একবার ইন্দ্রের রাজসভায় রাজা পুরুরবা আমন্ত্রিত হয়ে আসলে ইন্দ্র নৃত্যগীতের আয়োজন করে। সেখানে নৃত্য পরিবেশন করে উর্বশী নামের এক অপ্সরা। রাজা পুরুরবা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে উর্বশীর দিকে। কি সুন্দর রুপ। আর কি চমৎকার নাচ! এদিকে রাজা পুরুরবার মুগ্ধ চোখে চোখ পরতেই উর্বশীর নৃত্যের ছন্দ ভেঙ্গে যায়। আর এই পুরো ব্যাপারটাই ইন্দ্রের চোখে ধরা পরে। তারপই ইন্দ্র অভিশাপ দেয় উর্বশীকে মর্তবাসী হওয়ার। তাকে সাধারন মানুষের সাথে পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে। এবং এই অভিশাপেই উর্বশীকে ছাড়তে হল স্বর্গ।
যেহেতু রাজা পুরুরবার জন্যই উর্বশীকে স্বর্গ ছাড়তে হবে। তাছাড়া পুরুরবা উর্বশীর রুপে-গুনে তার প্রেমেও পরে গেছে। তাই রাজা পুরুরবা উর্বশীকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এদিকে উর্বশীও পুরুরবার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছে। তাই উর্বশী ইন্দ্রের কাছে একটা আর্জি করে বসলেন। সে মত্যলোকে পুরুরবার স্ত্রী হয়ে থাকতে চায়। তো দেবতা ইন্দ্র উর্বশীর এই আর্জি মেনে নিলেন। কিন্তু তার পেছনে কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিলেন।
শর্তগুলো এমন –
– উর্বশী যেন কখনোই পুরুরবাকে নগ্ন অবস্থায় না দেখে।
– দিনে তিনবারের বেশী পুরুরবা উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবে না।
– শুধুমাত্র উর্বশী কামাতুর হলেই; পুরুরবা তার সাথে মিলিত হতে পারবে।
– উর্বশীর শয্যার পাশে দুটি মেষ শাবক থাকবে। এবং উর্বশীকেই এই মেষ শাবক দুটিকে চুরির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
– পুরুরবা মাত্র এক শন্ধ্যা ঘি আহার করবে।
শর্ত শুনে উর্বশী-পুরুরবা ভাবলেন এ আর এমন কি শর্ত? তারা শর্ত মেনে নিলেন। তারপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। পৃথিবীতে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করল।
বহু বছর পর স্বর্গের সভাসদ্গন উর্বশীর অভাব অনুভব করলেন। তারা ভাবলেন উর্বশীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু একজনের বিবাহীত স্ত্রীকেতো বললেই নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই দেবতারা অন্য পথ খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে একটা পথ তারা পেয়ে গেল। বিশ্ববসু নামক এক গন্ধর্ব উর্বশীর মেশ শাবক দুটি চুরি করে নিয়ে আসবে। তো এক রাত্রীতে তাই হল। বিশ্ববসু মেষ শাবক দুটি চুরি করল। উর্বশী হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখে মেষ শাবক দুটি নেই। কাঁদতে কাঁদতে পুরুরবাকে ডেকে তুলল। দ্রুত বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পুরুরবা খেয়ালই করেনি তার বস্ত্র বিছানায় রয়ে গেছে। সে নগ্ন হয়েই মেষ শাবক খুঁজতে লাগল। ঠিক তখনই দেবতারা আকাশে বজ্রপাত ঘটালেন। বজ্রপাতে বিদ্যুতের সৃষ্টি করলেন। আর এতেই পুরো ঘর আলোয় ভরে উঠলে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলে। ইন্দ্রের দেয়া শর্তের একটি লঙ্গন হয় মেষ শাবক চুরির হাত থেকে রক্ষা করতে না পারায়। আর অন্যটি হয় উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলা। শর্ত লঙ্গন হওয়ায় উর্বশী ধীরে ধীরে আকাশে স্বর্গের দিকে উড়ে যেতে থাকে।
উর্বশীকে হারানোর শোকে রাজা পুরুরবা একদম পাগল প্রায়। সে এ দেশ থেকে ও দেশ ঘুরে বেড়াতে লাগল উর্বশীকে ফিরে পাবার আশায়। ধীরে ধীরে তার এই আশা ক্ষীন হতে লাগল। কিন্তু একদিন কুরুক্ষত্রে এসে দেখে চারজন অপ্সরার সাথে উর্বশীও স্নান করছে। স্নান শেষে পুরুরবা এগিয়ে যায়। উর্বশীকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইল সে। কিন্তু উর্বশী স্পষ্ট জানিয়ে দিল এটা অসম্ভব! দেবতাদের বাইরেতো আর যাওয়া সম্ভব না। তবে বছরের শেষ রাতে পুরুরবা চাইলে উর্বশীর সাথে মিলিত হতে পারবে। এই প্রতিশ্রুতি দেয় সে। এরপর থেকে বছরে একরাত্রী করে উর্বশীকে কাছে পায় পুরুরবা। এভাবে প্রতিবছর একটি করে পুত্র সন্তান দিতে থাকল উর্বশী-পুরুরবা। বলা হয়ে থাকে এভাবে তাদের সাতটি পুত্র সন্তান হয়। এদের নাম – আয়ু, অমাবসু, বিশ্বায়ু, স্রুতায়ু, দৃঢ়ায়ু, বলায়ু ও শতায়ু।
সাত পুত্র সন্তান জন্মের পর একদিন উর্বশী পুরুরবাকে বলল, দেবতা তোমার মনের ইচ্ছা পুরন করবে। তবে একটা শর্ত আছে। পুরুরবা জানতে চাইল কি শর্ত? উর্বশী বলল, স্থায়ীভাবে স্বর্গে এসে বসবাস করতে হবে। কিন্তু তার জন্য পুরুরবাকে একবার মৃত্যুকে গ্রহন করতে হবে। পুরুরবা এই শর্তে রাজী হল। তারপর দেবতারা উর্বশীর প্রতি পুরবার প্রেম দেখে উর্বশীর সাথে পুরুরবাকেও ইন্দ্রলোকে নিয়ে গেল। এরপর পুরুরবা মর্তের মায়া ত্যাগ করে উর্বশীকে চিরজীবন কাছে পাওয়ার জন্য ইন্দ্রলোকে বসবাস করতে লাগল।
উর্বশীকে নিয়ে আরো কয়েকটি মিথ প্রচলিত আছে- এর মধ্যে অন্যতম হলো –
** মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রম উর্বশী’ নাটকে উল্লেখ করেছেন- কেশী দৈত্য উর্বশীকে হরণ করলে পুরুরবা উর্বশীকে উদ্ধার করেন। এর ফলে উর্বশী ও পুরুরবা উভয়ে প্রেমে আসক্ত হয়। স্বর্গে অভিনয়কালে ভুল ক্রমে পরুরবার নাম উর্বশী উচ্চারণ করায় দেবতাগন উর্বশীকে অভিশাপ দেন মত্যে পুরুরবার স্ত্রী হবার জন্য। পুত্রের মুখ দেখার পর উর্বশী অভিশাপ থেকে মুক্ত হন। পরে দেব গায়ক নারদের বরে উর্বশী ও পুরুরবার মিলন চিরস্থায়ী হয়।
** পদ্মপুরানে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। ইন্দ্র তার তপস্যায় ভীত হয়ে তাতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য কয়েকজন অপ্সরার সাথে বসন্ত ও কামদেব কে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারা এই তপস্যা ভঙ্গ করতে ব্যর্থ হলে পুনরায় কামদেব অন্যান্য অপ্সরার উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করে উর্বশীকে বিষ্ণুর নিকট পাঠিয়ে দেন। এই সময় উর্বশী বিষ্ণুর ধ্যন ভঙ্গ করতে সফল হন। এই সময় ইন্দ্র উর্বশীর উপর সন্তুষ্ট হন এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাবার ইচ্ছে পোষণ করেন।উর্বশী এতে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু পরে মিত্র ও বরুণও উবর্শীকে পাবার ইচ্ছে পোষণ করলে উর্বশী তাদের প্রত্যাখ্যান করেন। এই মিত্র ও বরুন উর্বশীকে অভিশাপদেন যে- উর্বশী মনুষ্যভোগ্যা হয়ে মত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করবে। এর ফলে উর্বশী পুরুরবার স্ত্রী হিসেবে মত্যলোকে জন্ম গ্রহণ করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৫ রাত ৯:০৯