চোখ খুলতেই কিছুটা ঝাপসা দেখা শুরু হল! বুঝতে পারছে না সে এখন কোথায় আছে! খুব একটা মনে পরছে না কেন এখানে সে আর কি হয়েছে! কে ই বা তাকে এখানে এনেছে! কপালে ঝিরিঝিরি ব্যথা অনুভব হচ্ছে! দুটো আঙুল হালকা ছোয়া লাগাতেই বুঝতে পারলো গুরুতর কিছু আঘাত হয়তো পেয়েছে সে! চোখ জোড়া আরও একবার কচলে নিল। আস্তে আস্তে পরিবেশ স্বচ্ছ হওয়া শুরু হয়েছে! জানলার পাশের পর্দাটা ঝাপটে যাচ্ছে বাতাসে। আঙুলের দিকে তাকাতেই দেখে রক্ত লেগে আছে! হঠাৎ মনে হল একটা গাড়িতে ছিল সে! সাথে আরও কয়েকজন ছিল! বেড থেকে নেমে দারানোর চেষ্টা করল কিন্তু ভারসাম্য হারাচ্ছে বারবার! একটা আয়না দেখে কোনভাবে আয়নার সামনে দারালো। কিন্তু নিজেকে চিনতেই যেন খুব কষ্ট হচ্ছে! সারা হাতে মুখে কেমন আঘাতের দাগ! অবাক হয়ে নিজেকে দেখলো তানজিল! স্কার্ফ, ওড়না এসবও তো ছিল কিন্তু কোথায়? মেঝেতে পরে থাকা স্কার্ফ আর ওড়না তুলে নিল সে। রুমটা আরও একবার দেখলো। কয়েকটা প্যাকেট, বোতল, কয়েক জোড়া জেন্টস জুতা! নিজের ফোনটার কথা মনে পরছে না। ধীরে ধীরে মনে পরলো গতকাল বিকালের কথা! সাথে কাজল ছিল। বলেছিল বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিবে! তানজিল নিজেই মানা করেছিল তাকে। কাজল যাওয়ার পরই একটা অটোতে তাকে জোর করে উঠানো হয়! তারপর একটা গাড়িতে, সেখানে আরও কয়েকজন! তারপর হাতে কেমন যেন ব্যথা পেল তারপর আর মনে নেই! রুমের দরজাটাও হালকা খোলা! একটু গিয়ে গিয়ে দেখলো কয়েকজন ছেলে আছে এখানে! তাদের দেখে তানজিল দ্রুত রুমে ফেরত এল! ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো তার সাথে কি হয়েছে! চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগলো। রুমে কোনো বারান্দা নেই, শুধুমাত্র একটা দরজা আর জানালা! তানজিল নিঃশব্দে দরজা খোলার চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না! বারবার চেষ্টায় আওয়াজ পেয়ে দুইজন ছেলে জেগে উঠলো! তানজিল চিৎকার করে বলল, "আপনারা কারা?" একে একে সবাই জেগে গেল এবং সবাই মিলে তানজিলের হাত মুখ পেচিয়ে দিল! তানজিল কেঁদেই যাচ্ছে আর অস্পষ্ট আওয়াজে কাজলকে ডেকে যাচ্ছে! এত অসহায় আগে কখনও লাগে নি তার!
দুই দিনের ছুটিতে রাজীন চলে এল হাসপাতালে, এলাহি এবং বাকিদের দেখতে! রাজীন এলাহির পাশে এসে বলল, "কেমন লাগতেছে?"
এলাহি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, "তোর মতই লাগতেছে আমার!" রাজীন একটু কেশে নিল। আবার জিজ্ঞেস করলো, "তো কি অবস্থা? কয়মাস এখানে আর রেস্ট টাইম?" "আল্লাহর রহমতে সময়মত স্থানীয়রা হাসপাতালে পৌছে দিয়েছিল, না হলে যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছিল তাতে এতদিনে এলাহি মৃত! আর আজ বিশদিনের মত এখানে আছি! তবে একমাস বা এর অর্ধেক পর্যন্ত রেস্ট।" একে একে সাঈদ এবং হামিদের সাথে কথাবার্তা বলে নিল। এলাহি বললো, "পাশের কেবিনে কামাল স্যার আছেন, যা তার সাথেও দেখা করে আয়।"
রাজীন বলল, "হুম আজ কনস্টেবল বলে ভি আই পি ট্রিটমেন্ট পেলি না!" সাঈদ বলল, "আপনি তো একধাপ উপরে উঠে গেলেন স্পেশাল কেয়ারে হু?"
রাজীন সিলিংয়ের দিকে আঙুল তুলে বলল, "সবই উনার ইচ্ছা!" বের হয়ে কামালের কেবিনে নক করে ঢুকলো রাজীন। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে নিল। রাজীন বলল, "স্যার শুনলাম নার্সের কাছে, আপনাকে নিম্নে ছয় মাসের রেস্টে থাকতে বলেছে!!"
কামাল বলল, "দুই-তিনমাস এখানে আর তারপর জানি না! বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল!" "স্যার একটু উনিশ বিশ হলে মরে যেতেন! বেঁচে থাকাটা অনেক বড় নিয়ামত!"
কামাল হেসে বলল, "হ্যা... হয়তো! আমার বদলে আরেকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, জানো কে সে?" রাজীন না বলল৷ কামাল বলল, "মিস্টার জামশেদ! চেনো তাকে?" "না স্যার!"
"হাওলাদার তাকে এনেছে। আহহহ...!" রাজীন দারিয়ে গেল কারণ দুইজন সিনিয়র অফিসার এসে পরলো, "ওসি কামাল, কি অবস্থা? কিছু রেকর্ড করতে পারি?"
"আরে স্যার কি যে বলেন! রাজীন চেয়ারগুলো এগিয়ে দাও।" একজন বলল, "ওহ হো তুমিই রাজীন?"
"স্যার!"
"সুপার স্যার তোমার গুনগান করেছেন আমাদের কাছে! খুব শীঘ্রই তুমি একটা সুসংবাদ পাবে।" শুনে রাজীন কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেল! জিজ্ঞেস করলো, "কেমন স্যার?" আরেকজন বলল, "সেটা নিজ চোখেই দেখে নিও সময় হলে? আচ্ছা তুমি বাইরে যাও! আমরা আমাদের কাজ সেরে ফেলি।"
"শিওর স্যার, স্যার!" সালাম দিয়ে রাজীন বের হয়ে গেল।
আরাফ ওসি জামশেদের অপেক্ষায় বাইরে বসে আছেন। তানজিল নিখোঁজ হওয়ার আজ দুইমাস হল। প্রতিদিনই আরাফ থানায় আসেন তানজিলের খোঁজ নেয়ার জন্য কিন্তু উনার বারবার আগমণে জামশেদ বেশ বিরক্ত! আরাফ দেখলেন জামশেদের জীপ থানায় ঢুকেছে! অসহায় এর মত দারিয়ে গেলেন। এগিয়ে যাবেন কিন্তু জামশেদ উনাকে থামিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেলেন! এটা তার কাছে পুরোনো এখন। একজন কনস্টেবল এসে আরাফকে ভিতরে যেতে বলল। উনি প্রবেশের সাথে সাথে জামশেদ বললেন, "আরে আপনি যে! আপনাকে তো এখন থানার আশপাশের কুকুর বিড়ালও চিনে গেছে! আপনি জানেন, এখানে সবার আগে আমি কাকে মনে রেখেছি? সেটা হলেন আপনি! যাই হোক, বসেন।"
আরাফ সেই পুরোনো প্রশ্ন তুললেন, "স্যার আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ পেলেন? দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে!"
জামশেদ চেয়ার এগিয়ে বললেন, "আরাফ সাহেব, আমাদের এই এলাকা ছোট্ট নয়, এরচেয়ে বড় আমাদের জেলা! তারচেয়ে বড় বিভাগ আর তারপরেই দেশ! আমরা আমাদের মত চেষ্টা করছি, যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে! এমনও হতে পারে আপনি যা ভাবেন নি সেটা! পালিয়ে যাওয়া, কিংবা অন্য কিছু! দেখেন দেখেন, আমি কিছু জানা মাত্রই আপনাকে জানাবো। আমাকে আমার কাজটুকু করতে দিন, আজ আসেন আপনি।"
এমন সময় কনস্টেবল হাকিম রুমে প্রবেশ করে বলল, "স্যার, তানজিল কেসের কল লিস্ট চলে এসেছে। নিন!"
"বাহ! দেখেছেন ভাগ্যের কি লীলাখেলা? লিস্টও হাজির, আপনিও আমার সামনে!" জামশেদ লিস্টটা খুলে দেখতে শুরু করলো৷ পরে বলল, "আরাফ সাহেব, আপনার নম্বরটা বলেন তো।"
আরাফ নম্বর বলল। জামশেদ খুজে খুজে বললেন, "আপনার উপর তানজিল কি রাগ করেছিল নাকি? লিস্টে আপনার নাম নম্বর দুই একবারই দেখা যাচ্ছে! এই, এস আই হারুন, রহিম আর হাকিম, আপনারা এক এক করে লিস্টের নম্বরগুলোয় কল করুন।"
ঘন্টাখানেক লিস্ট চেক করে বাকিরা জানালেন, "স্যার এখানে আছে আরাফ সাহেব এবং উনার ওয়াইফ আর তানজিল এর এক বান্ধবি মাইশা এবং আরেকটা নম্বর যেটা বন্ধ! এবং এই নম্বরে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয়েছে তানজিলের!"
দেখছেন আরাফ সাহেব, এটাই সন্দেহ! যার সাথে বেশি কথা হয়েছে সেই ধরা ছোয়ার বাইরে! হারুন এবং হাকিম, আপনারা যান, এই নম্বর কার নামে খোলা জেনে আসুন।"
"খবর কি? কিছু জানতে পারলি? আমায় কি আরও কিছুদিন গা ঢাকা দিতে হবে?" বারী প্রশ্ন করলেন।
"দাদা, বিষয়টা এখন দিনের বা মাসের না, আমার মনে হচ্ছে আমাদের পালাতে হবে! আজ না হয় কাল, একদিন তো কামাল ওই চেয়ারে বসবেই! পালটা হামলা করবে! আমার মনে হয় আড়াল হওয়াই ভাল।", রাসেল জানালো। বারী জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কোনো লোক ধরা পড়ছে?"
"এখনও না।"
"ইনকাম ট্যাক্সের রেইড পরতে পারে যেকোনো সময়! সবকিছু সরিয়ে ফেলছিস?" রাসেল জানালো, "ব্যাংক একাউন্টই সব, বাকিগুলো ফার্ম হাউজে।"
"এই ফাইলটা নে, এতে ওসি কামালের সমস্ত পাপের আমলনামা আছে! আমাদের প্রেসে প্রতিটার চার কপি করে এই চারটা ডিপার্টমেন্টে কুরিয়ার করে দে। আমি একা ডুববো না, কামালকেও ডুবাবো!"
ছয় মাস পার হল, তানজিল এখনও জানে না সে কোথায় আছে! সারি সারি টিনশেড ঘর, প্রতিটা ঘরে একটাই দরজা, একটাই লাইট এবং একটাই ফ্যান! প্রতিটা দরজার সাথে বিশেষ কিছু নাম, ময়ুর, হরিণ, টিয়া! নিজের দরজার সামনের নামটা দেখলো, "আলতা!" আয়নায় দেখে নিজেকে চিনতেই পারে না সে। আইবিএ এর শিক্ষার্থী হতো এতদিনে! কাজল কে নিয়ে বাধা স্বপ্নও এতদিনে শুরু হয়ে যেত৷ এমন সময় একজন এসে বলল, "তোরে চাইসে, খুশি করে দিস। অভ্যস করে ফেল!" তানজিল আবারও কেঁদে উঠলো।
রাত ১২টা,
"নাম কি তোর?"
আনুমানিক সাড়ে পাঁচফুটের একটু বেশি উচ্চতার এক মেয়ে জিজ্ঞেস! উত্তরে বলল, "জ্বি, তানজিল!" মেয়েটা টুল নিয়ে সামনাসামনি বসে পরলো। বলল, "বয়সতো অনেক কম মনে হচ্ছে! কে দিয়া গেছে?" তানজিল কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না! আবার প্রশ্ন করল, "প্রেম করছিস জীবনে?" তানজিল বলল, "এসব জেনে আপনার কি লাভ? আমায় একা থাকতে দিন, আপনি যান!"
"পালাবো এখান থেকে, যাবি সাথে?" তানজিল সাথে সাথেই উত্তর দিল, "জ্বি, নিয়ে চলেন, যেখানে ইচ্ছা সেখানে! শুধু এখান থেকে দূরে নাম নিয়ে যান!"
তানজিলের কাকুতি মিনতি শুনে মেয়েটা হেসে দিল! এ হাসি যেন থামছেই না! পরে বলল, "প্রথম যখন আমি এখানে নিজেকে পাই মনে হচ্ছিল আমি দুঃস্বপ্নের ঘুম ভেঙে উঠছি! আর ধারণা করতে পারিস কে এনেছে এখানে আমায়?" তানজিল চুপচাপ বসে আছে। মেয়েটা আবারও বলতে শুরু করলো, "আমার বিশ্বাস এনেছে এখানে, যাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতাম সে! সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড যাদের আমরা বোকা ভাবে ভালবেসে ফেলি! আসলে সব প্রেমিক খারাপ হয় না এবং সব প্রেমিক ভালও হয় না। It depends on luck!" মেয়েটার কথা বলার ধরন পরিবর্তন দেখে তানজিল তাকালো। একটুপর বলল, "আমি কিভাবে এসেছি নিজেও জানি না!" "আমি জানি না তবে শিওর যে তোকেও সেই এনেছে! কেউ পেটের দায়ে কিংবা স্বভাবে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তে। আমরা হলাম ভুল সিদ্ধান্তের দায়ে এখানে! বাই দ্য ওয়ে, আমি আনিকা।" তানজিল বলল, "এখান থেকে বের হবো কিভাবে?"
"বের হয়ে কোথায় যাবি? নিজের বাড়ি? ভেবে দেখ কেউ যদি তোর এখানের পরিচয় জানে? মা বাবার উপর দিয়ে কোন ধরণের ঝড় বইবে? এমনিই কম যাচ্ছে না, তখন আরও বেশি যাবে! এই সুশীল সমাজ আত্মমর্যাদা নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিয়ে দিনশেষে এখানেই আসে! সমাজের চিরশত্রুদের চিনেও বারবার সুযোগ দিয়ে যাই আমরা আর অবিশ্বাস জন্ম নেয় যারা আমাদের মন প্রাণ দিয়ে চাইতো! কত চেনা মানুষকেই না দেখলাম এই কয়েক বছরে! দেশ শুধু মানচিত্রেই ছোট নয়, আসলেই অনেক ছোট!" তানজিল কাঁদতে কাঁদতে বলল, "আমার হেল্প করেন প্লিজ, আমি এখানে থাকতে চাই না! প্লিজ বলেন আমি কিভাবে বের হবো?"
"প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে আমিও এটাই ভাবছিলাম, এ্যটেম্পও নিয়েছিলাম। এটাই আমার আব্বুকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে! মা তো অনেক আগেই নেই! আর বাকি কাজ সুশীল সমাজের মানুষজন পূর্ণ করেছে! আত্মীয়স্বজন কেউই আমার নাম শুনতে পারে না! অথচ তাদের অনেকজনকে আমি এখানে দেখেছি!" আনিকার এই কথায় তানজিলের মনে ব্যাপক ভয় ঢুকে গেল! আনিকা জিজ্ঞেস করলো, "যাবি? মনে হচ্ছে না কেই বা জানবে? আসলে কখন কার সাথে দেখা হয়ে যায় কেউ জানে না! দেশ আসলেই অনেক ছোট!"
কামাল এখন মোটামুটি সাপোর্ট ছাড়া হাটতে পারে। সামনের মাসে নতুন ডিউটি জয়েন তার। যদিও চিঠি আসে নি এখনও। কিন্তু হঠাৎ অন্য একটা সিমে মেসেজ এল তার! লেখা ছিল, "লেক গেট, রাত আটটা, কথা ছাড়া আসবেন। দেরি না তাড়াতাড়ি!"
আংশিক কোড মেসেজ! ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ৭টা ২০ বাজে! কামাল বেরিয়ে পরলো ধীর পায়ে। বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে হেটে যাচ্ছে কামাল। পকেটে আজ ফোনটাও নেই। ফোন থেকে দূরে আছে বলেই অন্যান্য চাপ কম আজ। হাটতে হাটতে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে বসল সে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে স্বস্তির টান দিতে থাকলো৷ চাওয়ালা এমন সুখটান দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার দিকে! এমন সময় দোকানে আরেকজন এসে সিগারেট ধরালো৷ কামাল তাকে বললেন, "আ... ভাই, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কল করতে পারি? আমি ফোন বাসায় ভুলে ফেলে এসেছি!"
লোকটা কি যেন চিন্তা করে দিয়ে দিল। কামাল ধন্যবাদ জানালো। নম্বর ডায়াল করে বলল, "কলটা ব্যাক দে, আর্জেন্ট!" অপরপাশ থেকে ফিরতি কল এল। কামাল বলল, "কাল আমার সাথে দেখা কর, রাত ৮টায়। লোকেশন হল স্কুল গ্রাউন্ডের পশ্চিমে। আমার কাছে ফোন নাই, চুরি হয়েছে! সো, কাল দেখা হচ্ছে, রাখলাম।"
কল কেটে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল, "অনেক ধন্যবাদ ভাই, নিন আপনার ফোন৷" লোকটা বিল দিতে যাবে তখন কামাল তাকে বলল, "ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনার বিলটা আমিই দিই, এটা আমাকে দিতে দেন৷ প্লিজ!"
সিগারেট শেষে লেক গেটে অপেক্ষা করছে কামাল। একটুপরেই একজন বাইকার এল। বাইক সাইড করে কামালকে ইশারা দিল৷ কামাল জিজ্ঞেস করলো, "কি এমন খবর যার জন্য আমায় এত তাড়াহুড়ো করে আসতে হল?"
"আপনার যত আমলনামা আছে সব দুদকের কাছে এসেছে!" কথাটা শুনে কামাল আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করল! মৃদু সুরে বলল, "বারী!! বারী!! বারী!! আমি চেয়ারে নেই বলে আমাকেই বারি দিলে!" বাইকার বলল, "আপনার হাতে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ আছে!" কামাল বললেন, "বারী করেছে না এসব?"
"নাম, মোবাইল সবই ফেইক, শুধু ঠিকানাটা আসল। আর এসব নিয়ে কি করবেন? খুব তাড়াতাড়ি ব্যাংক একাউন্ট সিল করে দিতে পারে তারা! যা করার করে নিন! আসি।"
কামাল বাসায় ফিরে গেল। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় ছাঁদে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মনে মনে বলল, "বারী, তোমার বারোটা না, আমি তোমার তেরোটা বাজিয়ে ছাড়বো। তোমার প্রতিটা লোক আমার চেনা, তুমি ডালে ডালে চললে আমি পাতায় পাতায় চলি!"
বাসা থেকে বের হয়ে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে হেটে কোথায় যেন যাচ্ছে কামাল। কিছুদূর হেটেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ পিছু নিয়েছে কিনা! দূরে শিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। ঝোপঝাড় এবং কিছু ডালপালা তুলে অন্যস্থানে রাখলো৷ অল্প মাটি খুড়তেই বেরিয়ে এল দুইটা ব্রিফকেস। ঝোপঝাড় পূর্বের মত ঢেকে দিয়ে কেস গুলো নিয়ে বাসায় চলে এল৷ বড় পাতিলে চা বানালেন কামাল। চায়ের স্বাদে পুরোটা রাত বসে বসে সমস্ত ফাইল গুলোকে রেডি করে নিল। এগুলো সব বারীর জমি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাগজ! টাকার হিসাব সহ সমস্ত জিনিস কামাল যত্ন করে রেখেছে। কামাল আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল এমন একটা দিন আসবে যেদিন কেউ কাউকে ছাড় দিবে না, আজই সেদিন! ফাইল পত্র গুছাতে দিয়ে কামালের মনে পরলো ডিউটি থাকাকালীন বারীর ছেলেকে ইভটিজিং এর জন্য পিটিয়েছিল রাজীন! ঝটপট দ্বিতীয় মোবাইল বের করে এলাহিকে কল করলো। এলাহি এখন ডিউটিতে রয়েছে। বেশিসময় লাগলো না কল রিসিভ করতে। কামাল বারীর ছেলের ব্যাপারে জানতে চাইলো৷ সবকিছু জেনে কামাল প্রশ্ন করলো, "তাহলে রাজীন যেই মেয়েটার জন্য কাজলকে পিটাইছে এবং থানায় যেই মেয়েটার নিঁখোজ হওয়ার ডায়েরি দায়ের করা আছে দুইজনই একই?"
"জ্বি স্যার, কিন্তু জামশেদ স্যার এসব ব্যাপারে একদমই চুপ করে আছেন! মেয়ের বাবা আজও এসেছিল মেয়ের খোজ নিতে কিন্তু স্যার দেখাই দেন নি!"
কামাল সবকিছু জেনে নিয়ে বললো, "ওই ফাইলটা আমার দরকার! যেভাবেই হোক, এনে দে!"
"স্যার আমার ছোট চাকরি, ধরা পরলে সোজা টারমিনেট!" "এলাহি, আমার কাছে বেশি সময় নেই! সর্বোচ্চ দুই দিন দিলাম, এরমধ্যে ফাইলের ফটোকপি আমার চাই! জামশেদের আসা যাওয়া ভাল করেই জানিস, সো ভয়ের কিছু নাই। ফটোকপি বা ছবি যেমনেই হোক ফাইল জোগাড় কর।"
"রজার!"
"স্যার, সিসি ক্যামেরা ও সিকিউরিটি এবং ইন্টারনেট সিস্টেম পুরোটায় ডাউন!" হাকিম এসে জানালো৷ "তো আমাকে জানাচ্ছো কেন? যাও সাপোর্টে কল কর। ডাকো তাদের!" হামিদ এসে বলল, "স্যার, ডিসি অফিসে স্যারের সাথে আপনার মিটিং আজ, ১০ মিনিটে, ওখানে যেতে হবে!"
জামশেদ টেবিলে হাত রেখে বলল, "ধ্যাৎ! একটা ঝামেলা শুরু না হতেই আরও নতুন সমস্যা হাজির হয়! এলাহি, সাপোর্টে কল কর, নেট আর সিকিউরিটি ঠিক কর, আমি এসব ২০ মিনিটের মধ্যে সচল দেখতে চাই!"
এবার সামনে বসা আরাফ বললেন, "স্যার, আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ পেলেন? দেড় বছর হল কিন্তু একটা ছোট খবরও শুনতে পেলাম না৷" প্রায় কেঁদেই বললেন আরাফ! জামশেদ লেখা থামিয়ে দিয়ে বললেন, "আমরা পুলিশ এবং ওইযে দেখা যাচ্ছে গাড়িটা, ওটা পুলিশের গাড়ি! আলাদিন এবং আলাদিনের পাটি নয়, যখন যেখানে খুশি চলে যাবো! আরে ভাই দেড় বছর হল খুজছি কিন্তু পাচ্ছি না! দেশে আছে না বিদেশে আছে কিভাবে বলবো? আমরা আশেপাশের আরও পাঁচ থানায় খবর দিয়ে রেখেছি! আর আমাদের কি শুধু একটা কাজ?"
আরাফ আর বেশিক্ষণ থাকলো না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বের হয়ে গেলেন৷ বাড়ি ফিরে বললেন, "তানজিলের মা, আমরা এই এলাকায় আর থাকছি না। চল দূরে কোথাও যেখানে আমাদের তিনজনকে কেউ চিনবে না।" দুইজনই কাঁদতে লাগলো! "আত্মীয়স্বজন কেউই দুঃসময়ে কাজে এল না। উল্টো বদনাম ছড়িয়ে দিয়েছে! বিশ্বাস রইলো না কোনো মানুষের প্রতি!" তানজিলের মা বললেন।
"তারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছে! কিন্তু আইনগত ভাবে এলাকা ত্যাগ করা নিষেধ!" এলাহি বলল, "স্যার, জামশেদ স্যারের উপর তাদের বিন্দুমাত্র ভরসা নেই এবং আইনি শাস্তিতে তাদের কোনো ভয় নেই!"
কামাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "এখনের আমি যদি শুরু থেকে থাকতাম তাহলে উনার বিশ্বাস হতো, পূর্বের কামালকেও বর্তমান জামশেদের মত অবিশ্বাস করতো। যাই হোক, ফাইল কই?"
এলাহি ফটোকপি বের করে দিল৷ কামাল জিজ্ঞেস করলো, "কেউ টের পাই নি তো?"
"টোটাল সিকিউরিটি সিস্টেম ডাউন করা ছিল! কিভাবে টের পাবে?" শুনে হেসে দিল কামাল!
"আচ্ছা এখন পুরো ঘটনা বল এই কেসের! কিভাবে কেসের শুরু, এখনের প্রোগ্রেস, যা যা জানিস সব।" এলাহি যতটুকু জানে সবই বিস্তারিত বলল। শেষে কামাল বলল, "বারী আর আমার, অর্থাৎ আমাদের যৌথগত যত রেকর্ড ছিল সে সেসব দুদকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে হয়তো৷"
এলাহি বিস্মিত হয়ে গেল! উঠে দারিয়ে বলল, "স্যার, দুদক আপনার নিঃশ্বাসে আর আপনি আমাকে সাথে রেখেছেন! স্যার আমি গেলাম!"
এলাহির ভীতি দেখে কামাল বলল, "আরে আরে আরে! ১৭ বছরের জীবনে এটাই কি প্রথম নাকি? আমি কি জানি না কিভাবে প্রাইভেসি রক্ষা করা লাগে? বস, তোর কিছু হবে না। শোন, আমি যতদুর বারীকে চিনি তার স্বভাব হল সে যদি ডুবতে থাকে তবে অন্যকে নিয়েই ডুববে! একা ডুবে যাবে এটা হতে দেয় না সে! বিগত বছর গুলোয় ওকে যেই চুবানিটা দিয়েছি তাতেই সে এই একশনে যাচ্ছে। তাই আমি কোড-ওয়ার্ডে মেসেজ করবো তোর অন্য নম্বরে, সঠিক সময় আসিস এবং কোড-ওয়ার্ডে রিপ্লাই দিবি।"
এলাহির ভীতিকর চেহারা কামালকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে! কামাল আবারও বলল, "এলাহি! চোরের মন পুলিশ পুলিশ, মনে আছে না? শুনছিস তো?"
"জ্বি স্যার!" "তো এমনভাবে চল যেন সবকিছু স্বাভাবিক! সন্দেহ নিয়ে ঘুরলে যেকেউ সন্দেহ করবে।"
দিন পার হয়ে সপ্তাহে রুপ নেয়, সপ্তাহ মাসে এবং মাস বছরে! তানজিল কোনো সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছে না এখান থেকে বের হওয়ার! রুম থেকে দেখলো আনিকা মাত্রই ফিরলো। তানজিল আনিকার রুমে গেল, জিজ্ঞেস করলো, "আসবো?"
"আরে বাপরে! অনুমতি? আচ্ছা আয়!"
তানজিল আশেপাশে দেখে নিল কেউ আছে কিনা, পরে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা আনিকা, আমার মনে একটা প্রশ্ন, আপনার কথাবার্তা এখানের বাকিদের মত না, চালচলনে বুঝতে পারছি পড়ালেখা করছেন, এক কথায় শিক্ষিত। কিন্তু কেন এখান থেকে যাচ্ছেন না?"
আনিকা বলল, "বাইরে চল।" বাইরে এসে আনিকা বলল, "আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি, রেজাল্টও ভাল।"
তানজিল বলল, "তো কেন এখানে আছেন? আপনি বলেছেন আপনার মা বাবা কেউ বেঁচে নেই তবে কাকে হারানোর ভয়ে আপনি এখানেই থাকছেন? বাকী জীবন কি আপনি এসব করেই পার করতে চান? এটা জীবন নয়, এটা জীবনের বিরুদ্ধে বোকামি যুদ্ধ!"
আনিকা চুপচাপ হয়ে আছে! "কি করবো বের হয়ে? চাকরি? কোনো ডকুমেন্টস নেই আমার কাছে, বাসায় ছিল তারপর আর জানি না।"
তানজিল আনিকার হাত চেপে ধরে বলল, "প্লিজ, চলেন এখান থেকে পালাই, শেষ বারের জন্য! যা হবে দেখা যাবে! প্লিজ আরও একবার সাহস করেন। আমি এই পরিচয়ে বাঁচতে চাই না, আপনাকেও এখানে ছেড়ে দিব না, প্লিজ! শুধু একবার!"
আনিকা কি বলবে বুঝতে পারছে না! তানজিল মুখের দিকে তাকালো। তার চোখ জোড়ায় ঠিক পুরোনা আনিকাকে দেখতে পাচ্ছে বর্তমান আনিকা! "কাঁদিস না৷ কথা দিলাম, বের হবো! শেষবারের মত। স্বাভাবিক হয়ে নে, চোখ মুছ। এক্ট যাস্ট লাইক নাথিং হ্যাপেন্ড!"
রাতভর আনিকা তানজিলের বলা কথাগুলোই ভাবছে! সবারই কমবেশি কিছু অতীত থাকে। কারও সোনালী অতীত আবার কারও আছে অন্ধকার অতীত! আনিকার রয়েছে দুই অতীতের মিশ্র অনুভূতি যেখানে অন্ধকারটাই সোনালী অতীতকে ঢেকে দিয়েছে! "তো বের হবই, এবার কোনো ভয় নেই! কিন্তু সেই পুরানো ভাবনা, বের হতে পারলে কি করে খাবো?" এটা ভেবে আবার মনে মনে বলল, "না, বাঁচার জন্য নয়, মরতে বের হব, আত্মহত্যা করতে নয়!"
ফোন বেজেছে তিনবার কিন্তু রিসিভ করতে পারে নি। আবারও কল এল এবং এবার রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এল, "এরেস্ট হওয়ার আগে কিছু কথা আছে, সময় হবে?" কামাল জিজ্ঞেস করলো৷ রাজীন ভালভাবেই বুঝে গেল এটা কামালের কণ্ঠ! জিজ্ঞেস করল, "স্যার আপনি নম্বর পেলেন কোথায়?"
কামাল বলল, "আর্জেন্ট, সময় হবে?"
"পাহাড় দেখার ব্যবস্থা করেছেন, এত সহজে কি আসা যায়?" কি বলবে কামাল শব্দ খুজে পাচ্ছে না!
রাজীন বলল, "কোথায় আসতে হবে?" কামাল জানালো, "লোকেশন পাঠাচ্ছি, দিনক্ষণ দেয়া আছে, সেখানে সময়মত থেকো। আমি আসবো।" রাজীন ফোন রেখে দিল। মেসেজ এল সাথে সাথে। পড়ে দেখলো সময় লেখা আছে সন্ধ্যা ৫.৩০ মিনিট! নভেম্বর মাস, দিন ছোট, আর এমন সময় দেখা করতে বলার বিশেষ কোনো কারণ কি হতে পারে ভেবে পাচ্ছে না রাজীন!
"তানজিল! তানজিল! উঠ!" আনিকা তিন চারবার ডাক দিল কিন্তু চোখ খুললো না! সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। অনেকটুকু পানি ছিটিয়ে দিল। একটুপর চোখ খুললো তানজিল! আনিকাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল সে! বলল, "আর কতদিন? আর কত সহ্য করবো?" আনিকা জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে?"
তানজিল কেঁদে বলল, "গতকাল রাতে প্রায় দুইটার দিকে, বড় মালিক এসেছিল! উনি সাথে আরও দুইজনকে এনেছিল!" তানজিল বেশি কিছু আর বললো না। আনিকা বুঝে নিয়েছে এবং বলল, "কাঁদিস না, আর কিছুদিন অপেক্ষা কর! শোন, কিছু কথা আছে। হাত মুখ ধুয়ে নে, বাইরে আয়।" তানজিল কোনোরকম কান্না থামালো। আয়নায় দেখলো চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। চুল একেবারেই এলোমেলো! ঠোট ফেটে রক্তজমাট বেঁধে আছে! নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে এল। আনিকা বলল, "আজ বা আগামীকাল একটা তালিকা তৈরি হবে এখানকার সকল মেয়েদের মাঝে!" তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "কেমন তালিকা?"
"প্রত্যেকবার তালিকা হয় ট্রেন্ড লিস্ট! যার মানে হল কার কেমন অবস্থান। কার কাছে লোকজন বেশি আসে। তোর আর আমার নাম শুধু সেখানে উঠাতে হবে। ভাল এক্টিং করতে হবে যেন সন্দেহ না করে। লিস্ট করার জন্য আসবে বন্ড নামের একজন।"
"হুম, চিনি তাকে৷" তানজিল বলল। "তাকে এক্সট্রা টাকা দিলেই নাম উঠে যাবে। তবে সমস্যা আছে, এটা এতো সহজ নয়। ম্যানেজ করে নিস।" তানজিল আবারও জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু হবে কি এতে?"
"ওহ সরি, শীতের শুরু বা মাঝামাঝিতে একটা পার্টি হয়, বিজনেসম্যান, পলিটেশিয়ান্স এবং আরও অনেক থাকে। নাচ, গান আর এখানের মত প্রাইভেট স্পেইস! বিগ এমাউন্ট মানি! এটাই আমাদের সুযোগ। এখান থেকে যাওয়ার সময় এবং ওখান থেকে ফেরার সময় পালানো যাবে না, ইম্পসিবল! যা করার ওই স্পটেই করতে হবে! সো নিজেকে তৈরি করে নে, আর কয়েকটা দিন সহ্য কর।" তানজিল স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল এবং বলল, "হয় মরে যাবো কিন্তু এখানে ফিরে আসবো না।" আনিকা বলল, "তুই আমাকে স্বাধীন করেছিস। আমি নিজে নিজেই অনেক বড় বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম! এখন আমার কোনো ভয় নেই৷ যা হবার দেখা যাবে।"
বিকাল ৫.২৫ মিনিট,
ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে৷ রাজীন তার নির্ধারিত স্পটে এসেছে। একটুপরই দুজন লোককে আসতে দেখলো তার দিকে। চাদর মুড়ে কাছে আসতেই বুঝে নিল কামাল এসেছে৷ "দারিয়ে থেকো না, আমার থেকে একটু দূর হতেই হাটা শুরু কর, আমরা কনফারেন্সে কথা বলবো।" রাজীন জিজ্ঞেস করলো, "স্যার কেউ আছে স্যার?" আরও একটা কণ্ঠ শুনা গেল এবং বলল, "চিনতে কষ্ট হচ্ছে না তো?" রাজীন বিস্ময় নিয়ে বলল, "আরে তুই! একদমই না!" কণ্ঠটা ছিল এলাহির!
কামাল জিজ্ঞেস করলো, "তোমাদের জন্য একটা টাস্ক আছে, খুবই কনফিডেনসিয়াল! ফলো মি।"
একটা কোচিং সেন্টারের রুমে প্রবেশ করল কামাল, রাজীন এবং এলাহি। প্রবেশ করতেই দেখলো আরও তিনজন রয়েছে৷ সবাই দারিয়ে গেল। কামাল বলল, "সবাই বসুন৷" রাজীন এবং এলাহিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কামাল। বাকি দুইজন ছিল কামালের সোর্স এবং একজন নেটওয়ার্ক স্পেশালিষ্ট। কামাল প্রোজেক্টরের মাধ্যেমে ছবি চালু করলো৷ বলল, "ভালভাবে দেখে নিন সবাই। ইনি হলেন বারী৷ নির্বাচনে হেরে দিশেহারা আজ তিনি! এবং ইনিই হলেন আমাদের প্রধান টার্গেট! কিন্তু তার কাছে যাওয়ার পূর্বে আমাদের চারজনকে দেখে নিতে হবে।" কামাল আরও চারটা ছবি চালু করে বলল, "বা দিক থেকে টিটু ওরফে গ্রিজ, রিয়াজ, রাসেল এবং বারীর ছেলে কাজল। কাজল এখানে অপশনাল, দেশে নেই।" কামাল বিস্তারিত তথ্য দিলেন সবাইকে এবং আরও বলল, "এদের মধ্যে রাসেল সবচেয়ে বেশি রেয়ার! গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া রাসেল বারীর সাথে থাকে না। রাসেলকে যদি বারীর সাথে দেখ তাহলে ধরে নিবে তাদের আরও কয়েকজন শ্যাডো গার্ড রয়েছে তাদের আশেপাশে!"
এলাহি জিজ্ঞেস করলো, "তাহলে আমাদের টাস্ক কি স্যার?" "প্রথমেই বলে নিই, আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই এবং সময়ের অভাবে আপনাদের শরণাপন্ন হচ্ছি আমি। সমস্ত প্রায়শ্চিত্ত করার মত সময় আমার নসিবে নেই তারপরও যতুটুকু পারি....!" কামাল দুই হাত টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে দারালো। কিছুক্ষণ পর বলল, "বারী হিউম্যান ট্রাফিকিং শুরু করেছে অজানা মহলের সাথে। খুব শীঘ্রই বারী দেশ ত্যাগ করবে মামলা থেকে বাঁচার জন্য। আমার সোর্সের তথ্যানুযায়ী তারা সবাই একটা পার্টিতে একত্রিত হবে। বারীর হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এর প্রথম শিকার এই মেয়েটা!"
একথা বলেই বারী প্রোজেক্টরে ছবিটা দেখালো, "ছবিটা দেখ সবাই, তার নাম তানজিল। বয়স ২১ বছর! আমাদের থানায় আবাস তার। কিন্তু দুই বছর হল নিখোঁজ!"
রাজীন বলল, "স্যার একে তো চেনা চেনা লাগছে এবং নামটাও পরিচিত!" কামাল বলল, "একদম! বারীর ছেলেকে কয়েক দফা পিটিয়েছিলে না?" "জ্বি স্যার মনে পরেছে!"
"কাজলের সাথে রিলেশন ছিল বলে আমার মনে হয়। কললিস্ট চেক করে কাজলের ফোন নম্বরই নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে বেশিবার এবং দীর্ঘক্ষণ পাওয়া গেছে! কাজলের বিদেশ যাওয়ার একদিন আগে তানজিল নিঁখোজ হয়! আমাদের এলাকা থেকে তানজিল নিঁখোজের ব্যাপারটাতে বারীর জড়িত থাকা খুবই সম্ভাব্য! কারণ আমার ক্যালকুলেশনে, বারী বুঝতে পেরেছে তানজিল আর কাজলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক রয়েছে! কাজল দেশের বাইরে যাবে তাই বারী তানজিলকে তুলে নিয়েছে যাতে কোনো যোগাযোগ না হয়, বারী তার স্ট্যাটাসের ব্যাপারে সবসময় পজেসিভ! আর যেই পার্টির খবর আমি পেয়েছি সেখানে অনেক হাই প্রোফাইল মুখ থাকবে এবং মেয়েরাও থাকবে! লেইট নাইট পার্টি এটা! ছোট্ট একটা ভুল করলেই তোমাদের কভার নষ্ট হয়ে যাবে! কারণ, কোনো ব্যাকআপ নেই! এটা একটা আন-অফিশিয়াল মিশন! এতটুকু ক্লিয়ার?"
"ইয়েস স্যার!" সবাই একত্রে উত্তর দিল।
"এখন দ্বিতীয় কিস্তি, অবজেক্টিভস।
রাজীন এবং এলাহি, তোমরা দুইজন বারীর সম্পর্কে যা পারো ইনফরমেশন কালেক্ট করবা, ছবি বা ভিডিও! কার কার সাথে দেখা করলো এসব আরকি। এরজন্যে তোমাদের আটটা মাইক্রো রেকর্ডার দিলাম। প্রয়োজন মত স্থানে রেখে দিও! এটা রেকর্ড হবে অপারেটরের কাছে এবং অপারেটর কি সেটা পরে বলছি। অবশ্যই তোমরা ওখানে শেষ পর্যন্ত থাকবে৷ তোমরা দুজন ওয়েটার হিসাবে কাজ করবে এবং সোর্সরা গার্ড হিসেবে! যদি কোনো সমস্যা হয়ে যায় বা কভার রিভিল হয়ে যায় তবে ওরা যেদিকে থাকবে সেটাই হবে তোমাদের এক্সিট পয়েন্ট! উনি নেটওয়ার্ক স্পেশালিষ্ট, ডাক নাম অপারেটর। উনি তোমাদের জন্য আলাদা কমিউনিকেশন চ্যানেলের ব্যবস্থা করবেন। সবাই নিজেদের গেটআপ চেঞ্জ করো। দাড়ি কেটে ফেল বা খুব বড় রাখো যাতে তারা কেউ তোমাদের চিনতে না পারে। আমার মনে হয় তানজিলকে বারী সেখানে এনেই ছাড়বে! তার কারণে তুমি কয়েক দফা কাজলকে পিটিয়েছিলে।"
রাজীন বিশ্বাস করতে পারছে না তানজিল এমন অবস্থানে আছে আজ! রাজীন বলল, "স্যার, এত কম সময়ে এই টাস্ক কিভাবে কমপ্লিট করবো? অনেক রিস্ক!"
কামাল বলল, "ধরে নাও আমার উপর তোমরা মেহেরবানি করলে। মাঝে মাঝে বারীকে ধন্যবাদ দিতে মন চায়! সে আঘাত না করলে আজ হয়তো আমি আগের কামাল থাকতাম! তানজিলের কেসটা আমিই হ্যান্ডেল করতাম যদি জামশেদ তার পূর্বের থানায় ফিরে যেত! কিন্তু দুদকের কেসে আমি ফেসে গেলাম এবং জামশেদ এই কেসে হাতও দিবে না। আমার এটাও ভুলে গেলে চলবে না দুই মেয়ে এবং এক ছেলের বাবা আমি৷ যাই হোক, আজই তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা, ফাইলগুলো প্রত্যেকেই এক এক কপি নিয়ে বিস্তারিত স্টাডি কর। গুড লাক!"
রাজীন জিজ্ঞেস করল, "স্যার যদি তানজিল বা অন্য মেয়েদের কিংবা তানজিল সহ সবাইকে পাই? তাহলে কি করবো?"
"Rescuing any of them is not your task! যদি মনে কর তানজিলের দেখা পেলে এবং শুধুমাত্র তানজিলকে সেখান থেকে উদ্ধার করবে, then you have to kill every people there and yourself too! Unable to imagine!"
রাজীন কিছু বলল না কিন্তু মনে মনে বলল, "যদি আসলেই তানজিলকে সেখানে পাওয়া যায় এবং তাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার না করে চলে আসি তবে সারাজীবন কেমন যেন অপরাধী ফিল করবো না? এই রিস্ক অথবা পাগলামি করা কি ঠিক হবে? তাও আবার জেনেশুনে!"
রাত ৮টা,
দরজায় কেউ দুইবার ধাক্কা দিল! তানজিল ভয়ে উঠে গেল! আবারও ধাক্কা দিল দরজায়। দরজা খুলতেই দেখে বন্ড! জিজ্ঞেস করলো, "এই সপ্তাহে কি অবস্থা?"
তানজিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না! বন্ড আবারও বলল, "ভাল না, বুঝতে পারছি। তুই এভাবেই থাকবি। ডিমান্ড বারবে না তোর৷ ভাবলাম বড় কাস্টমারকে দিব, থাক।" বন্ড বের হতে যাচ্ছিল তখনই তানজিল তার হাত ধরে ফেললো! বন্ড কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল! তানজিল তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে আসলো। দরজা আটকিয়ে বলল, "আমিও চাই আমার নাম উঠুক!" বন্ড জিজ্ঞেস করলো, "কি জন্য তোর নাম উঠাবো?" তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "কি চাই তোমার?" বন্ড দারিয়ে গেল। এক পা এক পা করে তানজিলকে পিছিয়ে নিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে দিল। বলল, "আমাকে খুশি করে দে! সব পাবি!" তানজিল বলল, "ব্যস এতটুকু? ঠিক আছে!" বন্ড এগিয়ে এল কিন্তু তানজিল তাকে থামিয়ে বলল, "আজ না, আমার মর্জি মত! তারপর তোমার মর্জি!" বন্ড তানজিলের নাম লিখে চোখের ইশারা দিয়ে চলে গেল! লাইট অফ করে দিয়ে তানজিল নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো! মনে মনে বলল, "আর মাত্র কয়েকটা দিন!"
একটুপর আবারও দরজায় কেউ টোকা দিল! ভয় পেয়ে দরজা থেকে দূরে সরে গেল তানজিল। না চাইতেও দরজা খুলল সে এবং অনেকটা স্বস্তি ফিরে পেল কারণ আনিকা দরজায়! সে জিজ্ঞেস করলো, "সব ঠিকঠাক? নাম উঠেছে?" তানজিল কেঁদে বলল, "হ্যাঁ, বাকিদের মত সে ও ওটাই চেয়েছে!" আনিকা নিজেও কেঁদে বলল, "মুক্তি, এত সহজ না! জেলের কয়েদিরা মুক্ত বাতাসে বুঝতে পারে না তাদের কর্ম কি উপহার দিতে যাচ্ছে! আমরাও এত সহজে মুক্তি পাবো না। শুধু দোয়া কর যেন এখানের কোনো খাদক দ্বিতীয়বার সামনে
না পরে!"
--- ধন্যবাদ | ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ---
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:২৫