“বাদশাহ নামদার” একটি ইতিহাস আশ্রিত ফিকশন। ইতিহাসের কোন চরিত্রকে সরাসরি নিয়ে এই প্রথম কোন উপন্যাস রচনা করলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেটা আবার হুমায়ূন মীর্জার মতো ‘বহু বর্ণে’র একজন সম্রাটকে নিয়ে। হুমায়ুন আহমেদ বইয়ের ভুমিকায় লিখেছেন – সম্রাট হুমায়ুন বহু বর্ণের মানুষ। তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রঙ ব্যাবহার করতে হয়নি। আলাদা গল্পও তৈরী করতে হয়নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তার জীবন পুর্ন।
বাদশা হুমায়ুন
ইতিহাস কখনো ম্যাড়ম্যাড়ে কখনো বা রহস্যপূর্ণ। প্রথাগতভাবে পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস লেখা হয় তা যে কতটা নিরস পাঠকমাত্রই তা স্বীকার করবেন। সে নিরস ইতিহাসকে লেখক হুমায়ূন এমন ভাবে পরিবেশন করেছেন যে, বইটা একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠা বেশ কঠিন। তো সময় করে লেখক হুমায়ূনের হাত ধরে চলে যান মোগল সম্রাট হুমায়ূনের রাজত্বে। তবে হ্যা রাজকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করে যেতে হবে কিন্তু।
রিভিউঃ
বইয়ের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মোঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন মীর্জা- কে নিয়ে। যিনি পিতার দিক থেকে তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের পঞ্চদশ পুরুষ।
খেয়ালী সম্রাট হুমায়ূন সর্বশ্রেষ্ঠ মোঘল সম্রাট আকবরের জম্মদাতা। জীবনের অধিকাংশ সময়ই যার কাটাতে হয়েছে শের খা (শের শাহ) নামক এক আফগান বীরের তাড়া খেয়ে। হুমায়ুন খেয়ালীপনা করে যেমন রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে যান বাদাখশানে। তেমনি তিনি সাম্রাজ্য হারিয়েও চৌদ্দ বছরের কিশোরী হামিদা বানুর প্রেমে পড়েন। এবং তাকে বিবাহে রাজি করাবার জন্য উপবাসও থাকেন!! পরে এই হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেন আরেক সম্রাট আকবর দ্যা গ্রেট।
এই খেয়ালী সম্রাট হুমায়ুনই স্বল্প অপরাধে যেমন কাউকে দিয়ে দিতেন মৃত্যুদন্ড। তেমনি গানে মুগ্ধ হয়ে গায়িকার সমওজনের স্বর্ন্মুদ্রাও দিয়ে দিতেন। একবার শের খা’র তাড়া খেয়ে নদীতে লাফ দিলে এক ভিসতিওয়ালার সাহায্য তার জীবন বাচে। পরে এই ভিসতিওয়ালাকে একদিনের (মুলত অর্ধেক দিন) জন্য দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট হুমায়ুন। অবশ্যই পরে এজন্য হুমায়ুনের ভ্রাতা মির্জা কামরানের হাতে জীবনও দিতে হয়েছে ভিসতিওয়ালাকে। সম্রাট হুমায়ূন শুধু তার খেয়ালিপনার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না। মোঘল চিত্রকলার শুরু হয়েছিল তারই হাত ধরে। বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় স্ত্রী হামিদা বানু এই সম্রাটকে বলছেন, ‘আপনি দুর্বল সম্রাট; কিন্তু অত্যন্ত সবল একজন কবি।’ ৭৩ পৃষ্ঠায় তার চিরশত্রু শের শাহ যিনি হুমায়ূনকে পরাজিত করে আগ্রা দখল করেছিলেন। তাঁরও নির্দেশ ছিল সম্রাট হুমায়ূনকে কোন অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, “তিনি মহান মানুষদের একজন। এই মানুষটির অন্তর স্বর্ণখণ্ডের মতো উজ্জ্বল। সেখানে কলুষতার কণামাত্র নাই।”
আমাকে যে চরিত্রটা সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ করেছে সেটা হল বৈরাম খাঁ। সেনাপতি বৈরাম খাঁ বিশেষ চরিত্র, যার বীরত্ব আর সাহসিকতা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সম্রাট হুমায়ূনের প্রতি তার প্রগাড় নিষ্ঠা চোখে পড়বার মতো। হুমায়ূনের মেয়ে আকিকা বেগমের কথাও ঘুরেফিরে এসেছে। এছাড়াও বইয়ে বেশ কিছু চরিত্র আমরা পাবো। এর মাঝে বিশ্বাসঘাতক হরিসঙ্কর। সিংহাসনলোভী হুমায়ূনের ভাই কামরান মীর্জা। হুমায়ূনের আরেক অনুগত আবতাবচি (যিনি পানি সরবরাহ করেন) জওহরকে। আগ্রা দখল করা শের শা। হুমায়ূনের বোন গুলবদন। উদার পারস্য সম্রাট শাহ তামাম্পা সহ আরো বেশ কিছু চরিত্রই পাঠকদের মুগ্ধ করবে। মুগ্ধ করার মত আরো আছে হুমায়ুন ও কামরান মির্জার চমৎকার কিছু শের। এর মাঝে একটা –
"হর মুসিবৎকো দিয়া এক তবুসুমসে জবাব
ইসতরাহ গরদিসে দৌড়োকে রুলায়া হ্যায় ম্যায়নে।"
অর্থঃ দুর্দিন ভেবেছিল সে আমাকে কাঁদাবে। উলটো হাসিমুখে আমি তাকে কাঁদিয়েছি।
বইয়ের শেষের দিকে এসে জানা যাবে শেষ জীবনে হুমায়ূন সব কিছুই বৈরাম খাঁ এর উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। যিনি হাজারো উত্থান- পতনে সম্রাটের সাথে থেকে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সম্রাটের মৃত্যুর পর আকবরের অভিভাবক হয়েছিলেন এই বৈরাম খাঁ। তবে তার করুণ মৃত্যুকে অবিচারই বলা যায়। কারন সিংহাসনে বসেই সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁ কে মক্কায় পাঠিয়ে দিতে চাইলেন। এবং আকবরের পাঠানো গুপঘাতকেরা বৈরাম খাঁ কে পথেই হত্যা করে। পৃথিবীর ইহিহাসে আকবরের পরিচয় আকবর দ্যা গ্রেট। কিন্তু বৈরাম খাঁ’র এমন করুন পরিনতি গ্রেট আকবরের কাছ থেকে আশা করা যায়না। তবে প্রদীপের নিচেই থাকে অন্ধকার।
শেষ করছি হুমায়ূনের বিদ্রোহী ভ্রাতা মির্জা কামরানের লেখা একটা কবিতা দিয়ে -
“রাজ্য হলো এমন এক রুপবতী তরুনী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন।”
*** পাঠকরা বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করে নিতে পারেন। (39MB)
http://www.mediafire.com/download/qo1t4kdqge6u7uh/Badshah+Namdar+By+Humayun+Ahmed+[+Nirjoy+].pdf
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৩