আজকাল কাগজের মলাটে আবদ্ধ বই হাতে নিয়ে না পড়লেও মোবাইল/ট্যাব/কম্পিউটারে পিডিএফ বই কিন্তু কম বেশী সবাই পড়ে। বই মানুষের নিত্যসঙ্গী, জ্ঞানের আধার। মাঝে মাঝে বই বিনোদনের খোরাকও হয়। এই বই পড়েই মানুষ হিমু, মিসির আলী, শার্লক হোমসের মত হাজারো চরিত্রের সাথে পরিচিত। এবং কখনো কখনো নিজেকে এই চরিত্রের মত ভেবে কেউ কেউ রোমাঞ্চিতও হয়। মাঝে মাঝে বই মানুষকে যেমন রহস্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। আবার সেই বই-ই সকল রহস্যের জট খুলে দেয়। কিন্তু এখন যে বইয়ের কথা বলব। সেটা নিজেই কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্ববাসীকে রহস্যের মায়াজালে ডুবিয়ে রেখেছে। বইটির নাম হচ্ছে কোডেক্স গিগাস(Codex Gigas)। ল্যাটিন শব্দ ‘কোডেক্স গিগাজ’র অর্থ হল বিশাল আকারের বই। এ বইটি শয়তানের বাইবেল নামেও পরিচিত। বইটি কাঠের তৈরি মলাটে ঢাকা, যা চামড়া এবং কিছু অলঙ্কৃত ধাতু দিয়ে আবৃত। এই বইটি আকারের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বই।
কোডেক্স গিগাস বা শয়তানের বাইবেল ৩৬.২ ইঞ্চি লম্বা, ১৯.৭ ইঞ্চি চওড়া এবং ৮.৬ ইঞ্চি পুরু, যা মধ্যযুগীয় বৃহত্তম পাণ্ডুলিপি হিসেবে পরিচিত। ৭৫ কেজি ওজনের এ পাণ্ডুলিপিতে রয়েছে ৩১০টি চামড়ার কাগজ, যা তৈরি করতে ১৬০টি খচ্চরের চামড়া ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম দিকে এতে ৩২০টি (কোথাও আবার ৬০০ পাতাও বলাও হয়) পাতা ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এর থেকে ৮টি পাতা অপসারিত করা হয়। ধারণা করা হয়, সে পাতাগুলোতে বেনেডিক্ট সন্ন্যাসীদের নিয়ম-কানুন ও গোপন তথ্য ছিল। এই বই স্থানান্তরিত করতে কমপক্ষে ২জন মানুষ লাগে। কোডেক্স গিগাস বা শয়তানের বাইবেল নামের এ বইটি নিয়ে অদ্ভুত এক পৌরাণিক কাহিনী আছে।
কাহিনীঃ
তেরশো শতাব্দীর প্রথম অংশে হারম্যান রিকুলাস নামে এক সন্ন্যাসী এই কোডেক্স গিগাস লিখেছেন। তিনি বোহেমিয়ার বেনেডিক্ট পোডলাজাইসের আশ্রমে একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি আশ্রমের অন্য সাধুদের সাথে পরম্পিতার নাম জপ করে জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এক দুর্বল মুহুর্তে তিনি আশ্রমের নিয়ম ভঙ্গ করেন। সন্ন্যাসীদের নিয়ম ভঙ্গের পাপ হিসেবে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তি হল একটা বদ্ধ কুঠুরিতে তাকে আজীবন নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটাতে হবে। হারম্যান এই কঠিন শাস্তি মেনে নেন। এক পর্যায়ে তিনি আশ্রমগুরুকে তার পাপের শাস্তি লাঘবের জন্যে প্রস্তাব দেন। গুরু হারম্যানকে পাল্টা শর্ত ছুড়ে দেন, এক রাতের মধ্যে তার অর্জিত জ্ঞান যা আছে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণে তাকে একটা বই লিখতে হবে- যে বইয়ে সৃষ্টিকর্তা আর মঠের গুণগান থাকবে, থাকবে মানুষের বিভিন্ন উপকার কিভাবে হয় সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য। হারম্যান শর্ত মেনে নেন। হারম্যানকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় লেখার উপকরণ খচ্চরের চামড়া আর কালি। এক সন্ধ্যায় লিখতে বসেন হারম্যান। তিনি মাঝরাত পর্যন্ত এসে দেখতে পান মাত্র অর্ধেক পাতা লিখতে পেরেছেন। হতাশায় হারম্যান ওই মাঝরাতে নিজের রক্ত দিয়ে শয়তানকে একটা চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি শয়তানের কাছে এই বলে সাহায্য কামনা করেন যে, শয়তান যদি তাকে এ বই লিখে দেয় তবে তিনি তার আত্মা শয়তানকে সঁপে দেবেন। হারম্যানের ডাকে সাড়া দেয় শয়তান। স্বশরীরে হাজির হয় শয়তান। শুরু হয় কোডেক্স গিগাস লেখা। ভোরের আগেই লেখা শেষ হয়ে যায় এই বিশাল বইটি। নিজেকে প্রমাণ দেবার জন্যে নিজ হাতে শয়তান তার ছবি বইটির ২৯০ নম্বর পৃষ্ঠায় এঁকে রেখে যায়।
শয়তানের সাহায্যে লেখা বলেই একে শয়তানের বাইবেল বলা হয়। কী আছে এই কোডেক্স গিগাস বা শয়তানের বাইবেলে? ল্যাটিন ভাষায় পুরো ভালগেইট বাইবেলের পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক নথি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এতে। স্রষ্টার বিপক্ষতার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা দেয়া আছে। এছাড়াও ভয়ঙ্কর রোগের অভিশাপ ও মুক্তি, আত্মাকে বশীকরণ ও লালন-পালন, কালোজাদুর মন্ত্রসহ নানা বিষয়ে সমাধান দেয়া আছে এতে। কিভাবে ডাইনি চেনা যায় বর্ণনা রয়েছে এখানে। এমনকি চোর ধরার কলাকৌশলও আছে এ বইয়ে। বেনিডিকটাইন সন্ন্যাসীরা অর্থসঙ্কটে পড়ে বইটি প্রাগের এক সন্ন্যাসীর কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর এ বই ১৪৭৭-১৫৯৩ পর্যন্ত ব্রোমভ মনাস্টরিতে ছিল। বইটির প্রতি মোহ দেখে সম্মান স্বরূপ প্রাগের সন্ন্যাসীরা প্রাগ সম্রাট রুডলফকে বইটি উপহার দেন। ১৬৪৮ সালে প্রাগের সঙ্গে ৩০ বছরের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী সুইডিশ সৈন্যরা এ বই লুট করে ১৬৪৮ সালে স্টকহোমে সুইডিশ রয়াল লাইব্রেরিতে নিয়ে যায়। ১৬৪৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বইটি সেখানেই সংরক্ষিত ছিল। ৭ মে ১৬৯৭ সালে সুইডেনের রাজপ্রাসাদের লাইব্রেরিতে এক মারাত্মক আগুন লাগে। আগুনে বইটির কিছু পাতা পুড়ে যায়। কিছু পাতা বাতাসে উড়ে যায়। এ পৃষ্টাগুলো আর পাওয়া যায়নি। বর্তমানে এটি সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগার স্টকহোমে সংরক্ষিত রয়েছে। কোডেক্স গিগাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে এ কোডেক্স গিগাস একজন মানুষেরই হাতে লেখা। এটি লিখতে ব্যবহার করা হয়েছে পোকামাকড়ের বাসাবাড়ি দিয়ে তৈরি একই ধরনের কালি। তবে এর লেখার ব্যাপ্তিকাল নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন এটা লিখতে ৫ বছর লেগেছে আবার অনেকের মতে এটা লিখতে ২৫-৩০ বছর সময় লেগেছে। সেই একজন কি হারম্যান নাকি শয়তান নিজে সেটা আজও এক রহস্যময় ব্যাপার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৪১