আলো আমার, আলো ওগো
আলোয় ভূবন ভরা
আলো নয়ন ধোঁয়া আমার
আলো হৃদয় হরা-
কবিগুরুর রচিত এ চরনগুলো আজ বার বার মনে পড়েছে। কেননা আজ আমরা আলোচনা করবো সেই প্রদীপ্ত আলোকছটা নিয়ে, যার উজ্জ্বলতায় দূরীভূত হয় সকল অন্ধকার। সে আলোর নাম শিক্ষা। যুগের পরিবর্তনে আজ মানুষ সৃষ্টি করেছে কল্যান রাষ্ট্রের যেখানে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর জনগনকে এ অধিকার দেয়ার লক্ষ্যেই উদ্ভব হয় শিক্ষানীতির। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুষ্ঠুভাবে এ অধিকার দেয়ার লক্ষ্যেই সরকার শিক্ষানীতি প্রনয়ন করে থাকে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৭টি শিক্ষানীতির প্রস্তাব করা হয়েছিল, কিন্তু দূভার্গ্যজনক হলেও সত্যি যে, এর মধ্যে একটিরও পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। যার কারনে আজও এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এক দোদুল্যমাণতায় ভুগছে। আর আজকের ছাত্রসমাজ হবে আগমীর দেশ গড়ার কারিগর।
ভূমিকা ঃ
একটি জাতীয় শিক্ষানীতির অভাবের কথা বলাবলি হচ্ছে বহুকাল ধরেই। কিন্তু মূলত রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভাজনের কারণেই এ অভাব দূর করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ণের চেষ্টা চলছে এবং একাধিক কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়েছে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ।কিন্তু বারবার নীতি প্রণীত হলেও কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। এভাবে আটটি প্রতিবেদন হিমাগারে জমা রয়েছে। পাশাপাশি অতীত ইতিহাসের দিকে তাকলেও দেখা যায়, পাকিস্তান আমলেও শিক্ষানীতি নিয়ে এমন ব্যর্থ প্রয়াসের সংখ্যাও কম ছিলো না।
স্বাধীনতার পরপর যে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সংবিধান রচিত হয় তার উপর ভিত্তি করেও শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রয়াস করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
ইতিমধ্যে অনেক সময় গড়িয়েছে, বুড়িগঙ্গার, কর্ণফুলী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, সমস্যায় জর্জরিত দেশেবাসীর পিঠ যেমন দেয়ালে ঠেকেছে, তেমন অনেক বিষয়ে চোখ ও খুলছে। ছাত্রসমাজ সহ দেশের সকল মানুষের একটি অন্যতম দাবি হয়ে উঠেছে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
একুশ শতকের প্রতিযোগীতা হবে মেধায়, পেশীতে নয়। এই প্রতিযোগিতা হবে মননের, সৃজনশীলতার কিন্তু বাচালতার নয়। এমন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন সৃষ্টিশীল মস্তিস্কের। আর এসব অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার , যার জন্য প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী আধুনিক ও প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষানীতির।
শিক্ষা কী ঃ
শিশুর সর্বতোমুখী বিকাশ সাধনকে শিক্ষা বলে। মানব জাতি এই শিক্ষা শব্দটির সাথে সর্বাপেক্ষা বেশি পরিচিত। শিক্ষা হলো এক বিশেষ দর্শন যা জীবন দর্শনের উপর নির্ভরশীল।
শিক্ষা জীবনের মতই ব্যাপক। শিক্ষা হলো আজীবন সাধনার সামগ্রী। মানুষের যেমন চাহিদার শেষ নাই তেমনি শিক্ষার ও শেষ নাই।
শিক্ষা শব্দটি ইংরেজি ঊফঁপধঃরড়হ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। ইংরেজি ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ঊফঁপধঃরড়হ, ঊফঁপধৎব এবং ঊফঁপবৎব এর পরিবর্তিত রূপ। এই ঊফঁপধঃরড়হ, ঊফঁপধৎব শব্দের অর্থ হলো বাহির করা , প্রশিক্ষণ দেয়া, পরিচালিত করা। আর ঊফঁপধৎব শব্দের অর্থ ভিতর হইতে পরিবর্তন আনা, অভ্যন্তরীন গুণাবলীর পরিপুষ্টি সাধন করা। কাজেই এর বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায়, যাহা মানব শিশুর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধানে সহায়তা করা।
সক্রেটিসের মতে “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিস্কার।
প্লেটোর মতে, “শরীর ও আত্মার পূর্ণতার জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন তা হলো শিক্ষা”।
লেনিনের মতে-“মুক্তি সংগ্রামই শিক্ষা”।
ক্যান্টের মতে “আদর্শ মনুষ্যত্ব অর্জনই শিক্ষা”।
শিক্ষা সম্পর্কে আধুনিক সংজ্ঞাটি প্রদান করেছেন একদল আমেরিকান শিক্ষাবিদ ১৯৪৫ সালে;
“শিক্ষা এমন এক সুসংবদ্ধ উপায়/কৌশল বা সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তির সর্বাধিক কর্মক্ষমতা, ধ্যান ধারণা রুচি ও স্বভাবের পরিবর্তন সাধান করে এবং যে পরিবেশে, বিশেষ করিয়া সে স্কুল পরিবেশে যে বাস করে তাহার মধ্যে হইতে সামাজিক সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত উন্নতি আনয়ন করাই শিক্ষা”।
অর্থাৎ বলা যায় মানুষকে মানুষ করাই শিক্ষা যা আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঃ
বাস্তবিক শিক্ষার নিজস্ব কোন লক্ষ্য নাই। ব্যক্তি বা জাতির লক্ষ্যই শিক্ষার লক্ষ্য।
আদর্শ পরিবার ও সমাজ সৃষ্টির জন্য মনুষ্য ও কর্মশক্তিবৃদ্ধি ও অর্জনই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। পাশাপাশি মানুষের উন্নত দৃষ্টি শক্তি বা সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনই শিক্ষার আসল লক্ষ্য, আর একে কেন্দ্র করে কল্যাণকর আদর্শের প্রতি দৃষ্টি রেখে পরিকল্পিতভাবে কাঙ্খিত দিকে অগ্রসর হওয়াই হলো শিক্ষার প্রধান কাজ। তবে এসব উদ্দেশ্যবলী অনেক সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় এসব উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সচেতন ব্যক্তিবর্গের সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
আচরনের সুপরিবর্তন ছাড়াও পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোই হলো শিক্ষা। এটি মানবজাতির দৃষ্টিদান ও যোগসূত্র স্থাপনে পারস্পরিক কতর্ব্যবোধকে উদ্বৃদ্ধ করে। এ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাতটি। যথাÑজ্ঞানার্জন, উপলব্ধি, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনোভাবের কাংখিত পরিবর্তন, খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা লাভ, চিন্তা শক্তির বিকাশ ও মূল্যায়ন। তবে সমাজের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় এই শিক্ষার কিছু জাতীয় উদ্দেশ্য বিদ্যমান, এগুলো হলোঃ-
১। যোগ্যতানুসারে প্রতিটি মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশ সাধন।
২। পারস্পরিক সমঝোতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব সৃষ্টি।
৩। জাতীয় মূল্যবোধ তথা কর্তব্যজ্ঞান, ন্যায় পরায়নতা, শৃঙ্খলাবোধ শিষ্টাচার ও একাত্মবোধ সৃষ্টি।
৪। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার মাধ্যমে দক্ষ ও সৃজনশীল জনশক্তি প্রস্তুতকরণ।
৫। শিক্ষার মাধ্যমে শ্রমের মর্যাদাবোধ সৃষ্টি এবং জাতীয় উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা।
৬। মেধা ও প্রবনতা অনুসারে জীবিকা অর্জনের জন্য যথারীতি প্রশিক্ষণ প্রদান।
৭। প্রয়োজনীয় বস্তুর উদ্ভাবন এবং সত্য মিথ্যা চিহ্নিতকরণ।
তবে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিবিধ মনীষী বিবিধ মতামত প্রদান করেছেন-
প্লেটোর মতে- “শরীর ও আত্মার সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনই শিক্ষার লক্ষ্য”।
অধ্যাপক আলী আজমের ভাষায়-“শিক্ষার লক্ষ্য হইতেছে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, উৎকর্ষ সাধন, শিক্ষার্থীর প্রবৃত্তিসমূহকে যথাযথ বিকাশ লাভের সুযোগ প্রদান , কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে উন্নতির পথে আগাইয়া দেয়া, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানসিক ক্ষমতার ভিত্তিতে সমাজের প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে যাহাতে পূর্ণ আত্মবিকাশের সুযোগ লাভ করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করা, এমনকি কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানবিক আবেগরূপে সম্পদ প্রদানের ব্যবস্থা করা।”
জামার্ন দার্শনিক ক্যান্ট-এর মতে-“শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্তমানে নগদ কিছু পাওয়া নয়। বরং ভবিষ্যতে কালোপযোগী অনেক কিছু লাভ করার ব্যবস্থা করা।”
আধুনিক শিক্ষার জনক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশোর মতে-“শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো কৃত্রিমতা বর্জিত পরিবেশে শিশু প্রকৃতির অবাধ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জীবনধারনের বাস্তব কলাকৌশল অর্জন”।
শিক্ষার্নীতি কী ঃ
শিক্ষা হলে বর্তমানের কানন ও ভবিষ্যতের মুকুল। এটিই জাতির মেরুদন্ড। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির নিয়ামক হলো শিক্ষা।
মহাকবি মিল্টনের কথায় শিক্ষাকে যেমন ঐধৎসড়হরড়ঁং ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ নড়ফু, সরহফ ধহফ ংড়ঁষ তেমনি কালের সিঁড়ি। যেকোন জনপদের জীবনধারা ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার নির্দেশিত রাজপথ। কোন জনপদের মানুষের জীবনধারা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ নির্মিত হয় যে দেশ ও জাতি কর্তৃক গৃহীত শিক্ষানীতি ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে।
শিক্ষানীতি বা ঊফঁপধঃরড়হ চড়ষরপু মূলত দু'টো শব্দ। শিক্ষা+নীতি (ঊফঁপধঃরড়হ + চড়ষরপু)। এই দুইটি বিষয় পৃথকভবে আলোচনা করলে শিক্ষানীতি বিষয় একটি সঠিক ও পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া যায়।
শিক্ষা হলো এমন এক গতিশীল প্রক্রিয়া যা মানুষের সর্বতোমুখী বিকাশ সাধন করে। আর নীতি হলো কোন বিষয়ের ব্যবস্থাকীয় কার্যাবলী সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদনের দিক-নির্দেশনা। এর উপরই নির্ভর করে সে বিষয়ের কর্মসূচী প্রণীত ও গৃহিত হয়। নীতির মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠানের বা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যের ঐক্যতা, নমনীয়তা, সহযোগিতা, সার্বজনীনতা, ভারসাম্য নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পরিচালিত হয়।
শিক্ষানীতি হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য অনুযায়ী তদ বিষয়ক কার্যাবলী সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদনের দিক নির্দেশনা এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। আর তাই একটি সুষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা প্রনয়ন ও পরিচালনার জন্য একটি আদর্শ শিক্ষানীতির প্রয়োজন হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি বলতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে আশু-কতর্ব্যগুলো চিহ্নিত করা ও সরকারকে সেইভাবে পরামর্শ দেয়াকে বোঝায় যার ভিত্তিতে সরকার তার শিক্ষাবিষয়ক কর্তব্য স্থির করবে। এই শিক্ষানীতি মূলত শিক্ষার লক্ষ্যাদর্শভিত্তিক ও দিকনির্দেশনা মূলক দলিল, এর ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দসহ বিস্তারিত পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দপ্তর ও অধিদপ্তর সমূহ।
শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা কমিটি ঃ
একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য সরকার যে দল বা গোষ্ঠীর উপর দায়িত্ব অর্পন করে তাই হলো শিক্ষা কমিশন। মূলত শিক্ষা কমিশন একটি দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। বাংলাদেশে আজ অবধি অনেকগুলো শিক্ষাকমিশন তৈরি হয়েছে। যার উপর দায়িত্ব ছিলো একটি শিক্ষানীতি তৈরির কিন্তু কমিশনের শিক্ষানীতি বিষয়ক রিপোর্টের কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা কমিশনগুলো হলো ঃ-
২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিয়া কমিশন ২০০২ সালের ড. এম এ বারী শিক্ষা কমিশন ১৯৯৭ সারের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন ১৯৮৮ সালে মফিজ উদ্দীন শিক্ষা কমিশন ১৯৭২ সালের কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। শিক্ষা কমিটি হলো কিছু সংখ্যক সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ যারা মূলত কোন শিক্ষানীতির আলোকে সংশোধনমূলক বা সময়োপযোগী খসড়া শিক্ষানীতির পরিকল্পনা পেশ করে। যেমন ঃ ২০০৯ সালের খসড়া শিক্ষানীতি তৈরির জন্য গঠিত কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিটি।
শিক্ষানীতির ইতিহাসঃ
ক্স ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি :
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়নের ইতিহাস আমাদের বেশ উজ্জ্বল। শিক্ষানীতি হিসেবে রিপোর্টগুলো গৃহিত হোক বা না হোক, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কমিশন বা কমিশনের আদলে কমিটি বা টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে এবং সেগুলোর প্রতিটি একটি করে রিপোর্ট প্রদান করেছে। ব্রিটিশ ভারতে ১৭৯২ সালে সর্বপ্রথম চার্লস গ্রান্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। প্রায় দুশ বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা মোট নয়টি কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে। যেমন-
১. ১৯৭২: চার্লস গ্রান্ট শিক্ষা কমিশন
২. ১৮১৩: কোম্পানি সনদ
৩. ১৮৩৫: লর্ড ম্যাকলে কমিটি
৪. ১৯৩৮: উইলিয়াম অ্যাডামস কমিটি
৫. ১৮৫৪: উডস এডুকেশন ডেসপাচ
৬. ১৮৮২: ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার শিক্ষা কমিশন।
৭. ১৯১৯: এম ই স্যাডলার শিক্ষা কমিশন
৮. ১৯৩৪ : সা প্র“ শিক্ষা কমিশন
৯. ১৯৪৪: জন সার্জেন্ট শিক্ষা কমিশন।
ক্স পাকিস্তান আমলে শিক্ষা কমিশন ও কমিটি ঃ
১৯৪৭ খৃষ্টাব্দের ১৪ আগষ্ট তারিখে এ উপমহাদেশে স্বাধীন গণতাান্ত্রিক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষপটে এ সদ্যজাত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারায় এক ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়। এ পরিবর্তন অবস্থার চাহিদা পূরাণার্থে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার বহু কমিশন ও কমিটি গঠন করে দেশে প্রচলিত বৃটিশ প্রবর্তিত ত্র“টি পূর্ণ ও ভারসাম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য প্রয়াস চালান, কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় ভেবে ইসলামি ভাবধারার নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবতর্নের জন্য জনগণ ও সোচ্চাার দাবী তোলেন।
মাওলানা আকরাম খান শিক্ষা কমিটি (১৯৪৯-৫১)
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় পর্যায়ে সারা দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে করাচিতে একটি শিক্ষা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই অধিবেশনের সুপারিশমালার আলোকে দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সময়োপযোগী একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার প্রয়াসী হন, জনগণের অনুভূতির প্রতি অনুকূল সাড়া দিতে গিয়ে সরকার ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দের ১৩ মার্চ শিক্ষাসমস্যাকে ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মাওলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে ১৭ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতির নামানুসারে এটি আকরাম খান শিক্ষা কমিটির নামে পরিচিত।
পূর্ববঙ্গ মাদরাসা শিক্ষা উপদেষ্টা আশরাফুদ্দিন চৌধুরী কমিটি-১৬৫৬)
পূর্ব বাংলার মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে তদানীন্তন সরকার একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির নাম ছিল পূর্ববঙ্গ মাদরাসা শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি। জনাব আশরাফুদ্দিন চৌধুরী এ কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন। তার নামানুসারে এ কমিটি আশরাফুদ্দিন চৌধুরী কমিটি নামে খ্যাত।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঃ
১. পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় কি কি ত্র“টি বিচ্যুতি রয়েছে তা চিহ্নিত করত: তা দূরীকরণ ও দেশের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পন্থা উদ্ভাবন করা।
২. দেশের উভয় ধারার শিক্ষা সমন্বিত করার লক্ষ্যে মাদরাসা শিক্ষা কোন স্তর প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরেরর সমান হবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা।
৩. মাদরাসা ঃ শিক্ষার শিক্ষাক্রমে কিভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমাবেশ ঘটানো যায় সে ব্যাপারেও সুপারিশ করা। যাতে এ ধারার শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সম্পানান্তে সম্মানজনকভাবে জীবিকার্জনের যোগ্যতা অর্জন সক্ষম হয়।
পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার (আতাউর রহমান খান) কমিশন-১৯৫৭
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বাস্তাবিকভাবে শিক্ষার কোন উন্নয়ন হয়নি। এমনকি ১৯৫২ খৃষ্টাব্দেই মাওলানা আকরাম খান কমিশনে বহু মূল্যবান সুপারিশ করা হলে ও সুপারিশসমূহের অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।
পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মূলত পুথিকেন্দ্রিক ও সেকেলে প্রকৃতির জীবন ও যুগের চাহিদার নিরিখে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রদেশের সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে যাতে সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিশিস্ট রাজনীতিবিদ জনাব আতাউর রহমান খান (চেয়ারমান ক্রমানুসারে এ কমিশন রিপোর্ট আতাউর রহমান খান ককিশন রিপোর্ট নামে পরিচিত। এ কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কার মাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কার ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংস্কারের ওপর গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করেন।
জাতীয় শিক্ষা (এস এম শরীফ) কমিশন রিপোর্ট ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে
১৯৫৮ খৃষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারী পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান কমিশনের উদ্বোধন করেন। এ অনুষ্ঠানে কমিশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণগঠন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দেন এবং আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমানসমূহ আরো সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হতে পারে এমন একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও বলেন যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে, যেন তা কৃষি, বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নয়নে সহায়তা করতঃ জাতির ক্রমবর্ধমান ও চাহিদা মেটাতে পারে। চরিত্র গঠন উন্নতমান অর্জন এবং শ্রমের মর্যাদাবোধ সৃষ্টির দিকে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য থাকা উচিত। তিনি আরো বলেন কমিশনকে দেশের সমগ্র জনশক্তি ও জাতীয় সম্পদ সর্বতোভাবে কাজে লাগাবার উপায় কি তার পন্থা নির্দেশ করতে হবে।
কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ঃ
যে প্রস্তাব অনুযায়ী কমিশন নিযুক্ত হয় তার ভূমিকায় বলা হয়েছে পাকিস্তানের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা জাতির অভাব পূরণের ও প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। জানগণের আশা আকাঙ্খা দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার সমন্বয় ও সুষম উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধানার্থে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও পুর্ণগঠনের যথাযোগ্য পন্থা সুপারিশ করার জন্য একটি উপযুক্ত কমিশন গঠন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
(হামুদুর রহমান) কমিশন রিপোর্ট ১৯৬৬ খৃষ্টাব্দ
পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে আগষ্ট তার রিপোর্ট জমা দেন এ কমিশন কর্তৃক পেশকৃত রিপোর্টের সুপারিশমালা ১৯৬০ খৃষ্টাব্দের ৬ ই এপ্রিল পাকিস্তান সরকার অনুমোদন করে ১৯৬১ -৬২ শিক্ষাবর্ষে সুপারিশমালার আলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন শুরু করেন। এদিকে কমিশন কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে সুপারিশকৃত পূর্ব পাকিস্তানে এবং সেপ্টেম্বর মাস পশ্চিম পাকিস্তানে অধ্যাদেশ আকারে সরকারিভাবে যোষণা করা হয়। সরকারি ভাবে ঘোষনার পরই এক বছরের মধ্যে ১৯৬২ খৃষ্টাব্দের প্রথম ভাগেই প্রথমে পূর্বপাকিস্তান এবং কিছু পরে পশ্চিম পাকিস্তানে আগুনঝরা ছাত্র আন্দোলন খুব জোরেশোরে শুরু হয়ে যায়। তারা কলেজও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে সংস্কার সাধন শুরু করা হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনমূখী ছাত্ররা আইনও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার লোকজনদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংগ্রামে লিপ্ত হতো লাগলো। ফলে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এইসব আন্দোলনকারী ছাত্রদের হটবার জন্য আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে বাধ্য হতে হল। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণভাবে এ শিক্ষা সংস্কারের বিরুদ্ধে এবং বিশেষ করে তিন বছর মেয়াদী স্নাতক পাশ কোর্স প্রবর্তনের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন তীব্রতার হতে থাকে। এই ফলশ্র“তিতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬২ খৃষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে এক হরতাল আহবান করা হয়। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অনুসরণের পশ্চিম পাকিস্তানে ও ছাত্র আন্দোলন জোরদার হতে থাকে এবং হরতাল ও অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন দুর্বার গতিতে চলতে থাকলে দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যথাক্রমেই সরকার বিরোধী রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। ফলে সরকার পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে তিন বছর মেয়াদী প্রস্তাবিত ডিগ্রী পাস কোর্স পরিহার করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর তারিখে সর্বপ্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে পেশোয়ার শহরে এমনি এক দুর্যোগমুহুর্তেও দেশের সংকটাপন্ন ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সুলতানে ঘোষনা করেন যে, ছাত্রদের সমস্যা নিরসনের জন্য সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করবে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এ কমিশন গঠন করেন এবং তাদের কর্ম পরিধি নির্ধারণ করে দেন।
পাকিস্তানের নতুন (এয়ার মার্শাল এম নূর খান শিক্ষানীতি ১৯৬৯ খৃষ্টাব্দ) ঃ
দেশে প্রচলিত দুটি শিক্ষা ধারার কোনটিই পুরোপুরি ভাবে সার্থক ও সন্তোষজনক নয়। অতএব, দেশের জন্য এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটাতে হবে যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন অধিকতর কার্যকর ভাবে পূরণে সক্ষম হয়।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নতুন শিক্ষা নীতির মূল উদ্দেশ্য হবে ঃ
১। ইসলামের ধর্মীয় ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সকলের জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধন নিশ্চিত করা।
২। একটি শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলা।
৩। বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের প্রতি অধিকার গুরুত্ব প্রদান করা।
৪। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকে শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫। শিক্ষাকে জাতীয় ঐক্যের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার নিশ্চিত করা।
পাকিস্তান সরকারের নতুন (শামসুল হক কমিটি) শিক্ষা ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে ঃ
১৯৬৯ খৃস্টাব্দের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট তার জাতীয় বেতার ভাষনে এবং পরবর্তীতে এক প্রেস কনফারেন্স ঘোষণা করেন যে, তার সরকার অতীতের তুলনায় অধিকহারে সামাজিক কর্মক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করছে। শিক্ষার সমস্যা নিরসনে শিক্ষার্থীদের সমস্যা দূরীকরণে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রচেষ্টা চালাবে। এতদুদ্দেশ্যে সরকার সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি নিবিড় পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করার লক্ষ্যে কেন্দ্রে এবং প্রাদেশিক পযার্য়ে কয়েকটি অনুধ্যান কমিটি গঠন করেন। ১৯৭০ খৃস্টাব্দের ১লা জানুয়ারী সরকার সংশোধিত প্রস্তাবলীর পুর্ণবিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। যা তেতাঁরা বিস্তারিতভাবে এর পর্যালোচনা পূর্বক পরীক্ষা করে ফেলে এদতসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করতে পারেন। ১৯৬৯ খৃষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর তারিখে জাতির উদ্দেশ্য প্রদত্ত প্রেসিডেন্টের ভাষনের ঘোষণায় যা বলা হয় তার আলোকে সংশোধিত প্রস্তাবলীর পর্যালোচনা করে দেখার পর কেবিনেট কমিটির রির্পোটটি পরবর্তী মন্ত্রী পরিষদ সভায় পেশ করা হয়। উক্ত রিপোর্টটি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দের মার্চের ১৩ ও ২৬ তারিখে মন্ত্রী পরিষদ সভায় গৃহীত হয় এবং ২৬ মার্চ ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদন লাভ করে।
ক্স বাংলাদেশ আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশনগুলো হচ্ছে-
১. ১৯৭৪: বাংলাদশে শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: কুদরাত-এ-খুদা)
২. ১৯৭৯: অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতিঃ জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদের সুপারিশ (সভাপতি: কাজী জাফর আহমদ/ আব্দুল বাতেন)
৩. ১৯৮৩: শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনা কমিশন (সভাপতি : মফিজউদ্দিন আহমেদ)
৫. ১৯৯৩ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক টাস্ক ফোর্স (সভাপতি: আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন)
৬. ১৯৯৭ : জাথীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি (সভাপতি : মোহাম্মদ শামসুল হক)
৭. ২০০০: জাতীয় শিক্ষা কমিটি
৮. ২০০২: শিক্ষা সংস্কার বিশেষজ্ঞ কমিটি (সভাপতি: মুহম্মদ আব্দুল বারী)
৯. ২০০৩ জাতীয় শিক্ষা কমিশন (সভাপতি: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা)
১০. ২০০৯: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯)
বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার হাল হকিকত ঃ
শিক্ষা, একটি জাতির জন্য সেই আলো স্বরূপ, যার কখনো নিভে যায় না। কিন্তু জঘন্য দৃপ্ততার সাথে জ্বলে তখন জাতিকে অন্ধকারে কথা মনেও করতে দেয় না। চলুন দেখা যাক, এ আলোর বাংলাদেশ কতটা আলোচিত।
বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৫৪%। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ১২ লাখ ২৫ হাজার ৪০২ জন। মোট শিক্ষক ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪৬৬ জন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ঃ২৫ (সরকারী তথ্যমতে)। বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। নারী পুরুষ হিসাবে শিক্ষিতের হার যথাক্রমে ৪৮.৬% এবং ৪৯.১%।
বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষার অধিকার ঃ
সংবিধান হলো জাতির দর্শনস্বরূপ। দেশের জনগণের প্রত্যাশা, প্রত্যয়, আদর্শ ও মূল্যবোধ সংবিধানে প্রতিফলিত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতিসত্ত্বার শিক্ষা সাধন এবং বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার ঘোষণার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে তা বাস্তবে রূপায়নের অন্যতম উপায় হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকৃত ও প্রতিশ্র“তি বিষয়।
এর প্রতিফলন সংবিধানের কিছু বিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবিধারেন অনুচ্চেদ ১৫, ১৬, ১৭, ১৯, ২৩, ২৮ ও ৪১ এ শিক্ষা সংক্রান্ত বিধানবলী বিধৃত হয়েছে। এবং এটাই হলো শিক্ষা বিষয়ক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল।
অনুচ্ছেদ (১৫) ক এ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ (১৭) ক একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের জন্য নির্ধারনী স্তর র্পযন্ত সকল বালক বালিকাকে তা বৈজ্ঞানিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদান।
অনুচ্ছেদ (১৭) খ সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছায় প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টি।
অনুচ্ছে (১৭ ) গ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়।
অনুচ্ছেদ ২৮ (৩) কোন নাগরিককে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনরূপ অক্ষমতা বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।
তাই জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সরকারকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়ঃ-
১. শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ।
২. সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা সংগঠন পালন।
৪. শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশনা ও পরামর্শ দান।
৫. পরিকল্পনা অনুযায়ী গৃহীত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ।
৬. শিক্ষার সমসুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭. সময়োপযোগী শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা।
৮. শিক্ষা তথ্য সরবরাহ ও গবেষণা কর্ম পরিকল্পনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা।
৯. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশী ও বিদেশির সাথে শিক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন।
১০. শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও যুক্তকরণ।
ছাত্র সমস্যা ও কল্যাণ সম্পর্কীয়
(হামুদুর রহমান) কমিশন রিপোর্ট, ১৯৬৬
প্রেক্ষাপট ঃ
১৯৫৯ সালের ২৩শে আগষ্ট পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন তার রিপোর্ট জমা দেয়। এ কমিশন কর্তৃক পেশকৃত রিপোর্টের সুপারিশমালা পাকিস্তান সরকারি ১৯৬০ সালের ৬ই এপ্রিল অনুমোদন করে।ে ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে সুপরিকল্পমালার আলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন শুরু হয়। এদিকে কমিশন কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ও সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে অধ্যাদেশ আকারে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। সরকারিভাবে ঘোষণার পরই ১৯৬২ সালে প্রথম ভাগেই প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে এবং কিচু পরে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলন জোরেশারে শুরু হয়ে যায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্তরে যে সংস্কার সাধন শুরু হয় ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনমূখী ছাত্ররা আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার লোকজনদের বিরুদ্ধে মুখোমুখী সংগ্রামে লিপ্ত হতে লাগলো। পুর্ব পাকিস্তানে ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষাকমিশনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়। একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে পশ্চিম পাকিস্তানেইও। পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে শিক্ষা কমিশনারে বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন দুর্বার গতিতে চলতে থাকলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যা ক্রমেই সরকারী বিরোধী রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। সরকার অস্থিরতা সামলাতে গিয়ে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রী পাস কোর্স পরিহার করতে বাধ্য হয়। ছাত্র আন্দোলনের প্রবল ঢেউ আঘাত হানে ঢাকা, করাচি, লাহোর পেশোয়ারে। ১৯৬৪ সালের ১০ই ডিসেম্বরে সর্ব প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১১ই ডিসেম্বর পেশোয়ারে ছাত্র পুলিশ এমনি সংকটময় মুহুর্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুলতানে ঘোষণা করেন যে, ছাত্রদের সমস্যা নিরসনের জন্য সরকার একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করবেন। এ পরিস্থিতিতে সরকার এ কমিশন গঠন করেন এবং তাদের কর্ম পরিধি নির্ধারণ করে দেন।
কমিটি গঠন ঃ
পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৫ই সেপ্টেম্বর এর স্মারক নং এফ৯-৩/৬৪-ইু.ই-১ এর দরবারে ছাত্রসমস্যা ও কল্যাণ সম্পর্কিত কমিশন গঠিত হয়।
কমিটির সদস্য বৃন্দ ঃ
১. বিচাপরপতি হামমুদুর রহমান, বিচারপতি পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট- চেয়ারম্যান
২. বিচারপতি এম এ মাহমুদ, বিচারক, হাইকোর্ট, পশ্চিম পাকিস্তান-সদস্য
৩. কাজী আনোয়ারুল হক, চেয়ারম্যান, সেন্ট্রলি পাবলিক সার্ভিস কমিশন-সদস্য
৪. ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ভাইস চ্যান্সেলর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-সদস্য
৫. নাসির আহমদ চেয়ারম্যান, পশ্চিম পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন-সদস্য
কমিটির কর্ম পরিধিঃ
ক. বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সের ধারা উপধারাগুলো সম্পর্কে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুণঃ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা এবং প্রয়োজনবোধে সংশোধন প্রস্তাব আনয়ন করা।
খ. শিক্ষাকার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে যে সব সুযোগ সুবিধা আছে তা খতিয়ে দেখা এবং প্রাপ্ত সম্পদের থেকে এর বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য প্রস্তাবনা।
গ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য যে সব চিত্তবিনোদনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে তা খতিয়ে দেখা এবং সামর্থের আওতায় প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা।
ঘ. ছাত্র জীবনকে আহত করে এমন সব বিসয়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ২
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৫