somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনের মানুষ - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়/গৌতম ঘোষ

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুনেছি ছবি দেখার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন- ছবিটা একদম ভালো লাগেনি৷ নিজের লেখা উপন্যাস নিয়ে নির্মিত ছবি ভালো না লাগাটা নিশ্চয় কষ্টের৷ যাই হোক, মনের মানুষ নিয়ে সিনেমা হয়েছে জানার পর সেটা দেখার যেমন ইচ্ছে হয়েছিলো, তেমনি ছবিতে লালনের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম৷ প্রসেনজিতের মতো একটা অতি চালাক তেল তেলে সুখী চেহারার কাউকে লালনের ভূমিকায় ভাবতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিলো৷ জানি না পরিচালকের সে কষ্ট কেনো হয় নি৷

হলে যখন প্রবেশ করি তখন ছবি বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে৷ যুবক লালন তখন কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্নের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে বহরমপুরে যাওয়ার পথে৷ সে কবিরাজের কর্মচারি নয়, কিন্তু এই ভ্রমনে কবিরাজ মশাই তাকে সঙ্গে নিয়েছে৷ তার দায়িত্ব কবিরাজ মশাইয়ের ঘোড়াকে দেখাশোনা করা আর মাঝে মাঝে কবিরাজ মশাইকে গান শোনানো৷

ঘরে লালনের মা রয়েছে, স্ত্রী রয়েছে৷ লালনের জননী অবশ্য কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে লালনের ভ্রমনের ঘোর বিরোধী ছিলেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত লালন গঙ্গাস্নানে যায় এবং বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে৷ তার অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে অন্যরা তাকে না পুড়িয়ে ভেলায় করে নদিতে ভাসিয়ে দেয়৷

লালন কিন্তু আসলে মরেনি৷ তার ভেলা ভাসতে ভাসতে একটা ঘাটে এসে ভেড়ে৷ সেখানে এক মুসলমান মহিলা তাকে উদ্ধার করেন এবং সুস্থ করে তোলেন৷ সেখানে লালনের দেখা হয় সিরাজ সাঁইয়ের সাথে৷ লালন সেই মুসলমান মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিরাজ সাঁইয়ের সাথে বের হয়ে পড়ে৷ কিছুদিন সিরাজ সাঁইয়ের সাথে কাটানোর পর লালন ফিরে আসে তার জন্মভূমিতে৷ জন্মসূত্রে লালন বৈষ্ণব৷ কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় সে মুসলমানের হাতে খাবার খেয়ে জাত হারিয়েছে বলে লালনের মা তাকে ঘরে তুলতে অস্বীকার করে৷

নিজের গ্রাম, ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে লালন এক জঙ্গলে আশ্রয় নেয়৷ সেই জঙ্গলে আস্তে আস্তে তার সাথে আরো কিছু মানুষ জুটে যায়৷ সবাই মিলে সেখানে থাকে, মাঝে মাঝে গান বাজনা হয়৷ সবাই লালনকে তাদের অলিখিত নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে৷ এখান থেকেই আস্তে আস্তে লালনের গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে৷

মোটামুটি এই হলো মনের মানুষ ছবির কাহিনী৷ এ কাহিনীর পুরোটাই বিধৃত হয় লালনের মুখ থেকে, শিলাইদহের জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে৷ লালন যে জঙ্গলে তার বসতি গড়ে তুলেছিলো, সে জঙ্গল ঠাকুর পরিবারের জমিদারির মধ্যে পড়ে৷ লালনের কাহিনী শেষ হলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের বসতির অঞ্চলকে নিষ্কর হিসেবে পাট্টা দেন৷ আর এখানেই ছবি শেষ হয়৷

ছবি কেমন লাগলো বলতে গেলে বলতে হয়- ছবিটা আমার কাছে কোনো অবস্থাতেই আহামরি কিছু বলে মনে হয় নি৷ ধীরলয়ের ছবিটাতে অভিনয় অনেকাংশেই দুর্বল বলে মনে হয়েছে৷ প্রসেনজিৎকে কোনো অবস্থাতেই লালন চরিত্রের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়নি৷ লালনের মুখের মধ্যে যে গভীর সাধকের ছাপ থাকার কথা (বাস্তবে না থাকলেও ছবিতে ঐটুকু আশা করা যায়, যেহেতু লালনের চেহারা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের নাই), তা প্রসেনজিতের মুখের মধ্যে ছিলো না, উল্টো তার মুখে তেল তেলে সুখী ভাবটাই বেশী ফুটে উঠেছিলো৷ তার চাইতেও খারাপ যে কথা, ব্যাকগ্রাউণ্ডে লালনের গান যে গেয়েছে, তার গলার সাথে প্রসেনজিতকে কোনোক্রমেই মিলানো যাচ্ছিলো না৷ যখনই লালনরূপী প্রসেনজিত গান গেয়ে উঠেছে, তখনই বেখাপ্পা লেগেছে৷ আর ব্যাকগ্রাউণ্ডের গায়কীটাও তেমন ভালো লাগেনি৷ শুনেছি ফরিদা পারভিন বলেছে- লালনের গান গাওয়ার জন্য গৌতমকে আমি গাইডলাইন দিয়েছিলাম, তবু ওরা ঠিকমতো গাইতে পারেনি৷

ছবির সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি যেটা- ছবিটাতে লালনকে একজন সাধক বাউল হিসেবে বোঝা যায়নি৷ লালন যে একজন বাউল, মরমী গান গাওয়াই যে তার প্রধান নেশা- সেটা আগে থেকে না জানলে বুঝে ওঠা কষ্টকর৷ জঙ্গলের মধ্যে লালন বসতি গড়ে তোলার পর কতোদিন গেছে বোঝা যায়নি, এর মধ্যে সে মাঝে এক দুই লাইনের গান গেয়েছে, কিন্তু বোঝা যায়নি যে গানটাই লালনের প্রধান, গান নিয়েই সে আছে৷ হঠাৎ একদিন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার এসে বললো যে লালনের গান এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷ কবেই বা লালন গান গাইলো আর কেমন করেই বা তা মুখে মুখে ফেরা শুরু করলো কে জানে৷ এর আগ পর্যন্ত তো মনে হচ্ছিলো যে লালন একজন সৌখিন বাউল মাত্র যে মাঝে মধ্যে গানের দুই একটা লাইন গেয়ে ওঠে!

ছবি দেখার পর মনের মানুষ বইটা পড়ার সাধ হলো৷ বই পড়ার পর হতাশ হতে হলো৷ ছবির সাথে বইয়ের কাহিনীর তেমন পার্থক্য নাই, কাজেই সেখানে নতুন কিছু পাওয়া গেলো না৷ কিন্তু লালনের যে একটা গানের আখড়া আছে, সে যে একজন বাউল, গান নিয়ে তার যে একটা সাধনা আছে, এটা ছবিতে যতোটুকু বোঝা গেছে বইতে তাও যায়নি৷ বস্তুত বইটা না সাহিত্যের বিচারে ভালো, না ইতিহাস হিসাবে, না জীবনি হিসাবে৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো একজন অতি বিখ্যাত লেখক বইয়ের লেখক না হলে বইটা আসলে আলোচনার যোগ্যই হতো না৷ পুরো বইতে একবারও মনে হয়নি লালন আসলে বাউল সাধক৷ বরং মনে হয়েছে যে সে একেবারেই বুদ্ধিজ্ঞানহীন একজন মানুষ, মাঝে মাঝে গানের কথায় সে কিছু তত্বকথা বলে ফেলে, কিন্তু আসলে সেসব তত্বকথা সে নিজেই বোঝে না৷

বইয়ের শেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন যে বইটাকে লালন ফকিরের প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবন কাহিনী হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না৷ কারণ তার জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়৷

আমার মনে হয়, এ কারণেই বইটার ভালো হয়ে ওঠার অনেক ভালো সুযোগ ছিলো৷ যেহেতু লালনের জীবনি লিখতে হচ্ছে কল্পনা করে, কাজেই সেটাকে সঙ্গতিপূর্ণ করে লেখা যেতো৷ সেই সময়েই লালনের ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা ছিলো প্রায় দশ হাজার৷ সেই সময়ে দশ হাজার ভক্ত অনুরাগী ছেলেখেলা নয়৷ কাজেই অনুমান করে নিতে কষ্ট কোথায় যে লালনের একটা ডেডিকেশন ছিলো, এমন হঠাৎ হঠাৎ এক দুইটা গান গেয়ে সে নিশ্চয় দশ হাজার ভক্ত অনুরাগী গড়ে তোলেনি৷

ছবি বা বইয়ের শেষে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে লালনকে তার আখড়া নিষ্কর করে দেয়, এই কষ্ট কল্পনাটুকুও সুনীল কেনো করলেন বুঝলাম না৷

শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস আছে কবি কালিদাসকে নিয়ে, নাম (সম্ভবত) 'কুমারসম্ভবের কবি'৷ সেটাও কল্পনায় লেখা৷ কেউ চাইলে সে বইটা পড়ে দেখতে পারে, কল্পনায়ও একজনের জীবনি কেমন হতে পারে৷

তবে ছবি দেখে হতাশ হলেও কেনো জানি ছবিটা শেষ হওয়ার পর খুব খারাপ লাগেনি৷ সেটা সম্ভবত লালনের গানের গুনই হবে৷ ধন্য ধন্য বলি তারে গানটার চিত্রায়ন বেশ ভালো লেগেছে৷

[শৈলী (shoily.com) তে পূর্বে প্রকাশিত]
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×