(এই গল্পের সমস্থ স্থান কাল চরিত্র এবং ঘটনার বর্ননা সম্পুর্ন কাল্পনিক। এর সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। গল্পের মুল পেক্ষাপট কিছুটা ভারতীয় চলচিত্র ‘জাতিস্বর’ থেকে অনুপ্রাণিত।)
বি.বাড়িয়া রেলওয়ে জংশন।
সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিট।
কিছুক্ষন আগে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নেই। সিগারেট হাতে ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রোবেন। আকাশে ছোট্ট টিপের মত চাঁদ উকি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে পাষন্ড মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে সেই টিপ। দেখে মনে হয়, এ যেন চলছে আকাশের বুকে কালো মেঘ আর পুর্নিমা চাঁদের লুকোচুরি খেলা। এই খেলা দেখতে রোবেনের ভাল্লাগছে। সে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোয়া ছাড়ল।
অন্যদিনের মত স্টেশনে আজও অনেক ভিড়। কিছুক্ষন আগেই পারাবত এক্সপ্রেস এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। এরপর থেকেই মানুষজন যে যার মত ছুটাছুটি করছে। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। হলুদ আলোয় মানুষের এমন ছুটাছুটি দেখতে ভাল্লাগছে। রোবেন একটা টং দোকানের সামনে পাতা কাঠের ব্যাঞ্চে গিয়ে বসল। ট্রেন ছাড়তে আরো মিনিট দশেক বাকী আছে বোধহয়। এই ফাঁকে শরীর চাঙ্গা করতে এক কাপ চা খেয়ে নিলে মন্দ হয়না।
ট্রেনের ‘ঘ’ নং বগির ২৩ নাম্বার সিটে গিয়ে রোবেন বসল। সিটটা জানালার পাশে হওয়ায় সুবিধা হয়েছে। ইচ্ছে করলেই মাথা বের করে সিগারেট খাওয়া যাবে। রোবেন হাতে ঘড়ি দেখল ৮টা বাজে। ট্রেন হালকা একটু কাঁপুনি দিয়ে চলতে শুরু করল। রোবেনের পাশের সিটটা এতক্ষন খালি ছিল। এখন একটা বয়স্ক লোক এসে বসল। লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে যথেষ্ট বিরক্ত করবে। রোবেন জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল। ঠান্ডা বাতাস এসে প্রেমিকার উষ্ণ আলিঙ্গলনের মত আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেও খারাপ লাগছে না।
পাশের সিটে বসা বয়স্ক লোকটা পান চিবুচ্ছে। জর্দ্দার কড়া গন্ধে নাকের ফুটোয় তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। রোবেনের আর সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে বমি করে কাপড়-চোপড় সব নষ্ট করে ফেলবে। আচ্ছা উনি যে জর্দ্দাটা খাচ্ছে তার নাম কি বাবা জর্দ্দা নাকি অন্যকিছু? লোকটা একবার রোবেনের দিকে তাকাল। রোবেন সিট ছেড়ে বগির শেষপ্রান্তে দরজার সামনে গিয়ে একটা সিগারেট জালিয়ে দাঁড়াল। এখানে হালকা হলুদ আলো আসছে। সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটা চিঠি বের করল। চিঠিটা রোবেনের বাবার হাতে লেখা। উনি গতবছর হিমছড়ি থেকে প্রায় ১০-১৫ কি.মি. দূরে একটা পুরোনো বাড়ি কিনেছেন। বিশাল বড় পুরনো একটা বাড়ি। এই বাড়ির ছোট-খাটো বর্ননা দিয়েই পুত্রকে চিঠিটা লেখা হয়েছিল। রোবেন মৃদু আলোয় চিঠিটা মেলে ধরল।
প্রিয় পুত্র,
পত্রের প্রথমেই আমার স্নেহ আর ভালোবাসা নিও। আমি এখানে এসেছি আজ ৭দিন হল। এর মাঝে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সবকিছু তোমাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা। আমার ইচ্ছা তুমি তোমার ওদিককার সব কাজ কর্ম গুছিয়ে অন্তত কয়টাদিন আমার সাথে এখানে এসে কাটিয়ে যাও। তুমি আসলে মুখোমুখি বসে এখানকার সব ঘটনা খুলে বলব। আপদত তোমাকে বাড়িটা সম্পর্কে অল্প একটু লিখে চিঠিটা শেষ করছি – আমার ধারনা এই বাড়িটা এক সময় কোন রাজবাড়ি ছিল। বাড়ির ভেতরটা দেখে আমার এমনই মনে হচ্ছে। যাইহোক, তোমাকে আকৃষ্ট করার মত বাড়ির সামনে বাহারী রকমের ফুল গাছ আছে! বলা যায় ছোট-খাটো একটা ফুলের বাগান। বাড়ির পেছনে আছে মাঝারি ধরনের একটা দীঘি। শান বাঁধানো ঘাটও আছে। নিশি রাতে যখন ফুলের গন্ধে পুরো বাড়িটা মৌ মৌ করবে। তখন চাইলেই তুমি দীঘির ঘাটে বসে নিজেকে রহস্য উপন্যাসের নায়ক ভাবতে পারো। আজ এটুকুই। আশা করছি খুব শিগ্রই তোমার সাথে দেখা হবে। সেই পর্যন্ত ভালো থেকো।
ইতি
তোমার বাবা।
বাবার সাথে খুব সম্ভবত সেখানে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছিল। যা বাবা চিঠিটে স্পষ্ট করে বলেনি। চেপে গেছে এবং আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কখন আমি যাব? উনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি গেলেই সব ঘটনা খুলে বলবে। কিন্তু ওখানে আসলে কি এমন ঘটেছিল যে, বাবা মাত্র তিনদিনের মাথার ধৈর্য হারিয়ে ফিরে এলেন? এসব ভাবে রোবেন। তার হাতের সিগারেটটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ টান দিয়ে ওটা ফেলে দিল সে। তারপর চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখতেই বয়স্ক লোকটা এসে তার সামনে দাঁড়াল। লোকটার ঠোটে এখন একটা সিগারেট জলছে। রোবেন সিগারেটের নাম দেখার চেষ্টা করল। লোকটা ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে একটু হেসে বলল, এটা মার্লবুরু সিগারেট। আমি আবার এটা ছাড়া খেতে পারিনা অভ্যাস হয়ে গেছে। রোবেন কিছুক্ষন লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। উনার কাপড়-চোপড়ের সাথে এই সিগারেটটা কেন যেন মিলছে না। লোকটার কথা-বার্তা শুনে বুঝে নিতে হবে উনার অবস্থাটা কেমন। রোবেন জিজ্ঞেস করল, চাচা আপনি যাবেন কোথায়? লোকটা হাসল। আমরা কে কোথায় যাব তা কেউই জানিনা বাবা। সব উনি জানেন। তবে সামনের স্টেশনেই আমি নেমে যাব। আপনাকে আর বিরক্ত করবনা। তখন জর্দ্দার কড়া গন্ধে আপনার মাথা ধরিয়ে দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত!
লোকটা পরিস্কার শুদ্ধ ভাষায় কথাগুলো বলেছে। এতে কোন গ্রাম্য বা আঞ্চলিক ভাষা ঢুকেনি। এ থেকে মনে হচ্ছে লোকটা অল্প হলেও শিক্ষিত। এবং চলাফেরা করেন স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের মানুষের সঙ্গে। যে কারণে উনি পরিস্কার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে অভ্যস্থ। যেমন তেমন মানুষ পুরো শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারেনা। উনি যেহেতু মার্লবুরু সিগারেট ছাড়া খেতে পারেনা। তাহলে উনি অবশ্যই আর্থিকভাবেও সচ্ছল। অসচ্ছল কেউ সাধারণত এত টাকায় সিগারেট কিনে খায়না। তাছাড়া আমি যে জর্দ্দার গন্ধে বিরক্ত হচ্ছিলাম। লোকটা এই ব্যাপারটাও সহজেই বুঝে ফেলেছেন। এ থেকে বুঝা যায় উনার চোখের দৃষ্টি অনেক ধারাল। এবং পর্যবেক্ষন ক্ষমতাও সেই লেভেলের। সবশেষে লোকটা দুঃখিত বলেছে। এ থেকে বুঝা যায় লোকটা নম্র ভদ্র এবং কিছুটা বিনয়ী।
ট্রেন আস্তে করে থামল। কোন ষ্টেশন এসেছে কে জানে? লোকটা ট্রেন থেকে নেমে রোবেনের দিকে তাকাল। তোমার মৃত বাবার ইচ্ছা তুমি অন্তত একবার হলেও সেই বাড়িটাতে যাও। ঐ বাড়িটাতে তোমার জন্য অনেক কিছুই অপেক্ষা করে আছে। সাবধানে থেকো।
রোবেন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। লোকটাও উলটো পথে হেঁটে চলে যাচ্ছে। লোকটাকে রোবেনের অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করার আছে। অন্তত এই কথাটা জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল, আমার বাবা চিঠি পাঠানোর তিনদিন পরই ফিরে আসেন। এবং পঞ্চমদিন সন্ধ্যেবেলায় মারা যান। কিন্তু এই ব্যাপারটা আপনি কি করে জানলেন?
ট্রেন ছেড়ে দেয়ায় কিছুই আর জিজ্ঞেস করা হল না রোবেনের। সে তার সিটে গিয়ে বসল। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে হয়তো কোন একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে। লোকটা ট্রেনে থাকা অবস্থা আমাকে আপনি করে কথা বলছিল। ট্রেন থেকে নামা মাত্রই তুমি করা বলেছে। আচ্ছা লোকটা কোন ভাবে আমার ব্যাগের ভেতর বাবার ডায়রীটা পড়েনিতো?
রাত ১১টা ২০মিনিট।
কমলাপুর রেলওয়ে জংশন।
পারাবত এক্সপ্রেস এসে লাইনে দাঁড়াল। যাত্রীরা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে সব। রোবেন তার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই নীচে অর্ধেক খাওয়া একটা মার্লবুরু সিগারেট চোখে পড়ল। তারমানে লোকটা এখানে বসেও সিগারেট খেয়েছে। লোকটার জন্য রোবেনের একটু মায়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে পথে পাওয়া এমন মানুষদেরকেও আপন ভাবতে ভালো লাগে। রোবেন ষ্টেশন থেকে বের হয়ে একটা টেক্সি নিল। গন্তব্যস্থল খিলখাও।। আজ রাতটা সে তার বন্ধু আবীরের বাসায় কাটাবে। আবীরকে আগেই সব বলা আছে। কাল সকালে ওকে নিয়ে হিমছড়ি যাবে তাও বলে আছে। এবং এতে দেখা গেল এই ব্যাপারে রোবেনের চেয়েও আবীরই বেশী ইন্টারেস্টেড। রোবেন গাড়িতে উঠে চোখ বন্ধ করে বসল। টেক্সি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যে…
ঢাকা থেকে চিটাগং এসে একটাদিন থাকল ওরা। তারপর দিন সকালে একটা মাইক্রোবাসে করে যাত্রা শুরু করল। কক্সবাজার ছেড়ে হিমছড়ি। সেখান থেকে আরো প্রায় ১০ কি.মি দূরে ‘রাজারকুল’ নামক একটা জায়গায় এসে নামল তারা। এখান থেকে উচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা শুরু। মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে হবে প্রায় ৩ কি.মি. ভেতরে। আবীর বলল, আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। তোর বাবা এত জায়গা থাকতে এই জায়গার খবর কি করে পেল? মানে উনি কি করে জানলেন যে, এখানেই একটা পুরনো বাড়ি আছে। এবং সেটা বিক্রি করা হবে?
রোবেন কিছু বলল না। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আবীর একটা সিগারেট জ্বালাল। আমি যদি আগে জানতাম এমনটা হবে! তাহলে কখনও আসতাম না। তোর সাথে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে। ওখানে গিয়ে আবার কি হবে কে জানে? হয়তো গিয়ে দেখা যাবে আমরা ভুল ঠিকানায় চলে গেছি। তখন আবার হেঁটে হেঁটে ফিরে আসতে হবে। ডিসগাস্টিং!
রোবেনের কাছে এখানের রাস্তাটা কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। অথচ এর আগে সে কখনও এখানে আসেনি। সে আস্তে করে বলল, আবীর! ওরকম কিছু হবে না। আমরা ঠিক পথেই এগুচ্ছি। আবীরও কিছু বলল না। সে শুধু একবার রোবেনের দিকে তাকাল। এই তাকানোর মাঝেই ছিল প্রশ্ন! ‘সত্যিই তো’ ?
চলবে…
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:১৭