধর ও পারফরর্মার সাকিবের হাতে উঠেছে অধিনায়কত্ব। তিনি তার কাজও করে যাচ্ছেন সাবলীল ভাবে। দলের সবচেয়ে ভাল খেলে যাচ্ছেন তিনি ম্যাচের পর ম্যাচ। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমর্থকদের কারো কারো মনে স্বপ্ন জাগছে তিনিই কেন নিয়মিত অধিনায়ক হচ্ছেন না।
ঠিক এখানেই আমরা বড় একটা ভুল চিন্তার দোড়গড়ায়। সাকিব হাসান, আমাদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ও অন্যতম সেরা বোলার, তাকে অধিনায়ক করে তার উপর অতিরিক্ত প্রেসার দিয়ে আমরা যদি তার পারফর্মেন্স এর উপর প্রভাব ফেলে দিই তা দলের জন্য আত্মঘাতী হয়ে যাবে। আমাদের সামনে আশরাফুলের উদাহরন থেকে গেছে।
তাই আমাদের উচিত সাকিবকে ক্যাপ্টেন করার চিন্তা থেকে সরে এসে তাকে তার মত খেলতে দেয়া স্বাধীন চাপমুক্ত ভাবে। তাহলেই তাতে দলের ভাল।