‘কফিশপটা খুব সুন্দর। তাই না? চারপাশে ছোট ছোট অর্কিড গাছগুলো যেন এর সুন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এখানকার কফিটাও বেশ।’ এভাবে কথা বলতে বলতে আমি অদ্ভুত সুন্দর এক মায়াবতীর মুখোমুখী গিয়ে বসলাম। আপনি বোধহয় এখনও কফির অর্ডার দেন নি। তাই না? একটু অপেক্ষা করুন এক্ষুনি চলে আসবে। আমি বলে এসেছি।
‘মায়াবতী চোখ থেকে চশমাটা খুলে ভ্রু কুচকালেন।’
আমি হাসলাম। কয়েকদিন ধরে এই কফিশপে আপনাকে দেখছি । আপনার সাথে অন্যদিন কাগজ কলম থাকে। আজ নেই। তাই ভাবলাম একটু... বাই দ্যা ওয়ে। কফি নিন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভাল্লাগবে না।
রুপবতী কফির মগে তার গোলাপী ঠোট ছুয়ালো। দেখে ঈর্ষায় আমার নিজের ঠোঁট পোড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি গরম কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনিতো লেখিকা। কত মানুষের গল্পইতো আপনি কাগজ কলমে জীবন্ত করে তুলেন। কত মৃত মানুষই তো আপনার কলমের খোঁচায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। আমি আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই। খুব সাদা মাটা একটা গল্প। আপনি সেই গল্প লিখবেন তো?
‘মায়াবতী আবারও ভ্রু কুচকাল। বলল, গল্প?’
হ্যা গল্প। আমি বলব। আপনি শুনে বাসায় গিয়ে লিখবেন। তাহলে শুরু করি। গল্পের শুরুটা হচ্ছে এমন – ‘সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া একটা ছেলে এমন একটা কফিশপে কাজ করতো। অন্যদিকে কলেজে পড়ুয়া একটা মেয়ে প্রতিদিন ক্লাস শেষ আসতো কফি খেতে। মেয়েটা কফিশপে এসে কফি অর্ডার করতো। ছেলেটা সেই কফি এগিয়ে দিত। এভাবেই তাদের পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব।’ এরপর কি লিখবেন জানেন তো?
‘মায়াবতী চোখ তুলে তাকাল। অথচ কিছুই বলল না।’
কি হল চুপ করে আছেন যে? আপনি না লেখিকা। এর পর কি লিখবেন এটাও বলতে পারছেন না? ওকে আমিই বলে দিচ্ছি। ‘একদিন মেয়েটা কফি খেতে খেতে ছেলেটাকে বলল, শুভ্র তোমাদের এই কফিশপটা এমনিতে সুন্দর। তবে যদি এর চারপাশে ছোট ছোট অর্কিড গাছ ঝুলিয়ে দেয়া যেত না! তাহলে আরো ভালো লাগত। সুন্দর লাগত দেখতে। তারপর ছেলেটা তার বসকে বলল এই কথা। কিন্তু বস তেমন আগ্রহ দেখলো না। ছেলেটা নিজের খরচে যে এই কাজটা করবে তার সেই সামর্থ্যও ছিল না। এই নিয়ে তার কয়েকদিন মন খারাপ ছিল।’
‘মায়াবতীর চোখ জোড়া ছলছল করছে। সে কফির মগটা রেখে কফিশপের চারপাশে ঝুলন্ত অর্কিড গাছগুলো দেখতে লাগল।’
তারপর কি লিখবেন শুনুন, ‘মেয়েটা ক্লাস শেষে কফিশপে এসে দেখতো ছেলেটার মাঝে আগের সেই চঞ্চলতা নেই। কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে। এই দেখে মেয়েটারও খুব খারাপ লাগল। কফি খেতে খেতে সে ভাবল কি করলে বা বললে ছেলেটার মন ভালো হয়ে যাবে? অনেক ভেবেও মেয়েটা তেমন কিছুই খুজে পেল না। শেষে যাওয়ার সময় বলে গেল লাল গোলাপ তার খুব পছন্দ। তারপর দিনই ছেলেটা একটা কান্ড ঘটিয়ে বসল। মেয়েটা কফির অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছে। ছেলেটা কফির পরিবর্তে একটা ডিশে ১০৮টা তরতাজা লাল গোলাপ সাজিয়ে নিয়ে আসল। তারপর হাটু গেরে বসে সরাসরি মেয়েটাকে প্রেম নিবেদন করল।’ আচ্ছা আমি কি হাটু গেরে বসে আপনাকে প্রেম নিবেদন করব? এতে আপনার লিখতে সুবিধা হবে। লিখবেন যে, ছেলেটা আচমকা পকেট থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে আমাকে প্রেম নিবেদন করল।
‘মায়াবতী গোলাপের গন্ধ শুকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।’
এটা ছেলেটার নিজের হাতে লাগানো গাছের গোলাপ। বাই দ্যা ওয়ে, তারপর কি লিখবেন শুনুন ‘মেয়েটা ছেলেটার সরল আবেদন উপেক্ষা করতে পারল না। কারন সেও ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এভাবে তাদের প্রেম একটু একটু করে বেশ জোড়ালো হয়ে উঠল। একটা সময় ওরা বুঝতে পারল একজনকে ছাড়া আরেকজনের চলে না। একটা মুহুর্তও কাটেনা তাদের। তারপর...তারপর একদিন ঘটে গেল এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুজই লাজ-লজ্জা সমাজ ভয় সব ভুলে কাছাকাছি এল। এত কাছাকাছি এল যে......’
‘মায়াবতী হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এর পরের টুকু আমি বলব।’
আমি বোকার মত হাসলাম।
মায়াবতী বলতে লাগল ‘সেদিনের সেই অনাকাংখিত ঘটনার পর ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে কথা দিয়েছিল সে কখনই মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যাবে না। মেয়েটা চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু তারপরই মেয়েটার সাথে ঘটে গেল আরেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তার বাবা একটা ছেলেকে নিয়ে এসে বলল, অবনী আজ এখনই এই ছেলের সাথে তোমার বিয়ে। অন্যথায় আমার মরা মুখ দেখবে। সেই পরিস্থিতিতে মেয়েটা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। বাবার এমন একমুখী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকল না তার। সে যে অন্য একজনকে দেহ মন সব দিয়ে এসেছে। সে কথাটাও বাবাকে বলার সুযোগ পেল না মেয়েটা। চোখের জল শুকিয়ে যাবার আগেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে হল। এরপর কেটে গেল প্রায় ৩টা বছর। এর মাঝে মেয়েটার কোলে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান আসে। মেয়েটা তার শিশুকন্যার নাম রাখল রাই’
আমি খেয়াল করলাম মায়াবতী চোখের জল আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। টপ করে দু-ফোটা জল পড়ল টেবিলে।
মায়াবতী বলল, মেয়েটা তিন বছর পর কেন আবার এই কফিশপে ফিরে এসেছে জানেন? কারন তার কাছে সেই ছেলেটার এই ঠিকানা ছাড়া আর কোন ঠিকানাই নেই। মেয়েটা দেশে এসেছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে একটা মুল্যবান জিনিস দিতে। কিন্তু মেয়েটা বুঝতে পারছেনা সেই মানুষটা মেয়েটার দেয়া সেই জিনিষটা গ্রহন করবে কিনা।’
সেই ছেলেটাকে দেয়ার মত মেয়েটার আর কি ই বা বাকী আছে? ছেলেটারই বা নেয়ার মত কি আছে আর? সে অনেক পেয়েছে। দুঃখ কষ্ট প্রতারনাসহ অনেক কিছু।
মায়াবতী কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, গল্পটা তো এখনো শেষ হয়নি। এরপর কি লিখব শুনুন ‘মেয়েটা তিন বছর পর দেশে ফেরার পর সেই পুরনো কফিশপে সেই শুভ্র নামের ছেলেটার সাথে দেখা হয় তার। ছেলেটা সেই আগের মতই আছে। একটুও বদলায়নি। শুধু বদলে গেছে তার কথা বলার ধরন। সে মেয়েটাকে আপনি করে কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটাও আগের মত তুমি করে বলার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটা এই মুহুর্তে পকেটে হাত দিয়ে একটা সিগারেট বের করল। কিন্তু মেয়েটা চাচ্ছে না ছেলেটা সিগারেট ধরাক।’
আমি সিগারেট-টা পকেটে রেখে দিলাম।
মায়াবতী বলল, আমরা গল্পের একদম শেষটায় চলে এসেছি। এখন কি হবে শুনুন। মেয়েটা ঠিক করেছে আগামীকাল তার ছোট্ট রাই’কে তার আসল বাবার হাতে তোলে দিবে। ও বেচারা জীবনে কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি। অথচ মেয়েটা অনেক কিছু পেয়েছে। শুভ্র নামের একটা পাগল ছেলের অপরিসীম ভালবাসা পেয়েছে। ওর আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। আচ্ছা রাইয়ের বাবা কাল ওকে নিতে আসবেতো?’
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৩১